দৌলতখানা থানা দখল, ভোলা
দৌলতখানা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাগণ কতৃক দখলকৃত সর্বশেষ থানা। এই থানা দখলের পরই তারা একযোগে ভোলা শহরে মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু পাঁচ দিন পরের বাংলাবাজার ও সাত দিন পরের বোরহানুদ্দিন যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হওয়ার পর তাঁদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দৌলতখানা থানা দখলে নেতৃত্ব দেন এয়ার সার্জেন্ট ইব্রাহীম মিয়া। আর সহযোগী হিসেবে যে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তারা হলে স্থানীয় ই.পি. আর সদস্য মো. ফারুক বাচ্চু ও বড় ভাই আকবর আলী। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৩ অক্টোবর। জহুরুল ইসলাম খোসবু তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপত ছিলেন। তিনি বলেন-দৌলতখানা থানার হাজীপুর গ্রামের রায় বাড়িতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আসার পর এখানে নিয়মিত একশ যোদ্ধা অবস্থান করতো। এই ক্যাম্পে বসেই দৌলতখানা থানা দখলের পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের সাথে কন্ট্রাক্ট হয় যে, কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর তারা আত্মসমর্পণ করবে। কার্যত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাতভর ও দিনের বারটা পর্যন্ত সেরকম আত্মসমর্পণের কোনো নিদর্শন দেখা গেল না। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ করেই থানা দখলে আনতে হল। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো দলটি দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি দল পশ্চিম দিকের শিকদার বাড়িতে অবস্থান নেয়। অন্য দল অবস্থান নেয় থানার দক্ষিণ দিকে বাজারে, পুকুর পাড়ে ও মসজিদে। প্রথম ফায়ার ওপেন করা হয় রাত তিনটার দিকে। বর্তমানে বাজারের পশ্চিমে যেখানে হাসপাতালে এখানেই থানার কার্যক্রম চলতো। এর কারণ, ৭০ এর বন্যায় থানার টিনশেড ঘরটা উড়ে গিয়েছিল। আশ পাশে অন্য যে ছোট খাট ঘর ছিল সেগুলো ততটা সুরক্ষিত ও নিরাপদ ছিল না। হাসপাতাল ভবন তখনও আনডার কন্সট্রাকটেড। তবুও এখানেই ছিল পাক আরমি-পুলিশ ও রাজাকারদের মূল ক্যাম্প। তবে থানা দখলের দিন এখানে কোনো মিলিটারি ছিল না। ছিল কেবল পুলিশ ও রাজাকার। সারা রাত ধরে ফায়ার ও পাল্টা ফায়ার চলতে থাকলো। তাতে পুলিশের সারেন্ডারের নামগন্ধও দেখা গেল না। কাঞ্চন মিয়া থানার দিকে কয়টি গোলা নিক্ষেপ করলেন। উত্তরে পুলিশ রাজাকার তাদের দিকে গুলি চালালো। তাতেও কাজ হলো না। অতঃপর দিন ভর থেমে থেমে গুলি বিনিময় চলতে থাকলো। সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে চারদিকে থেকে আমজনতা এসে বাজার ভরে গেল। কিন্ত তাদের সকলেই ছিল নিরস্ত্র। লাঠি দিয়ে রাইফেলের প্রতিউত্তর দেয়া যায় না। বিকেল আনুমানিক তিনটার দিকে দারোগা হাবিবুর রহমান ও রাজাকার কমান্ডার সেরু থানা থেকে হাত উঁচিয়ে বেরিয়ে এল। এছাড়া তাঁদের উপায় ছিল না। কারণ, তাঁদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারা খানিকটা এগিয়ে আসতেই জনতা সেরুকে তখন পিটিয়ে মেরে ফেললো এছাড়া অন্য ৪-৫ জন রাজাকারকেও জনতার হাতে প্রাণ দিতে হল। স্থানীয় জাসদ নেতা মো. সিরাজ সিকদার এই যুদ্ধের একজন যোদ্ধা। তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধ চলেছে দুপুর বারটা পর্যন্ত। সকাল থেকে বার বার মাইকে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়া হলেও তারা স্বেচ্ছায় সারেন্ডার করেনি। সারেন্ডার করল তখনই যখন তাঁদের গোলা ফুরিয়ে গেল। দু-তিনজন পুলিশকেও লোকজন লাঠির আঘাতে মেরে ফেলে। তবে যারা বেঁচে যায় তারাও জনতার হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়। এই যুদ্ধের একমাত্র শহীদ ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ তালুকদার। এই যুদ্ধে একজন সরকারি কর্মকর্তা তৎকালীন সি.ও. আব্দুল হামিদ সাহেব প্রচুর সাহায্য করেন। এবং এর জন তাকে কঠিন মূল্য দিতে হয়। ক’দিন পর আর্মি এসে তাকে ও তার স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
[৩৭] কালাম ফয়েজী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত