ধর্মগড় অভিযান, হবিগঞ্জ
ধর্মগড় যুদ্ধের অবস্থানঃ মাধবপুর হবগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণের থানা। এর দক্ষিণে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। মাধবপুর থানার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আন্তর্জাতিক সীমানার ১.৫ কি.মি.-এর মধ্যে ধর্মগড় অবস্থিত। ধর্মগড়ের অংশটি ভারতের ভূখণ্ডে স্ফীত হয়ে ফানেল আকৃতির ধারণ করেছে। ধর্মগড় মাধবপুর থেকে ১৫ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে ও হরষপুর রেলওয়ে থেকে ৬ কি. মি. পূর্বে অবস্থিত। ধর্মগড়ের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সিদাই ক্যাম্প ছিল। তেলিয়াপাড়া থেকে একটি রাস্তা মনতলা হয়ে ধর্মগড়কে সংযুক্ত করেছে। ধর্মগড়ের পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের মধ্যে মোহনপুর, বিজয়নগর, মীরপুর বাজার, আহমেদপুর অন্যতম। যুদ্ধের পটভূমিঃ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ-এর নেতৃত্বে তখন সবেমাত্র ‘এস’ ফোরস সংগঠিত হয়েছে। এ সময়ে তাদেরকে দিয়ে ধর্মগড়-ইটাখোলা সড়ক মুক্ত করার কথা চিন্তা করা হয়। ধর্মগড় হচ্ছে পাকিস্তানীদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহ অনুযায়ী, এখানে একটি শক্তিশালী নিয়মিত প্লাটুন রয়েছে। এছাড়াও তাদেরকে অধিকতর জোরদার করার জন্য রয়েছে, আরও এক কোম্পানি রাজাকার। ১১ ইস্ট বেঙ্গল তখনো পূর্ণমাত্রায় গড়ে ওঠেনি। সৈনিকদেরকে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্যে অস্ত্রসজ্জিত করা হচ্ছে। আক্রমণ পরিচালনা সমর্থ এবং উপযোগী হচ্ছে একমাত্র ২ ইস্ট বেঙ্গল। ফোরস কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফুউল্লাহ তাদের প্রশিক্ষণ মান এবং কাজের ধরন বোঝার জন্যে একটি মহড়া অনুষ্টানের ব্যবস্থা করার কথা বিবেচনা করেন। ধর্মগড় বিওপি ঘিরে পাকিস্তানীরা একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। ধর্মগড় ছিল পাকিস্তানীদের একটি কৌশলগত অবস্থান। ধর্মগড় অবস্থানটি পাকিস্তানীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এই স্থানটি দখলে থাকলে হরষপুর এলাকায়, সিলেট-আখাউড়া রেলপথের নিরাপত্তা এবং ধর্মগড় এলাকায় স্ফীত অংশ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এছাড়াও ধর্মগড় এলাকার আন্তর্জাতিক সীমানার আশেপাশে মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। ধর্মগড় মুক্ত হলে ইটাখোলা-ধর্মগড় সড়ক মুক্তিবাহিনীর জন্য ব্যবহারযোগ্য হবে। সীমান্ত এলাকায় নিরাপদ চলাচলের জন্যও ধর্মগড় দখল মুক্তিবাহিনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সংগঠনঃ ধর্মগড়ে মোত দুইবার ক্যাপ্টেন আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। ধর্মগড়ের প্রথম আক্রমণে ২ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়ার নেতৃত্বে বি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। বি কোম্পানির আক্রমণ সমর্থনে, ডি কোম্পানির একাংশ একটি সাপোর্ট কোম্পানি তৈরি করা হয়। এ যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর গোলন্দাজ সমর্থন করে। ধর্মগড়ের দ্বিতীয় যুদ্ধে ২ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে ভারতের রাজপুত ব্যাটালিয়ন অংশগ্রহণ করে। ২৮ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত আক্রমণ পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণ করেন সুবেদ আলী তার প্লাটুন কমান্ডারদের নিয়ে। আক্রমণ করার পূর্বে সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। নির্ধারিত দিনের পূর্বদিন অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর সৈন্যরা বাসে চড়ে রাত দশটায় মনতলা থেকে মোহনপুরে পৌঁছায়। সীমান্তের কাছে মোহনপুর ছিল এসেমব্বি-এরিয়া বা সমাবেশস্থল, রাত প্রায় সাড়ে দশটায় এখান থেকে সৈন্যরা মার্চ করে। আক্রমণের পূর্বে একত্রিত হওয়ার জায়গার দিকে এগিয়ে যায়। দূরত্ব প্রায় দু’মাইল। তদারকির কাজে ‘এস’ ফোরস কমান্ডার নিজে সেখানে গমন করেন। তখন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী আক্রমণকারী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধকালীন পর্যায়ক্রমের ব্যাখ্যা করেন। লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের অগ্রবর্তী অবস্থানে ৪ নম্বর প্লাটুন রয়েছে। সিনিয়র জেসিও সুবেদার চান মিয়া তার সাথে রয়েছেন। এর পরে রয়েছে সুবেদার সফিউল্লাহর ৬ নম্বর প্লাটুন। তারপর রয়েছে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীর কোম্পানি। এর সাথে রয়েছে হেডকোয়ার্টার কোম্পানি। আর পেছনে ছিল সুবেদার তৈয়বের ৫ নম্বর প্লাটুন। এসেমবি-এরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করার সময় প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়। নির্ধারিত স্থান পর্যন্ত সবকিছু ভালো ছিল। কিন্ত তারপর হয় বিপত্তির সূত্রপাত। নেভিগেটরকে সামনে নিয়ে অগ্রবর্তী প্লাটুন সময়সূচি অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছিল না। কিন্তু নাইট নেভিগেশনের ক্রটির ফলে এটি মূল কলাম বা বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুবেদার শফিউল্লার প্লাটুন তা বুঝতে পেরে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীকে অবহিত করে। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী কলামকে থামিয়ে দিয়ে অগ্রবর্তী প্লাটুনের খোঁজে চারদিকে সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। কিন্ত প্লাটুনটির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্লাটুনটি ছাড়াই নির্ধারিত অভিযান অব্যাহত রাখার ব্যাপারে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান নিজেও বুঝতে পারে যে ওরা ভুল পথে এগিয়ে চলেছে। তাই সময়ের অপচয় না করে সে সমাবেশস্থলে প্রত্যাবর্তন করেন। এস ফোরস কমান্ডার তাকে তৎক্ষণাৎ তার কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বেতারযন্ত্রের সাহায্যে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীকে সে কথা জানিয়ে দেন। আক্রমণের সময় প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৫০০ গোলার সাপোর্ট দেওয়া কথা ছিল কিন্তু বৃষ্টির দরুন কামান বসে যাওয়াতে সেই সাহায্য পাওয়া গেল না। মাঝে মাঝে কামানের যে গোলা শক্রঘাঁটির ওপর গিয়ে পড়ছিল তা আক্রমণের জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। ওদিকে শক্রর গোলান্দাজ বাহিনীও বসে থাকল না, আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে চলে। ঐ মুষলধারায় বৃষ্টি আর কনকনে হিম হাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অবশেষে প্রতিকূল হাওয়া বিবেচনা করে ফোরস কমান্ডার আক্রমণ না করে যোদ্ধাদের ক্যাম্পে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। এভাবেই বৃষ্টি, শীত আর অন্ধকার রাত্রির জন্য ধর্মগড়ের প্রথম আক্রমণ পরিত্যাক্ত হয়। এ অভিযানের পরপরই পাকিস্তানীরা ঘাঁটিতে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে।
ঘাঁটিটি পুনরায় আক্রমণ করার চিন্তা করা হয়। প্রাপ্য তথ্য এবং নিজস্ব মূল্যায়নে বুঝতে পারা যায়, ঘাঁটি থেকে শক্রদেরকে হটিয়ে দিতে হলে একটি ব্যাটালিয়ন প্রয়োজন হবে। কিন্তু ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কমান্ডার বিষয়টি ভিন্নতর দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেন। তাদের ধারণা, সর্বাধিক দুইটি কোম্পানির সাহায্যেই এলাকাটি শক্রমুক্ত করা সম্ভবপর। সুতরাং ১৮ রাজপুত একই ধরনের পরিকল্পনাসহ দুই কোম্পানি সোইন্য নিয়ে বর্ণিত কার্যক্রম গ্রহণ করে। দ্বিতীয় আক্রমণের দিন হিসেবে ২৮ সেপ্টেম্বরকে ধার্য করা হয়। ২ ইস্ট বেঙ্গল দুইটি পূর্বনির্ধারিত স্থানে প্রতিবন্ধক স্থাপন করবে। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীকে ন্যস্ত করা হয় ভিন্নতর দায়িত্বে। তিনি বিজয়নগরের দিক থেকে লক্ষ্যস্থলের দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তানীর দৃষ্টি ভিন্নমুখী করে তোলার জন্য ভুয়া আক্রমণ পরিচালনা করবে। আক্রমণের সময় ভোর পাঁচটা। মূল অভিযান উত্তরে মীরপুর বাজার থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্যাপক গোলান্দাজ সহযোগিতার ব্যাপারেও নিশ্চয়তা দেয়া হয়। সময়সূচী অনুযায়ী সৈন্যরা যার যার অবস্থান নেয়। প্রি এইচ আওয়ার বা আক্রমণপূর্ব বোমাবর্ষণ শুরু হয়। একটি সময়ে পাকিস্তানীরা পাল্টা বোমাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী অগ্রবর্তী সেনাদলের সামনে স্থাপিত তিনটি ভারী মেশিনগানের গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে ১৮ রাজপুত রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি পাকিস্তানীদের অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মেশিনগানের সামনে রাজপুত ব্যাটালিয়নের অবস্থা নড়বড় হয়ে ওঠে। সকাল দশটা পর্যন্ত প্রচণ্ড হতাহত হওয়া সত্ত্বেও উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষাবদি আক্রমণ আরো এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে তা প্রত্যাহার করা হয়। ধর্মগড়ের এই যুদ্ধে ভারতীয়দের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ধর্মগড়ের এই যুদ্ধ সামরিক দিক থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা অবশ্যই বিশেষ একটি গুরুত্ব বহন করে। কেননা এটাই ছিল পূর্ব রণাঙ্গনের সম্ভবত বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণাত্মক অভিযান।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত