You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.19 | দেওপাড়ার যুদ্ধ, টাঙ্গাইল - সংগ্রামের নোটবুক

দেওপাড়ার যুদ্ধ, টাঙ্গাইল

মুক্তাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী যেসব প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুলে পাকিস্তানীরা তাঁদের দোসর ও রাজাকারদের মাধ্যমে তার কিছু কিছু খবর পায় এবং একে একে সেসব ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনাও তারা করে। তাদের প্রথম নজর পড়ে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানাধীন দেওপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটির উপর। ১৯ জুলাই ভোর রাতে শক্ররা মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঘাঁটি আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসে। দেওপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটির কমান্ডার লোকমান হোসেন একজন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। তার সহকারী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নজির আহমদ পিন্টু। সম্ভাব্য হামলার মুখে কী কর্তব্য, লোকমান তা ভালোভাবেই জানত। শক্রদের অগগতির সংবাদ পেয়ে সে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে প্রায় ৩ কি.মি. পথ এগিয়ে শক্রদের অগ্নিসম্বর্ধনা জানাতে তৈরি হয়। রাস্তার পাশে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে সে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আত্মগোপন করে। অল্পক্ষণ পরে শক্রদের সাড়া পাওয়া যায়। প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে শক্রুরা অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসে। দেখা যায় শক্ররা দেওপাড়ার দিকে আসছে। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রের পাল্লার মধ্যে ওরা এসে পড়তেই লোকমান গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় অমনি মুক্তিসেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো একযোগে গর্জে ওঠে। শক্ররা এই অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৭ জন পাকিস্তানী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। দুই পক্ষের গুলি বিনিময় চলে সারাদিন ধরে। এর মধ্যে কভারিং ফায়ার করে শক্রদের লাশগুলো তারা সরিয়ে নিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী সেদিনের জন্য শক্রদের আক্রমণ সাফল্যজনকভাবে প্রতিহত করে পরবর্তী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। রাত নিরবতায় কেটে যায়। কিন্তু ভোর হতেই শক্ররা আক্রমণের নতুন নীতি অবলম্বন করে। তারা বেরিয়ে এসে সামনাসামনি আক্রমণ না করে প্রথমে তাঁদের কালিহাতি ঘাঁটি থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ১২০ মি.মি. মর্টারের গোলায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। শক্রদের শেল ও গোলাবর্ষণের মুখে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্কার মধ্যে অবিচল থেকে শক্রদের এগিয়ে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। পাকিস্তানীরা মর্টার ও মেশিনগানের গুলি ছূরে এগিয়ে আসছে দেখে হাকিম আলী একটা ছোট দল নিয়ে অগ্রবর্তী এলাকায় গিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শক্রর অগ্রগতি বিশৃংখল করে দেয়। শক্ররা দ্রুত সংগঠিত হয়। তাঁদের আক্রমণ ক্রমেই প্রবলতর হয়। এদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে সর্বাধুনিক অস্ত্রের অভাব। চীনা এলএমজির গুলিরও মাত্র দুটি চেইন অবশিষ্ট। প্রতি চেইনে ৮৫ টি গুলি আছে। আর বাদবাকি সম্বল ৩০৩ রাইফেল। এই হাতিয়ার সম্বল করে সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে কতক্ষণ প্রতিরোধ সংগ্রাম চালানো যায়। তবুও ওদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে। এই ছিল প্রতিটি মিক্তিযোদ্ধার সংকল্প। শক্রদের গোলা এসে পড়ছে মুক্তিবাহিনীর বাঙ্কারের আশেপাশে। মুক্তিযোদ্ধারা অবিচল। যতক্ষণ না অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে কেউ বাঙ্কার ছেড়ে যাবে না। ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে প্রত্যেকটি তরুণ অপেক্ষা করে। এমন সময় শক্রদেরেকটা গোলা অধিনায়ক লোকমানের সামনে এসে পড়ে। এই গোলার আঘাতে বাঙ্কারের উপরে রাখা তার রাইফেলের কাঠের বাঁট ভেঙ্গে উড়ে যায়। আর গোলার আলোড়নে তার বাঙ্কারের মাটির ধ্বস নেমে তাকে প্রায় অর্ধ সমাহিত করে ফেলে। আক্রমণের তীব্রতা বাড়ছে দেখে অধিনায়ক লোকমান আর সময় ক্ষয় না করে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটার নির্দেশ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙ্কার ছেড়ে পিছু হটে যায়। শক্ররা দেওপাড়ায় ঢুকবার জন্য মর্টারের বহু গোলাবর্ষণ করে। তারা এই অঞ্চলে এত অধিক গোলা এর আগে আর বর্ষণ করেনি। এজন্য স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা আতঙ্কও দেখা দেয়। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যায় সত্যি, হুঁশিয়ার করে দেয় চেইনের ৮৫ টি গুলিই শক্র লক্ষ্য ভেদ করা চাই। নেতার আদর্শে শিরোধার্য করে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা রফিক দুশমনের অপেক্ষায় বসে থাকে। অল্পকাল পরেই শক্ররা রাস্তার দুই ধারে গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসে। যে মুহূর্তে তারা রফিকের নিশানার মধ্যে এসেছে অমনি সে তার হাতের এলএমজির ট্রিগার চেপে ধরে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ৮৫টি গুলিই শক্রদের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। প্রায় চব্বিশজন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই মৃত্যবরণ করে। শক্রদের বাকি অংশের পাল্টা হামলার আগেই রফিক নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে যায়। শক্ররা এতেও রণে ভঙ্গ দিল না। নতুন করে তারা প্রচণ্ড রকমের আক্রমণ করে। সারা রাত ধরে তারা দেওপাড়া গ্রামের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরের দিন ভোরবেলায় শক্ররা দেওপাড়া গ্রামের নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন চালায়। এই যুদ্ধে আনুমানিক ৩১ জন পাকিস্তানী নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। হতাহত শক্রর নিকট থেকে অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত