দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধ, জামালপুর
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে স্ফলতা সকল স্তরের সৈনিকদের মনোবল বহুগুন বাড়িয়ে তোলে। রেজিমেন্টর অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল কোম্পানি অধিনায়কের সাথে আলোচনা ক্রমে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তেলঢালা বেজ ক্যাম্পে ফেরত যাওয়ার পূর্বে আরো একটি অপারেশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই যুদ্ধ পরিকল্পনায় দেওয়ানগঞ্জ থানা শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীর ঘাঁটির উপর ৩১ জুলাই রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেওয়ানগঞ্জ ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার (বর্তমান জামালপুর জেলা) একটি থানা সদর ও গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন। ঢাকা-ময়মনসিংহ-জামালপুর রেললাইন জামালপুর হতে দেওয়ানগঞ্জ হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট স্টেশনে মিলেছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট দেওয়ানগঞ্জ থানারই অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে ফেরিঘাট। দেওয়ানগঞ্জ থেকে বাহাদুরবাদ ঘাটের দূরত্ব ২ কিলোমিটার। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মূল অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা তেলাঢালা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে থানা শহর দেওয়ানগঞ্জের অবস্থান। বাংলাদেশের অন্য একটি থানা শহর রৌমারী ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ। এই রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার ছিল জামালপুরে। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টে ছিল ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধীন। ব্রিগেড সদর দপ্তর ছিল ময়মনসিংহ জেলা শহরে। দেওয়ানগঞ্জ থানা শহরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্থায়ী কোনো ইউনিটের অবস্থান ছিল না। দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় নিয়মিত প্রতিরক্ষার জন্য পাকবাহিনীর নিয়োগপ্রাপ্ত ১ কোম্পানি রাজাকার থানা সদর এলাকায় মোতায়ন ছহিল। এছাড়াও রেলস্টেশন ও পাওয়ার হাউস এলাকার প্রহরার জন্য স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত ও অস্ত্রসজ্জিত বিহারিদের একটি দল ছিল। রাজাকার বাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল সারকিট হাউস এবং দেওয়ানগঞ্জ মাদ্রাসায়। পাকবাহিনীর একটি দল দিবা-রাত্র নিয়মিত ঠলের মাধ্যমে দেওয়ানগঞ্জ থানা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপন, জিলপাক চিনিকল, পাওয়ার হাউজ, রেলওয়ে ওয়ারকশপ প্রভৃতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত টহলের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ রক্ষার পেছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকবাহিনীর জামালপুরের অবস্থানরত বাতটালিয়ান সদর দপ্তর থেকে দেওয়ানগঞ্জ হয়ে বাহাদুরবাদ ঘাট এলাকায় অবস্থানরত কোম্পানির সাথে যগাযগ পথ উন্মুক্ত রাখা। একই সাথে ফুলছড়ি ঘাট ও বাহাদুরবাদ ঘাটের মধ্যকার ফেরি যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করা। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানঃ জেড ফোরসের অধীনস্থ ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট দেওয়ানগঞ্জ অপারেশন পরিচালনা করে। দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণের মূল্ল লক্ষ্য ছিল এখানে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে পযুরদস্ত করা। একই সঙ্গে পাকবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর মনোবল দুর্বল করে দেয়া। বাহাদুরবাদ ঘাট যুদ্ধের পর এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল হাতিবান্ধা ইউনিয়নের তারাটিয়া স্কুল এলাকায়। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শাফায়েত জামিল। এই যুদ্ধে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংগঠন ছিল এরূপঃ ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অধিনায়ক-মেজর শাফায়েত জামিল ‘এ’ কোম্পানি-ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন ‘ডি’ কোম্পানি- লে. এস আই এম নূরুন্নবী খান রেজিমেন্টের অধিনায়কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ ও ডি কোম্পানি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নাসির কোম্পানি নামক মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানির জনাব নাসির উদ্দিন এবং অন্যান্য স্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ দেওয়ানগঞ্জ অপারেশন পরিচালনার জন্য গাইড ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করে। দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণ পরিচালনার জন্য নির্ধারিত এ কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এবং ডি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান। দেওয়ানগঞ্জ অপারেশনের পূর্ব মুহূর্তে রেজিমেন্টের আক্রমণ পূর্ব সমাবেশস্থল হিসেবে দেওয়ানগঞ্জের নিকটবর্তী কাঠের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকাকে নির্দিষ্ট করা হয়। আক্রমণে আকস্মিকতা অর্জনের লক্ষ্যে স্থলপথ এড়িয়ে জলপথে আরভিতে পৌছানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়। স্থানীয় জনসাধারণ প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতেই আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সময় স্বল্পতার কারণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের রেকি চালানো সম্ভব হয়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ৮টায় ১৩ টি নৌকাযোগে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নদী পথে আরভির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এই নৌকাগুলো এফ এফ কমান্ডার নাসির উদ্দিন স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় জোগাড় করেছিলেন। ব্যাটালিয়ান সদর দপ্তর ও ডি কোম্পানি রাত ১১ ঘটিকায় কাঠের বিল, সবুজপুর, কালাকান্দা, নয়াগ্রাম, বালুগ্রাম হয়ে মদনের চরে পৌঁছে। অপরদিকে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে এ কোম্পানি বেশ কিছু আগে মাদারের চরে পৌঁছে যায়। এই মাদারের চরে উভয় কোম্পানি ও ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টারে মিলিত হওয়ার কথা ছিল। তখনো পর্যন্ত ব্যাটেলিয়ান সদর দপ্তর ও ডি কোম্পানি মাদারের চরে এসে পৌছায়নি। মদনের চর ও মাদারের চর এই এলাকার মাঝে দুরত্ব ছিল প্রায় দেড় মাইল। রাতের অন্ধকারে দু’দলের মাঝে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় ক্যাপ্টেন আনোয়ার মাদারের চরে ডি কোম্পানি ও সদর দপ্তরকে না পেয়ে এবং কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় নৌকা ঘুরিয়ে একই পথে ফেরত যেতে শুরু করে। এদিকে গন্তব্যস্থলে পৌছাতে দেরি হওয়ায় রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল একটি টহল দলকে অগ্রবর্তী বাহিনীর খোঁজ নিতে পাঠান। পথিমধ্যে ও কোম্পানির সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে। এই টহল দল এ কোম্পানিকে মদনের চর ব্যাটেলিয়ন সদর দপ্তরের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এই যোগাযোগ সম্পন্ন করতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। অবস্থান ও পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনা করে অধিনায়ক শাফায়েত জামিল ঐ রাতে আক্রমণ স্থগিত রেখে পরবর্তী রাতে দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এলাকার জনৈক দেলোয়ার হোসেন মুক্তিবাহিনীর জন্য দিন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। এই রাতে মদনের চরে আখ ক্ষেতে একটি অস্থায়ী হাইড আউট স্থাপন করা হয়। ১ আগস্ট ১৯৭১ রাত ৮ ঘটিকায় মদনের চর থেকে মুক্তিবাহিনী আরভি-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। নৌকাযোগে ২ ঘন্টা চলার পর রাত ১২ ঘটিকায় রেজিমেন্টের সকল সৈন্য একদিলা বটগাছ এলাকায় নির্দিষ্ট আরভিতে অবস্থান নেয়। পুরো ব্যাটেলিয়ানকে নৌকাযোগে গন্তব্যস্থলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন স্থানীয় এফ এফ কমান্ডার নাসির উদ্দিন। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় তার পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হয়েছিল। নির্দিষ্ট আরভিতে পৌঁছানোর পর পরিকল্পনা অনুযায়ী নায়েক সুবেদার আবদুল ওহাবের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন আরভিতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত হয়। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের অধিনায়কত্বে এ কোম্পানির অন্য প্লাটুন দুটি জিলপাক চিনিকল আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। একই সময়ে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বে ডি কোম্পানির ৩টি প্লাটুন দেওয়ানগঞ্জের পরিদর্শন বাংলো, বাজার, রেল স্টেশন, পাওয়ার হাউজ আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এই আক্রমণে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানে এ কোম্পানির প্লাটুন দুটির নেতৃত্বে ছিলেন নায়েক সুবেদার মুখলেছুর রহমান ও নায়কে সুবেদার মোহাম্মদ আলী। জিলপাক চিনিকলে উভয় প্লাটুন এক সাথে আক্রমণ চালায়। হঠাৎ অতিক্রমণে প্রতিপক্ষ থেকে বড় ধরনের কোনো বাঁধা আসেনি। জিলপাক চিনিকল এলাকায় পাহারারত রাজাকার এবং বিহারি সৈন্যরা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চিনিকল এলাকার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। মুক্তিবাহিনীর এই দলটি ২ আগস্টে আনুমানিক ভোর ৪ ঘটিকায় আরভিতে প্রত্যাবর্তন করে। অপরদিকে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বে ডি কোম্পানি তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলসমূহে একযোগে আক্রমণ চালায়। ডি কোম্পানির একটি প্লাটুন সুবেদার বোদির নেতৃত্বে থানা, পরিদর্শন বাংলো এবং বাজার এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করে। ডি কোম্পানির অন্য একটি প্লাটুন সুবেদার কর্ম আলীর নেতৃত্বে পাওয়ার হাউজ ও রেলস্টেশন আক্রমণ করে। এই এলাকায় নিয়োজিত রাজাকার এবং বিহারি সৈনিকরা প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। কিন্ত মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে তারা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই প্লাটুনের সদস্যগণ পাওয়ার হাউজের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ডি কোম্পানির অন্য প্লাটুনটি সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনা করে। মাদ্রাসায় অবস্থানরত রাজাকার সদস্যরা জোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ডি কোম্পানির সৈনিকরা দুর্বল স্থানসমূহ চিহ্নিত করে আক্রমণ জোরদার করলে প্রাথমিকভাবে ৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের ফলে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী রাজাকারদের মনোবল ভেঙে পড়ে এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। সফল এই আক্রমণ শেষে মুক্তিবাহিনীর সকলেই ভোর নাগাদ আরভিতে প্রত্যাবর্তন করে। এ সময় আকাশে পাকিস্তানী জঙ্গি বিমান ও হেলিকপ্টার দেখা যায়। একই সময় বাহাদুরবাদ ঘাটে গানবোট ও লঞ্চের মাধ্যমে পাকবাহিনী কতৃক প্রচুর সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে অবস্থান সুরক্ষিত করার সংবাদ আসে। সফল অপারেশন শেষে মুক্তিবাহিনীর সমগ্র দলটি কাঠের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসেম্বলি এরিয়াতে ফেরত আসে। অতঃপর স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ঘাঁটিতে রেখে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলঢালাস্থ বেজ ক্যাম্পে ফিরে যায়। দেওয়ানগঞ্জযুদ্ধটিকে সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনীর একটি সফল যুদ্ধ অভিযান হিসেবে অভিহিত করা যায়। যুদ্ধ পরিকল্পনায় গৃহীত সকল লক্ষ্য এই অভিযানে অর্জিত হয়। যুদ্ধ পরিকল্পনার সামগ্রিক বাস্তবায়নের দিক থেকে দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধ একটি অনন্য সাধারণ ঘতনা। দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণঃ মেজর শাফায়েত জামিল, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খান, নায়েক সুবেদার ওয়াহাব, নায়েক সুবেদার মুখলেছুর রহমান, নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ আলী, সুবেদার হাফিজ, সুবেদার বোদি, সুবেদার করম আলী, সুবেদার আলী আকবর, সুবেদার আলী নেওয়াজ, এফএফ কমান্ডার নাসির উদ্দিন। [সংক্ষিপ্তায়ন]
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত