You dont have javascript enabled! Please enable it!

দুর্গাপুর হাইস্কুলে রাজাকার ও মিলিশিয়া ক্যাম্প অপারেশন, চট্টগ্রাম

মিরসরাই থানার মস্তাননগর হাসপাতালের সামান্য দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের উপর অবস্থিত দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ অফিস এবং ঠাকুরদিঘি বাজার থেকে একটি কাঁচা (বর্তমানে পাকা) রাস্তা সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরে দুই থেকে আড়াই মাইল পশ্চিমে রাস্তার ঠিক উত্তর পার্শ্বে দুর্গাপুর হাইস্কুল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার ও মিলিশিয়ারা এই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এর পশ্চিমে একটি নালা উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহমান। সারাবছর অল্প পানির এই নালাটির প্রস্থ ১০ থেকে ১২ ফুট। জুলাই-আগস্ট মাস। মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার নিজাম সোর্সের মাধ্যমে প্রায়ই খবর পেতেন যে, রাজাকার ও মিলিশিয়ারা এই ক্যাম্প থেকে প্রায়ই দিনেরবেলায় আশেপাশের বাজার ও গ্রামে গিয়ে দোকানি ও জনগণের কাছ থেকে জোরপূর্বক এবং মূল্য পরিশোধ না করে নানারকম জিনিসপত্র নিয়ে আসে। এছাড়া তারা দোকানও লুটপাট করত। তারা গ্রামে সোমত্ত মেয়ে পেলেই ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যেত। কমান্ডার নিজাম গ্রামের জনগণকে রাজাকার-মিলিশিয়াদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য এই হানাদার ক্যাম্প উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বেসক্যাম্প মাতব্বরহাট (যেখানে বাজার, মাদ্রাসা ও সাইক্লোন সেন্তার আছে) থেকে রাজাকার-মিলিশিয়াদের ক্যাম্পটি কাছে (মাত্র আড়াই মাইল দূরে) হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সে ক্যাম্পে থাকা বিপজ্জনক ছিল। নিজেদেরকেও তাদের কাছ থেকে রক্ষা প্রয়োজনীয় বলে তিনি বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। অপারেশনে যাওয়ার আগে কমান্ডার নিজাম তাঁর প্রনীত পরিকল্পনার আওতায় দলের সকল সহকর্মীকে তিন গ্রুপে বিভক্ত করেন। গ্রুপ অনুযায়ী সকলকে তাঁদের অবস্থান এবং করণীয় সম্পর্কে বিশদভাবে ব্রিফ করেন। কমান্ডার নিজাম, এলাকার অন্য একটি গ্রুপের কমান্ডার মুসাসহ নিজের গ্রুপের সহকর্মী ফরিদ (এই যুদ্ধে শহীদ), কাজল, বেলায়েত, আবু সালেহ, আবুল খায়ের, ফখরুল ইসলাম প্রমুখ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই অপারেশনে অংশ নেন। কমান্ডার নিজামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের জন্য তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্র (বেসক্যাম্প) কবির মিয়ার বাড়ি থেকে আনুমানিক রাত দুইটার রওয়ানা দিয়ে আধঘন্টার মধ্যে অপারেশন স্থানে পৌছেন। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ হাইস্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, একটি গ্রুপ হাইস্কুলের পশ্চিম খালের খালের পশ্চিমপাড়ে এবং অন্য গ্রুপটি হাইস্কুলের উত্তরে অবস্থান নেয়। বেস ক্যাম্প থেকে আসার সময় হাইস্কুল থেকে ১০০ গজ দূরে থাকতেই পথিমধ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় বিচ্ছিন্নকারী দল বা কার্ট অব পার্টি রাখা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাক্তিগত অস্ত্র ছাড়াও হাইস্কুলের উত্তর অবস্থান নেওয়া গ্রুপটির কাছে একটি রকেটলাঞ্চার এবং খালের পাড়ে ও পুকুরের কোণায় অবস্থানরত গ্রুপগুলোতে একটি করে এলএমজি দেয়া হয়। স্কুলঘরটি ইটের দেওয়াল ও টিনের ছাদ থাকায় উত্তরদিক থেকে রকেটলাঞ্চারের গোলা ছুঁড়ে দেয়াল ছিদ্র করে মিলিশিয়া-রাজাকারদের হত্যা করা সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক হবে বলে ধরা হয়। গ্রুপগুলো নিজ স্থানগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করার পর কমান্ডার নিজাম দুবার গ্রুপগুলোর অবস্থান পরিদর্শন করেন। প্রথমবার তিনি সংকেত মোতাবেক ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দেন। তিনি নিজ অবস্থানে এসে সিগন্যাল পিস্তলটির মাধ্যমে ফায়ারের নির্দেশ প্রদান করেন। সব গ্রুপ থেকে ফায়ার চলতে থাকে। কিন্ত দেখা গেল যে রকেট লাঞ্চারের কোনো শব্দ নেই। তাই কমান্ডার নিজাম রকেটলঞ্চারের অবস্থানে গিয়ে দেখেন যে এটির যন্ত্রাংশ কাজ করছে না। ইতোমধ্যে রাজাকার-মিলিশিয়ারা ভয় পেয়ে চিৎকার করে হাইস্কুলের পূর্বদিকে চলে যায়। রকেট লঞ্চারটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হাইস্কুলের দেয়াল ছিদ্র করা সম্ভব হবে না এবং অনবরত ফায়ারের কারণে গোলাবারুদ কমে আসার আশঙ্কায় এক পর্যায়ে কমান্ডার নিজামের আদেশে ফায়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই খালের পাড়ের গ্রুপের সাথে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ অতি উৎসাহী হয়ে “জয়বাংলা” ধ্বনি দিয়ে স্কুলের ভেতরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। এমনসময় ক্রসফায়ারে পড়ে তিনি স্কুলের মাঠে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং পড়ে মারা যান। কিন্ত এ ব্যাপারটি কমান্ডার নিজামসহ কোনো মুক্তিযোদ্ধারই গোচরীভূত হয়নি। ফায়ার বন্ধ করার পর পশ্চাদপসরণের সিগন্যাল দেয়া হলে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পেছনে চলে এসে পূর্বনির্ধারিত স্থানে মিলিত হন। দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ নেই। তখন মসজিদে ফজরের আযান দেওয়া হচ্ছে। আকাশ আলোকিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় কমান্ডার নিজাম তাঁর সহযোগী কমান্ডার মুসা এবং মুক্তিযোদ্ধা হারুন ও বেলায়তকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদকে খুঁজে বের করার জন্য ঘটনাস্থলে থেকে অন্যান্য সহযোদ্ধাকে বেসক্যাম্পে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। তাঁরা খবর পান যে, মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ স্কুলের মাঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। ইতোমধ্যে পালিয়ে যাওয়া রাজাকার-মিলিশিয়ারা Reinforcement করে স্কুলে ফেরত আসে আনুমানিক সকাল ৭টায়। এসে মাঠে স্টেনগানসহ ফরিদের লাশ দেখে আনন্দ-উল্লাস করে। তারা একটি গরুরগাড়ি যোগাড় করে এর পেছনে রশি দিয়ে ফরিদের লাশ বেঁধে রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে-হিচড়ে সেখানে থেকে চার মাইল দূরের মিরসরাই থানায় নিয়ে যায়। পড়ে বিকেলের দিকে জনগণ এসে থানা থেকে লাশ নিয়ে থানাসংলগ্ন পুকুরের পাড়ে ফরিদকে সমাহিত করে। উল্লেখ্য, এই অপারেশনের পর রাজাকার-মিলিশিয়ারা দুর্গাপুর হাইস্কুল থেকে তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!