You dont have javascript enabled! Please enable it!

নকশী বিওপী যুদ্ধ, ময়মনসিংহ

নকশো বিওপির অবস্থান তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায়। এটি ঝিনাইগাতি থানার অন্তর্গত। বর্তমানে এ থানা নতুন শেরপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত। তৎকালীন মহকুমা সদর জামালপুর হতে এই অঞ্চলটির দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। সম্ভুগঞ্জ সড়ক সেতু নির্মাণের পূর্বে ঢাকা কিংবা ময়মনসিংহ হতে এ অঞ্চলে সড়কপথে যাতায়াত জামালপুরের মধ্যদিয়ে সহজতর ছিল। জামালপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতে ছিল ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা। তুরা রেঞ্জের গাঢ়ো পাহাড় অঞ্চলের দক্ষিণে নকশী অবস্থিত। এলাকাটি শালবন আচ্ছাদিত এবং সমতল ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু টিলা সম্বলিত। আশপাশের টিলার মাঝখানে নিচু ভূমিতে বিওপির অবস্থান। বিওপির চারদিকে বেশ কিছুটা জায়গা সমতল এবং ধান ক্ষেত। এই নিচু সমতল ভূমির উপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেকগুলো প্রাকৃতিক নালা। পাহাড়ি এলাকা থেকে সৃষ্ট এসব নালাতে বর্ষাকালে প্রবল স্রোতের সাথে পানি প্রবাহিত হয়। নকশী বিওপির চারপাশে নেওয়াকাচি, গান্দিগাঁও, হালজাতি, রাংটিয়া, নয়া রাংটিয়া প্রভৃতি গ্রামের অবস্থান। জামালপুর শেরপুর থেকে উত্তরগামী রাস্তা ঝিনাইগাতি হয়ে নকশী বিওপির সন্নিকটে সীমান্ত সড়কে মিশেছে। সীমান্ত সড়কটি কাঁচা। এ সড়ক পশ্চিমে সাতানীপাড়া বিওপি এবং পূর্বে হলদিগ্রাম বিওপির দিকে গিয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পাকবাহিনীর ৩৬ এডহক ডিভিশনের ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের উপর ন্যস্ত ছিল। ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার ছিল ঢাকা। মেজর জেনারেল জমশেদ খান ছিলনে এর জিওসি। ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কাদের খান নিয়াজী এবং সদর দফতর ছিল ময়মনসিংহে। ব্রিগেড গঠন ও অবস্থানগুলো হলো ঃ
৯৩ পদাতিক ব্রিগেড: বি.আ.কাদির খান নিয়াজী, হেড কোয়ার্টার: ময়মনসিংহ।
৮৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মর্টার ব্যাটারী: কামাওপুর-ময়মনসিংহ।
৩৩ পাঞ্জাব: ময়মনসিংহ, ফুলপুর, হালুয়াঘাট অঞ্চল,
৩১ বালুচ : জামালপুর, রাজেন্দ্রপুর, হাতিবান্দা, দেওয়ানগঞ্জ, টাঙ্গাইল অঞ্চল।
৭০ উইং রেঞ্জার্স : ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ অঞ্চল।
৭১ উইং রেঞ্জার্স: জারিয়া, ঝাঞ্জাইল, শিবগঞ্জ, বিরিশির অঞ্চল।
নকশী বিওপির অবস্থান ছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের অপারেশনাল এয়াকায়। ৩১ বালুচ এর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ছিল জামালপুরে। এর অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ। নকশী বিওপিতে নিয়মিত বাহিনীর একটি প্লাটুন সোইন্যের অবস্থান ছিল। এই মিশ্র বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন মেজর রিয়াজ। ব্যাটেলিয়ন ৩ ইঞ্চি মর্টার এই প্লাটুনের সাহায্যে নিয়োজিত ছিল। ঝিনাইগাতী-নকশী সড়কের সংযোগস্থল আহমেদ নগর ছিল পাক গোলান্দাজ বাহিনীর অবস্থান। নকশী এবং এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্ত এলাকা ছিল এ কামানের আওতাভুক্ত। জেড ফোরস গঠনের পর ব্রিগেডটি ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চলে প্রথম অপারেশনাল দায়িত্ব পালন করে। এই ব্রিগেডের অন্তর্গত ১ম বেঙ্গল কমালপুর বিওপি এবং ৩য় বেঙ্গল বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের দায়িত্ব লাভ করে। একই সময়ে ব্রিগেডটির অপর ব্যাটেলিয়ন ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের ওপর নকশী বিওপি আক্রমণ ও দখলের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ সময় ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন মেজর এ জে এম আমিনুল হক। উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী। এর অধীনে কোম্পানিগুলোর অধিনায়কগণ হলেন-এ কোম্পানি: ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, বি কোম্পানি: ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন, সি কোম্পানি: ক্যাপ্টেন মোদাচ্ছের হোসেন, ডি কোম্পানি : লেফটেন্যান্ট এমদাদুল হক, নকশী বিওপি আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয় ৩ ও ৪ আগস্টের মধ্যবর্তী রাত। আক্রমণের সময় ছিল ৪ আগস্ট ০৩৪৫ ঘন্টায়। আক্রমণ পরিচালনায় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রেভো ও ডেল্টা কোম্পানি এসল্ট কোম্পানি হিসেবে দায়িত্ব লাভ করে। এক প্লাটুন ইপিআর ও এক প্লাটুন মুজাহিদ কাট অফ পার্টির দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। কাট অফ পার্টির নির্ধারিত কাজ ছাড়াও একই গ্রুপের দায়িত্ব ছিল আক্রমণকারী বাহিনীকে কভারিং ফায়ার প্রদান এবং প্রয়োজনে রিজার্ভ হিসেবে কাজ করা। ফায়ার বেসের জনবলকে এইচ এমজি ও আর আর গ্রুপে ভাগ করা হয়। আর আর গ্রুপ ৭৫ মি.মি. আর আর সজ্জিত ছিল। এছাড়াও ছিল ব্যাটালিয়ন মর্টার গ্রুপ। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসেম্বলি এরিয়া থেকে আক্রমণকারী সৈন্যরা খুবই সুষ্টুভাবে এফইউপিতে পৌঁছায়। মাঝপথে নালা অতিক্রম করার সময়ও কোনো প্রকার শব্দ হয়নি। একই সময় কাট অফ পার্টির সদস্যরা রাংটিয়ার অবস্থান গ্রহণ করে। এফইউপি মার্কিং না করার কারণে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তবে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী ৮/১০ জন এফএফকে নিয়ে নিজে ফায়ারবেজ পজিশনে পৌঁছে দেন। উদ্দেশ্য কমান্ডারের নিজের উপস্থিতির দ্বারা সৈন্যদের মনে সাহস ও উদ্দীপনা সঞ্চার করা। রাত ১২টার সময় সমাবেশস্থল হালজাতি গ্রাম থেকে আক্রমণকারী মূল বাহিনীর যাত্রা শুরু করে। সকলেই রাত ৩-৩৫ মিনিটে বিন্যাস ভূমিতে অবস্থান গ্রহণ করে। ডানে ও বামে অবস্থান গ্রহণ করে যথাক্রমে ১২নং ও ৫নং প্লাটুন। একই সময়ে ইপিআর ও মুজাহিদ গ্রুপের এক প্লাটুন সম্ন্বয়ে গঠিত কাট অফ পার্টির রাংটিয়াতে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ ৩-৪৫ মিনিটে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করার সংকেত দেন। সংকেত দেয়ার সাথে সাথে আর্টিলারি গর্জে উঠে। একই সাথে গর্জে উঠে পাকিস্তানী বাহিনীর কামান ও মর্টার। একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়ার যথেষ্ট সাহসের কাজ ছিল, বিশেষ করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানির লোকদের জন্য। কারণ তাদের দুই কোম্পানির ২০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ সামরিক, ৮ জন ইপিআর, ২/৩ জন পুলিশ এবং বাকি সবাই সাত দিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত গ্রাম-বাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ। কামানের প্রচণ্ড আওয়াজে এফইউপিতে অবস্থানরত স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকেরা প্রায় মাটির সাথে মিশে যায়। এ প্রবণতা আরো বেড়ে যায় যখন নিজেদের আর্টিলারির ৩টি গোলা এফইউপিতে এসে পড়ে। এই ফায়ারে ৮/১০ জন নিজ সৈন্য হতাহত হয়। উক্ত প্লাটুনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং প্লাটুনের সদস্যরা আহতদের সেবা করার নাম করে এফইউপিতেই থেকে যেতে চেষ্টা করে। এই সময়ে মুক্তিবাহিনীর ফায়ারবেসে অবস্থানরত আর আর ইউনিট ও এমজি ইউনিটও বিওপির ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। এদিকে হালজাতি গ্রাম থেকে ইপিআর প্লাটুন দুটি শক্রকে ভাওতা দেয়ার জন্য গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং আক্রমণ ব্যূহ রচনা করে শক্রদের ঘাবড়িয়ে দেয়। এই সুযোগে আক্রমণকারী দল এক্সটেন্ডেন্ট লাইন ফরমেশন করে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে। আক্রমণকারী দল পাঁচশত গজ দূরে নালার কাছে অবস্থান নিয়ে তিনশ’ গজ দূরে শুক্র শিবিরে গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের সুযোগে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় সকল সৈন্যই নালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে মাথা নিচু করে অনুমানের ভিত্তিতে ফায়ার করতে থাকে। নায়েক সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর ৫নং ও ৬ নং প্লাটুন দুটির বিওপির গেটের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল। তারাও নালার ভেতর আড়াল করে নিয়ে মাথা নিচু করে ফায়ার করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সৈনিকদের উপর কমান্ড এবং কন্ট্রোল শিথিল হয়ে পড়ে। তাই শক্রশিবির নিকটবর্তী জেনেও ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদের জন্য চিৎকার করে কমান্ড দেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। চিৎকার করে এবং গাঁয়ে ধাক্কা দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে এগিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। তার বামে হাবিলদার নাসির অত্যন্ত সাহসিকতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ নিজেও নায়েক সিরাজকে নিয়ে ডানের বাংকারের দিকে অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা এসল্ট লাইন ফর্ম করে এবং ক্যাপ্টেন আমিন ‘চার্জ’ বলে আক্রমণের আদেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধারা ‘ইয়া আলী’ বলে সঙ্গীন উঁচু করে বিওপি আক্রমণের জন্য দৌড়াতে শুরু করে। এ সময় সুবেদার মুসলিম ‘নারায়ে তকবির’ বলে চিৎকার করে উঠলে মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চ কন্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ প্রত্যত্তরে রণভূমিকে প্রকম্পিত করে তোলে। মুক্তিবাহিনী যখন শক্র শিবিরের মাত্র ১০০ গজের মধ্যে পৌঁছে যায়। ঠিক তখনই শক্রর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারি শেল এসে তাদের উপর বিস্ফোরিত হয়। এতে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। এর মধ্যে হাবিলদার নাসিরও ছিল। এই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অধিনায়ক আমিন আহমেদের পায়ে শেলের একটি টুকরা আঘাত করে। আঘাতের গুরুত্ব বুঝে উঠার আগেই তিনি শক্র শিবিরের দিকে আরো ৫০ গজ এগিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এই ছত্রভঙ্গ অবস্থায়ও এগিয়ে যায় এবং পলায়নরত শক্র সৈন্যদের আঘাত করতে থাকে। পাকবাহিনীর পক্ষেও তখন হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। কেউ কেউ মাইন বিস্ফোরণে কেউবা গুলিতে হতাহত হচ্ছিল। এ সময় অনার্সের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম মাইনের আঘাতে শহীদ হন। শহীদদের নিয়ে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ আরো অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। ঠিক এ সময়ই বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্জি বিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তিনি পাকবাহিনীর এত কাছে ছিলেন যে, এক পাকসেনা তাকে বেয়নেট বিদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসে। অল্প বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা সালাম (অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র এবং এক সুবেদার মেজরের পুত্র) গুলি করে তাকে হত্যা করে। এদিকে পেছনে নালার মধ্যে মাথা নিচু করে যারা গুলিবর্ষণ করছিল তাদের গুলিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়। আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে গিয়েও ক্যাপ্টেন আমিন সামনে ধাবমান শক্র সৈন্যদের উপর গুলি চালাচ্ছিলেন। তার সাথে থাকা পার্সোনাল গার্ড হানিফকে (একজন বিহারী ছেলে) তিনি ডানদিকের বাংকার অবস্থানরত শক্র সৈন্যদের গুলি করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হতাহতের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা তখন অনেকাংশেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। হানিফ তখন বারবার অনুরোধ করছিল, ‘স্যার আব পিছে চলে যাইয়ে, ম্যায় কাভারিং দে রাহারু’। হানিফকে দদ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়ার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হানিফ শাহাদাতবরণ করেন। সাথে সাথে শক্রর গুলিতে ক্যাপ্টেন আমিনের পাশের মাটি উড়ে যায়। শক্র তাকে দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে তিনি সাইডরোল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বামদিক থেকে একটি ফুলি এসে তার ডান হাতের কনুইতে আঘাত করে। তার হাতের স্টেন ছিটকে পড়ে। তিনি ফিল্ড ড্রেসিং বের করতে চেষ্টা করাকালীন আবার তার দিকে এক ঝাঁক গুলি আসে এবং পাশের আইল উড়িয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন সেখানে থাকা সম্ভব নয়। চারদিকে তখন কেবল লাশ আর লাশ। মুক্তিবাহিনীর যে ৮/১০ জন সদস্য শক্রর বাংকারে ঢুকে পড়েছিল তারাও নিহত হয়। এর মধ্যে ছিল নায়কে সিরাজ ও পুলিশের নায়েক সুজা মিয়া। গুরুতর আহত অবস্থায় শক্রর আওতা থেকে বের হবার জন্য ক্যাপ্টেন আমিন সাইড রোল করতে করতে শালবনের দিকে অগ্রসর হন। এ সময়ই একটি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটে। পূর্বে উল্লেখিত অল্প বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা সালাম পঞ্চাশ গজ হেঁটে ফিরে গিয়েছিল। হঠাৎ সে আবার দৌড়ে এসে পড়ে থাকা একটি এলএমজি নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে শক্র বেষ্টনীর দিকে ছুটে যায়। শক্র তখন কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য মাটির দেয়ালের পিছনে একত্রিত হচ্ছিল। ‘ওরে তোরা আমার মা-বাপ সবাইকে মেরেছিস, আমি ছেড়ে দেব না?’ চিৎকার করতে করতে সালাম শক্র বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়ে। উল্লেখ্য, সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যাক্তি হলে আক্রমণে তাকে নেয়া হয়নি। সে চুপি চুপি পালিয়ে এসে এসেম্বলি এরিয়াতে আক্রমণকারী দলে যোগ দেয়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র তখন লাশে ভরে গেছে। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চলছিল দু’পক্ষে। ফায়ার বেসে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ঘন ঘন গর্জন করে পশ্চাদপসারণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাভার ফায়ার থেকে বাঁচবার জন্য ডানে অপেক্ষাকৃত নিচু ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে চলতে থাকেন। নালার কাছে পৌঁছে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কোনো রকমে তিনি নালা পার হয়ে কিছুটা স্বস্তিবোধ করেন। কিন্ত এ সময় আর এক ঝাঁক গুলি তার পায়ের কাছের মাটি উড়য়ে নিয়ে যায়। তিনি দেখতে পেলেন ১০/১২ জন শক্রসৈন্য তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারেন কর্দমাক্ত মাটিতে তার আসার চিহ্ন ও রক্তের দাগ অনুসরণ করে শক্ররা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ধানক্ষেতের আড়ালে আড়ালে প্রায় তিনশত গজ অগ্রসর হবার পর ধানক্ষেতে শেষ হয়ে যায়। এরপর ২০০ গজ খোলা মাঠ। মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে তখন কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। এফইউপি প্রহরায় যারা ছিল তারাও ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। তাঁর অনুমান শক্র তখন ৫০ গজের মধ্যে চলে এসেছে। তিনি কোনো রকমে নিজেকে টেনে নিয়ে কামানের গোলায় সৃষত একটি গর্তে আশ্রয় নেন। সাড়া শরীরে কাঁদা মেঘে হেলমেট মাথার নিচে দিয়ে তিনি শুয়ে পড়েন। বেলা তখন সকাল ৮-১০ মিনিট। নিজস্ব বাহিনীর অ্যাকশন তখন সম্পূর্ণ বন্ধ। ঠিক এমন সময় শালবন থেকে তিনি তার কমান্ডিং অফিসার মেজর এটিএম আমিনুল হকের গলা শুনতে পান; আমিন, আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করে। ক্যাপ্টেন আমিনের নিহত অথবা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ ব্রিগেড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল রহমান ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার আমিনুল হককে কিছু সৈন্য নিয়ে তাকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। সৈনিকদের বিপদের মুখে ক্যাপ্টেন আমিনের দিকে এগিয়ে আসতে ইতস্তত করছে দেখে মেজর আমিনুল হক নিজেই ক্রল করে অগ্রসর হন। হাবিলদার তাহেরও তাকে অনুসরণ করে। তারা ক্যাপ্টেন আমিনের পা ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। অপরদিকে পাকসেনারা তখন তাদের অবস্থান থেকে ২০/২৫ গজ দূরে। তারা একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে সামনে এগিয়ে আসছে। শালবন থেকে লেফট্যান্যান্ট সুদাচ্ছের তখন চিৎকার করে তাড়াতাড়ি সরে আসার কথা বলছেন। নিজ পক্ষের গাঁয়ে গুলি লাগার আশংকায় তিনি শক্রদের উপর গুলি চালাতে পারছিলেন না। তাই দুজন এলএমজি চালককে তাদের এলএমজি নিয়ে গাছের উপর উঠে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর এলএমজির গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। পাকিস্তানীরা তখন ক্যাপ্টেন আমিনের কাছাকাছি আসার আগেই মেশিনগানের গুলিতে তাদের ৬/৭ জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পথ প্রদর্শক মকবুল ও অন্য এক দালাল ধরা পড়ে। দুইজন পাক সৈন্য দৌড়ে পালায়। এই সময় শক্রর কামানের গোলা তাদের আশেপাশে পড়তে থাকে। মেজর আমিনুর হক ক্যাপ্টেন আমিনকে কাঁধে তুলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্ত পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে দুজনই নালাতে পড়ে যান। হাবিলদার তাহের তখন ক্যাপ্টেন আমিনকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে আসেন।
নকশী যুদ্ধে নিহতের সংখ্যাঃ নকশী বিওপি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ২৬ জন শহীদ অথবা নিখোঁজ হন। তারা হলেন- হাবিলদার নাসির উদ্দিন, সিপাহী মোহাম্মদ আলী, সিপাহী সিরাজুল হক, ল্যা. নায়েক আবুল কালাম, ল্যা. নায়েক মোঃ ইউসুফ মিয়া, সিপাহী মোঃ সুজা মিয়া, সিপাহী হুমায়ূন কবির, সিপাহী শামসুজ্জামান, সিপাহী আবদুস সাত্তার, সিপাহী ফয়েজ আহম্মদ, সিপাহী আবদুস সালাম, সিপাহী মোঃ হানিফ, এক্স ইপিআর সিপাহী আবদুস সালাম, সিপাহী সদর উদ্দিন, সিপাহী ফজলুল হক, সিপাহী আবদুস সামাদ, সিপাহী জামাল হোসেন, সিপাহী আবু ইসমাইল, নায়েক আবদুস সালাম, নায়েক সৈয়দ ফুল মিয়া, নায়েক সদর উদ্দিন, নায়েক হায়েত আলী, নায়কে আবদুল কুদ্দুস, রবিউল আলম, সিপাহী শাহজাহান আলী, সিপাহী মনসুর আলী। যুদ্ধে পাকিস্তানী পক্ষে হতাহতের কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। নকশী বিওপি যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য দিক হলো সহকর্মীদের প্রতি কর্তব্যবোধ। যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন আমিন আহ্মেদকে মেজর এ জে এম আমিনুল হক এবং হাবিলদার তাহের শক্রসৈন্যের অবস্থানের মাত্র ২০-২৫ গজ দূরে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সহকর্মীর প্রতি এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্তব্যবোধ ও পদক্ষেপ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে চিহ্নিত। পরিশেষে বলা যায় যে, নকশী বিওপি যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থানিক পরিবেশ মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও এই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। নকশী যুদ্ধের একটি দিক হলো- স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের দিয়ে দক্ষ, পেশাধারী পাকিস্তানী সৈনিকদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে সাফল্য অর্জন অনেকটা দুরূহ। এটা যুদ্ধের একটি শিক্ষনীয় বিষয়। তবে গোপনীয়তা বজার রেখে আকস্মিক গতিতে আক্রমণ করে অনেক যুদ্ধেই কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হয়েছে।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!