নগরবাড়ী ফেরিঘট প্রতিরোধ যুদ্ধ, পাবনা
মুক্তিযুদ্ধে পাবনার ইতিহাস অত্যান্ত গৌরবোজ্জ্বল একটি ইতিহাস। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত পাবনা জেলা দেশের উত্তর জনপদে পদ্মা ও যমুনা নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এই জেলার আলোচ্য তিনটি থানা দক্ষিণে পদ্মা ও পূর্বে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। এই তিন থানার সংযোগস্থল নগরবাড়ী ফেরিঘাট ছিল সাময়িকভাবে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তরবঙ্গে প্রবেশের জন্য একমাত্র প্রবেশদ্বার। তাই সামরিক বিবেচনায় এই এলাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এই এলাকার মুক্তিপাগল জনগণের ভূমিকা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক স্বর্ণজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে জাতি স্মরণ রাখবে। পাবনার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে নগরবাড়ী ফেরিঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধ ইতিহাস প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
ক. তৎকালীন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশীদ খান পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদ পেয়ে নগরবাড়ী ঘাট এলাকায় চলে আসেন এবং ২৯ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে কাজীরহাট থেকে নগরবাড়ী ঘাট এলাকা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন।
খ. ১ এপ্রিল পাকবাহিনী নগরবাড়ী ঘাট দখল করার জন্য তিনটি গানবোটসহ কয়েকটি লঞ্চযোগে অভিযান চালায়। নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বাধার মুখে শক্রপক্ষ সেদিন আরিচাভিমুখে ফেরত যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পর ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শক্রপক্ষ নগরবাড়ী ঘাট দখলে পুনরায় হানা দেবে নিশ্চিত জেনে মুক্তিযোদ্ধারা নগরবাড়ী ফেরিঘাট প্রতিরক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই সময় মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয়/প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল নাটাবাড়ীয়া (ধোবাখোলা করনেশন হাই স্কুল)।
গ. ৮ এপ্রিল বিকাল থেকে শুরু হয় নগরবাড়ী ফেরিঘাট এলাকায় শক্রর বিমান আক্রমণ। অতঃপর শেষরাত থেকেই অর্থাৎ ৯ এপ্রিলের প্রথম প্রহরেই চলতে থাকে আর্টিলারি বোম্বিং। সেই সাথে খুব ভোরেই গানবোট সহযোগে ১৫টি লঞ্চ ও ৪টি বড় ফেরিসহ মূল বাহিনী আরিচা থেকে নগরবাড়ী অভিমুখে যমুনা নদী দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। নগরবাড়ী ফেরিঘাট এলাকা থেকে তখনও মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ওপর ৩০৩ রাইফেল দিয়েই গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় আর্টিলারি গোলায় ৪ জন ইপিআর সদস্য শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী নগরবাড়ী ঘাট থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দক্ষিণে বর্তমানে নটাআলা ঘাট এলাকায় পদাতিক সৈন্য অবতরণ করায়। এভাবে আর্টিলারি কভার নিয়ে নদী থেকে গানবোট এবং ভূমিতে পদাতিক সৈন্য সহযোগে দক্ষিণ দিক থেকে নগরবাড়ী ঘাটের ওপর পাকবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এই অবস্থায় মুক্তিবাহিনী নগরবাড়ী ঘাট আর দখলে রাখতে পার এনা এবং ওই দিনই অর্থাৎ ৯ এপ্রিল নগরবাড়ী ফেরিঘাটের পতন ঘটে। অতঃপর পাকবাহিনী ১০ এপ্রিল তারিখে পাবনা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধের পর নগরবাড়ী ঘাট থেকে পশ্চাৎপসরণ করে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই পায়ে হেঁটে ভারতে যান। তবে কিছু ইপিআর সদস্য পুনরায় সংগঠিত হয়ে নায়েক সুবেদার আলী আকবরের (ইপিআর) নেতৃত্বে সাঁথিয়া থানার ডাববাগানে নগবাড়ী-বগুড়া রোডে পুনরায় শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। এখানেই সংঘটিত হয় ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ অর্থাৎ ডাববাগানের যুদ্ধ।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত