You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.17 | দিগারকান্দা নারী প্রতিরাধে, ময়মনসিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

দিগারকান্দা নারী প্রতিরাধে, ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন দিগারকান্দা গ্রাম ১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষভাগে ময়মনসিংহ শহরের পতন হলে পাক সেনাদের আগমন ঘটে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অস্থায়ী ক্যাম্প করে পাক সেনারা। সেনাদের উপস্থিতিতে গ্রামের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। মা বানেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত গ্রামবাসী। তখন সারাদেশে খানসানোরা সুযাগে পেলে ইজ্জত লুটছে মেয়েদের । নিঘুম রাত কাটে দিগারকান্দার মানুষের । এই বুঝি বুটের আওয়াজ শানো যায়। সংঘবদ্ধ হতে থাকে গ্রামবাসী । ইতামেধ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকায় কয়েকবার হানা দিয়েছে পাক সেনারা। যে কোন মুহূর্তে আসতে পারে দিগারকান্দায়ও। গ্রামবাসী। গঠন করে নৈশ প্রহরীর দল ।
১৭ জুন। শুক্রবার । জুম্মার নামায শেষে আল্লাহ পাকের দরবারে শান্তি কামনা করে সর্ব¯রের মানুষ, প্রার্থনা জানায় গাফুরুর রাহিমের কাছে। স্থানীয় মসজিদ থেকে পরম প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফেরে সবাই। হয়ত শান্তি আসবে এ আশা তাদের। পাক সেনারাওতো মুসলমান। পবিত্র ইসলাম ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য হলেও হয়তো আর কোন মুসলমানকে হত্যা করবেন ওরা, মেয়েদের দিকে নজর দেবে না। কিন্তু বিধি বাম। গ্রামবাসী সন্ধ্যায় খবর পায় পাক সেনারা রাতে যে কোন সময় দিগরকান্দায় হানা দিতে পারে। জাগাে বাঙালি জাগাে চিত্তারে গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়। পাহারা বসায় সন্ধ্যা থেকে। চারদিকে শম্মানের নিরবতা। গ্রামের লাকেজন শলাপরামর্শ করে ঢুপি নামের এক গ্রামবাসীর ঘরে লুকিয়ে রাখে মা বানেদের । যুবতী মেয়ে, কুলবধূ, কিশারেীরা জড়াজড়ি করে পড়ে। থাকে একটি মাত্র ঘরে । অন্ধকারের মাঝে গ্রামে পাহারা দিয়ে চলেছে ইয়াকুব আলী, কাবিল, কুদ্দুছ, জুলু, আলাল, ছালাম, আমু, কাশেম, লতিফসহ অনেকে। হাতে বাঁশের লাঠি, কারো হাতে বল্লাম, দা ও অন্যান্য দেশী অস্ত্র । চুপি চুপি গ্রামের কিনারায় বসে আছে ওরা ।
রাত সাড়ে বারাটো। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাল্টে ফার্ম থেকে যে রাস্তাটি দিগরকান্দায় এসেছে হঠাৎ সবার চোখ পড়ে সেদিকে। রাস্তা ধরে টর্চের আলায়ে কারা যেন এগিয়ে আসছে। গ্রামের প্রহরীদের বুঝতে বাকি থাকে না ওরা কারা । মাঝে মাঝে টর্চের আলােেত খান সেনাদের অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। প্রহরীরা হতবাক । নিরস্ত্র প্রহরীদের প্রতিরাধে চিন্তা মৃত্যুর সামিল। পরিস্থিতি দেখে প্রহরী দল গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে । গ্রামবাসী আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পারে। তাদের মধ্যে কয়েকজন টুপির ঘরের সামনে পাহারায় থাকে। এত রাতে গ্রামে ঢাকোর উদ্দেশ্য পরিষ্কার। মা বানেরা মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। সশস্ত্র পাক সেনারা বিনা বাধায় গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাড়ি বাড়ি হানা দেয়। তারা মেয়েদের খুঁজতে থাকে। মেয়েদের না পেয়ে হন্যে হয়ে ওঠে ওরা। এক সময় কয়েকজন পাক সেনা টুপির বাড়ির সামনে চলে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রহরারত গ্রামবাসী অনতিদূরে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু খান সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যায় প্রহরীদের একজন। অত্যাচার চলে তার ওপর । নির্মমভাবে পেটাতে থাকে হানাদাররা। ছেলের ওপর অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি তার মা । আর্তচিৎকারে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে টুপির ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন মা। অন্যান্য মেয়েদের সাথে তিনিও আশ্রয় নিয়েছিলেন টুপির ঘরে। নির্যাতিত সন্তানকে বাঁচাতে খান সেনাদের নিকট কাকুতি মিনতি করে চলেন। মমতাময়ী মায়ের আহাজারী হঠাৎ থেমে যায় খান সেনাদের বেয়নেটের আঘাতে ।
এ দৃশ্য গ্রামবাসীদের দেহ ও মনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাক সেনাদের উপর। প্রতিশাধে নিতে তারা প্রস্তুত। প্রয়াজেনে শহীদ হবে গ্রামের প্রতিটি মানুষ । তবুও গ্রামবাসীরা পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ অবসান কামনা করে। তারা ভাবে হয়ত পাক সেনারা ফিরে যাবে তাদের ক্যাম্পে । কিন্তু তাদের প্রত্যাশা হতাশায় রূপ নেয়। সেনারা মেয়েদের ঘরে ঢুকে পড়ে । গ্রামবাসীরা তখনও নিশ্রুপ । কি করবে ভেবে। দিশেহারা। আসলে তাৎক্ষণিক প্রতিরাধে ও আক্রমণ কৌশল নির্ধারণে ব্যর্থ হয়। সাধারণ গ্রামবাসী। পুরুষদের নির্লিপ্ততা ঘরে আশ্রয় নেয়া মেয়েদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আত্মরক্ষার্থে নিজেরাই প্রতিরাধে গড়ে তােেল। সম্রম বাঁচাতে যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে খান সানোদের ওপর । বটি, কাস্তে, ঝাটা, পিড়ি, খুন্তি ইত্যাদি নিয়ে তারা খান সেনাদেরকে প্রবলভাবে আক্রমণ করে বসে।। পাক সেনারা মেয়েদের কাছ থেকে এরূপ প্রতিরাধে প্রত্যাশা করেনি। ওদের প্রত্যাশা ছিল মেয়েরা চুপ চাপ নির্যাতন সহ্য করে যাবে। হতবাক খান সেনারা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহবল হয়ে পড়ে। প্রতি আক্রমণের পূর্বেই মেয়েরা চিৎকার করতে করতে দিগুণ শক্তি নিয়ে খান সেনাদেরকে আঘাত করতে থাকে।
মেয়েদের এই দুঃসাহসী প্রতিরাধে গ্রামের শঙ্কিত পুরুষদেরকে বহুগুণে উজ্জীবীত করে। তারা কালবিলম্ব না করে রাম দা, বাম, লাঠি, টোটা ইত্যাদি নিয়ে খান সানোদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের অপ্রতিরাধ্যে আক্রমণের মুখে জীবন নিয়ে পালাতে থাকে পাক সেনারা। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা চিৎকার দিতে দিতে ধাওয়া করে শত্রু সেনাদেরকে । এ সময় গ্রামবাসীরা একজন শত্রু সেনাকে ধরে ফেলে। ধৃত পাক সেনা মেয়েদের লাঠিপেটায় জীবন হারায়। অন্যরা গুলি করতে করতে পালাতে থাকে। টুপির বাড়ির পাশের পুকুর পাড় দিয়ে পলায়নরত এক পাক সেনাকে গ্রামের কৃষক রহমত আলী বল্লম নিয়ে আক্রমণ করে। শত্রু সেনার বুক। লক্ষ্য করে বল্লাম চালায় সে। খান সেনাও রহমত আলীকে লক্ষ্য করে গুলি করে । রহমত আলী মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। দেশপ্রেমিক কৃষক রহমত আলীর রক্তে ভিজে যায় দিগরকান্দা গ্রামের মাটি। পরাজিত খান সেনারা তাদের মৃত সেনার লাশ ফেলে পালিয়ে যায় নিজেদের ক্যাম্পে । পাক সেনাদের সাথে সংঘর্ষে আহত হয় নাজিমুদ্দিন ও আজমত আলী।
দিগরকান্দা গ্রামে সেদিনের দুঃসাহসী প্রতিরাধে সংঘর্ষে মা-বানেরা যে সাহস দেখিয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভিন্ন মাত্রা যাগে করে। তাদের প্রতিরােেধর সূত্র ধরে পুরুষেরা এগিয়ে আসে এবং গ্রাম থেকে শত্রু সেনাদেরকে বিতাড়িত করে।
]৬] আব্দুল আজিজ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত