You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.16 | নাগলা সেতুর যুদ্ধ, ময়মনসিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

নাগলা সেতুর যুদ্ধ, ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ জেলার অধীন ফুলপুর থানা ও হালুয়াঘাট থানার প্রধান সংযোগ সড়কের ওপর নাগলা বাজারের অনতিদূরে ভূগাই নদীর উপর নাগলা সেতুর অবস্থান। উত্তর-দক্ষিণে ৮০-৯০ ফুট দীর্ঘ আর সি সি নির্মিত সেতুটিতে ৪টি বীম ও ৬টি স্ক্যান ছিল। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশের সীমান্তবর্তী থানা হালুয়াঘাট এবং ধোবাউড়া থানার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো সড়ক পথ। যুদ্ধকালীন সময়ে এই সড়ক পথের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকবাহিনী তাদের সীমান্তে অবস্থিত বিওপি এবং অপরাপর অবস্থানে সৈন্যদের জন্য খাদ্য, রসদ, অস্ত্রশস্ত্রসহ যাবতীয় জিনিসের সরবরাহ এই সড়ক পথে সরবরাহ করতো। নাগলা সেতুর অবস্থান ছিল ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকায়। ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল ময়মনসিংহে। নাগলা সেতুর নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত কোনো সৈনিকের অবস্থান ছিল না। সেতুর দু’পাশে মিলিশিয়া ও রাজাকার দল নিয়মিত পাহারায় নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ত ধারণা ছিল সেতু আক্রান্ত হলে অনতিদূরে ফুলপুরে অবস্থানরত ৩৩ পাঞ্জাব থেকে সাথে সাথে রিইনফোরসমেন্টের মাধ্যমে শক্রর মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ডালু সাব সেক্টর কমান্ডারের কাছ থেকে নাগলা সেতু ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তানীবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার নির্দেশ আসে। কমান্ডার আবদুল হকের নেতৃত্বে ৪১ জন সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলকে নাগলা সেতু ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই দলের মধ্যে বিস্ফোরক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৬ জুলাই ১৯৭১ রাতে ৪১ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধা দল বিকাল ৫টায় কমান্ডার আবদুল হকের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকসহ বারমারী ও হাতিবান্ধা বিওপি এবং মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই দলের সাথে প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ প্রত্যেকের নিকট একটি করে গ্রেনেড এবং সেতু উড়ানোর জন্য ৭০০ পাউন্ড এক্সপ্লসিভ ছিল। রাতের আঁধার এবং বৃষ্টি থাকায় মুক্তিযোদ্ধা দলের পথ চলার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। এক রাত একদিন সমস্ত রাস্তা বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার দিকে মুক্তিযোদ্ধা দলটি কালাপাড়া গ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে এরমাকালা হয়ে পাটিয়াজুরি হাই স্কুল থেকে আধা মাইল উত্তরে প্রাথমিক আস্তানা সৃষ্টি করে। ১৮ জুলাই সকালবেলা কংস নদী পার হয়ে রামনগরের মধ্যে দিয়ে কোদালিয়া পৌছে। মুক্তিযোদ্ধা দলটি পরদিন আমতালী গ্রামের মধ্য দিয়ে শিমুল গ্রামের উত্তর দিকে রাত ৮টা নাগাদ নাগলা বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। কমান্ডার আবদুল হক কয়েকজনকে সাথে নিয়ে প্রথমে সেতুর কাছাকাছি পৌঁছে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তখন রাত আনুমানিক ১১টা। এই সময় হালুয়াঘাট থেকে একটি এবং ফুলপুর থেকে আর একটি জীপ এসে সেতুর উপর থামে। সেতুর উপর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর জীপ দু’টি আবার দু’দিকে ফিরে যায়। অনুমান করা যায় এগুলো ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর নিয়মিত টহল গাড়ি। দলনেতা আবদুল হক পাহারারত রাজাকারদের অবস্থআন পর্যবেক্ষণের পর ফিরে এসে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারকারী দলকে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যথাযথ তদারকী করে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। এই সময় তিনি দলটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করেন। গাইড ধীরে ধীরে কমান্ডারের নির্দেশে সামনে অগ্রসর হয়। গাইডের দিকে লক্ষ্য রেখে সকলে সামনে এগুতে থাকে। আনুমানিক রাত ২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা দলটি নাগলা বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে সেতুর ৫০০ গজ নিকটবর্তী অবস্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে মূল সড়কের উপর অবস্থান নেয়। ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার অগ্রবর্তী দলটি সেতুর ১০০ গজের কাছাকাছি পৌছলে পাহারারত মিলিশিয়া এবং রাজাকার দল কারো অবস্থান টের পেয়ে শক্তিশালী টর্চলাইট দিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী দলের উপর আলো ফেলার আগেই মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম রতন তড়িৎ গতিতে পজিশন নিয়ে সেতুর উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। একই সাথে অন্যান্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এমতাবস্থায় পাহারারত রাজাকার ও মিলিশিয়া দল মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান অনুমান করে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারকারী দল সেতুর উত্তর পাশে সেতুর মুখে গর্ত খুঁড়ে এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে সেতুর দক্ষিণ পাশে এসে করডেক্স তারের সাহয্যে ফিউজে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণে সেতুটির সামগ্রিক ক্ষতি সাধিত হয় এবং ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে।
[১৬] এ এস এম সামছুল আরেফিন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত