নবাবগঞ্জ থানা পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমন-২, ঢাকা
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার পর এপ্রিলের ২য় সপ্তাহের মধ্যে মাহতাব উদ্দিন খান, আতা উদ্দিন খান ও সিরাজ উদ্দিন আহম্মদের তত্ত্বাবধানে [ঢাকা] নবাবগঞ্জ থানা শান্তি কমিটি গঠন করা হয় এবং এপ্রিলের ৩য় সপ্তাহের মধ্যে ওই মাহতাব উদ্দিন খান, আতা উদ্দিন খান ও সিরাজ উদ্দিন আহম্মদের তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে ঢাকা থেকে ৩ প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্য নবাবগঞ্জ থানায় আসে এবং নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাদের ক্যাম্প গড়ে তোলার আনুসাঙ্গিক অবকাঠামো প্রস্তুত করে দেয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী নবাবগঞ্জ থানা এলাকায় আসার পথে বক্সনগর গ্রামের বেশ কিছু জেলে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও ১৩ জন জেলেকে হত্যা করে। এরা হলেন-সতিশ চন্দ্র, ক্ষেত্রমোহন, ননী গোপাল, গনেশ, ফটিক, লক্ষণ, ধীরেন্দ্র, সূর্য, পানু ও আর কয়েকজন এবং এর কয়েকদিন আগে স্থানীয় ন্যাপ নেতাদের সামনে আতা উদ্দিন খান বাঙালি আন্দোলনকারীদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।
নবাবগঞ্জ থানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের কয়েকজন পাকিস্তানি বাহিনীর ঐ ঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। এর আগে নবাবগঞ্জ থানায় পাকিস্তানি সৈন্য আনার পর মাহতাব উদ্দিন খান, আতা উদ্দিন খান ও সিরাজ উদ্দিন আহম্মদের তত্ত্বাবধানে ও মাওলানা আহম্মদ উল্লাহর নেতৃত্বে নবাবগন মাদ্রাসা ও সোনাহাজরা মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্য থেকে ২ প্লাটুন বা ৬৫ জনের একটি রাজাকার ও বদর বাহিনী গড়ে তোলে। এদের মধ্যে ২২ জন ছাত্রদকে জোরপূর্বক বদর বাহিনীতে নেওয়া হয়। এই সব রাজাকার ও বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের সংগে একই ক্যাম্পে অবস্থান করতো। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর এই ক্যাম্পে আক্রমণের চিন্তা থেকে নবাবগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মোহাম্মদ শাহজাহান দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর ঐ ২২ জন রাজাকার ও বদর বাহিনীর কয়েকজনের সংগে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। এরা ছিল মাসিক ৬০ টাকার বেতনভোগী। মুক্তিযোদ্ধারাও পরবর্তীতে এদের ৬০ টাকা করে বৃত্তি দিয়ে থাকতো। ফলে এই বিদ্রোহীদের নাম হয়েছিল বৃত্তিভোগী মুক্তি। যাই হোক পরবর্তীতে মোহাম্মদ শাহজাহান, আবদুল হামিদ খান মজলিস ও রাহাত আলীর পরিকল্পনা মোতাবেক সিদ্ধান্ত হয় ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় (তখন রোজার মাস চলছিল) পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে উক্ত ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকারে আনা হবে। এতে ওই যোগাযোগকারী রাজাকার ও বদর বাহিনী সহযোগিতা করবে এবং ২৭শে অক্টোবর এম.আর. খানের বাড়ি, কাউর নেতৃত্বস্থানীয় কমান্ডারগণ মিলিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বন্টন করে দেওয়া হয়।
আক্রমণের আগে পরিকল্পনা মোতাবেক ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের ৫টি দলে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি গ্রুপে ৭ থেকে ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নেওয়া হয়। অবশ্য মূল গ্রুপে ছিল ৫ অথবা ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা, যাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের দেয়াল টপকিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সৈন্যদের উপর গ্রেনেড চার্জ করা এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে ফায়ার বা আক্রমণ করা এবং তাদের সাথে পূর্বের যোগাযোগকারী রাজাকার ও বদরবাহিনী সদস্যরাও পাকিস্তানি বাহিনীর উপর গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ করবে। আর বাকি ৪টি গ্রুপ অবস্থান নেবে যথাক্রমে পূর্বদিকে যন্ত্রাইল গ্রামের নদীর পার। এখানে আগেই একটি নৌকার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। এই নৌকা করেই পরবর্তীতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে নেয়া হয়। একটি গ্রুপ উত্তরে কলেজের সামনে ও অন্য দলটি ক্যাম্পের দক্ষিণে নবাবগঞ্জ বাজার এলাকায়। এই তিনটি দলের দায়িত্ব ছিল এল.এম.জি ও অন্যান্য ভারি অস্ত্র দিয়ে ক্যাম্পের ভিতরে পৌছানো মুক্তিযোদ্ধাদের কভার দেওয়া এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভ্রান্ত করা যাতে কোনো দিক থেকে গুলি আসছে তা নির্ধারণ না করতে পারে এবং শেষ দলটির দায়িত্ব ছিল ক্যাম্পের দেয়ালের পাশাপাশি থাকার, যাতে তারাও তাদের অস্ত্র দিয়ে ভেতরে ঢোকা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতে পারে এবং প্রয়োজনে ঢুকতে পারে। ক্যাম্পের ভিতর এপ্রিল মাস থেকেই ৩ প্লাটুন বা ১০৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করতো কিন্ত গালিমপুর, কোমরগঞ্জ ও আগলার যুদ্ধে পরাজয়ের পর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আরো ৫ থেকে ৬ প্লাটুন এসে ঐ ক্যাম্পে অক্টোবরের প্রথম দিকে অবস্থান নেয়। তাতে পাকিস্তানি সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ শতের কাছাকাছি।
পরিকল্পনা মোতাবেক ২৮ অক্টোবর সব কিছু সুষ্টুভাবে এগিয়ে যায়, পাকিস্তানি সেন্ট্রীকে হত্যা করে দেয়ালের ভেতর ঢুকে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড মেরে আক্রমণ শুরু করে। কিন্ত পরিকল্পনা মোতাবেক সময়ের ১ মিনিটের হেরফেরের কারণে পাকিস্তানী কিছু সৈন্য তাদের ভারি অস্ত্র দিয়ে উল্টা গুলি চালাতে সক্ষম হয় এবং এতে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করানোর সুযোগও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীর ঐ ক্যাম্প অধিকার করা আর সম্ভব হয়নি। কিন্ত ২৩ জন বিদ্রোহী রাজাকারও বদর বাহিনীর সদস্যরা ১৯টি রাইফেল সহ বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়। এই আক্রমণে বেশ সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হত ও আহত হয়। পরিস্থিতির কারণে তা নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। পরের দিন তিনটি হেলিকপ্টার ঢাকা থেকে এসে ঐ সব হত ও আহতদের নিয়ে যায়। কিছু হতদের নবাবগঞ্জ খেলার মাঠে পুঁতে রাখে।
এই যুদ্ধে আবদুল মোতালেব নামে অসীম বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তার বাড়ি ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার কোনো গ্রামে। (আহত অবস্থায় ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাবার পথে সে নৌকায় রাতের মধ্যই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।) এবং তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।
এই গৌরবময় যুদ্ধে যে সব মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছেন তাদের সবার নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যেগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
আবদুল মতিন চৌধুরী, শওকত হোসেন আঙুর, মোহাম্মদ শাহজাহানের গ্রুপ, রাহাত আলী, রফিক, শাকিল, জালাল ও বাবন।
শহীদ আবদুল মোতালেব, শ্রীনগর। আনোয়ার হোসেন, কাশিমপুর। নজরুল, শ্রীনগর। হাফিজ, শ্রীনগর (সে এই যুদ্ধে আহত হয়)। দেওয়ান আবদুর রফিক, মহব্বতপুর। শাহজালাল, সিংহরা। ডাঃ আবুল কালামের গ্রুপ, নারিশা। হাবিবুর রহমান, সোনাপুর (সে এই যুদ্ধে আহত হয়) ও আরো অনেকে)।
[৬৯] হারুন-অর-রশীদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত