You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.21 | দিগারাইল টিলা অপারেশন, সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

দিগারাইল টিলা অপারেশন, সিলেট
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

জৈন্তাপুর থানা থেকে প্রায় ৪ মাইল দক্ষিণে পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সারিনদীর কাছে দিগারাইল টিলা অবস্থিত । টিলাটির উচ্চতা প্রায় ৭৫ থেকে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬০০ ফুট ও প্রস্থে ১৫০ থেকে ২০০ ফুট এবং এই টিলার পাশেই টুপিটিলা যার উচ্চতা প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট । এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ টিলা যা জৈন্তাপুর ও লালখাল এলাকার প্রতিরক্ষার দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাক বাহিনীর ১ প্লাটুন নিয়মিত সৈন্য, ২ প্লাটুন সিএএফ ও রাজাকার এবং আর্টিলারি সাপোর্টসহ এই টিলা সারিঘাট এবং দরবস্ত পৌছার প্রধান প্রতিবন্ধক। হিসেবে কাজ করে। টিলাটির প্রায় তিন দিকেই পাক আর্মি স্থল মাইন দ্বারা পরিবেষ্টিত করে রাখে, তাই এটা অনেকটা দুর্ভেদ্য অবস্থায় থেকে যায় । দিগারাইল । গ্রামের সকল অধিবাসী পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের দোসরদের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে দূরদূরান্তে চলে যায়। পাক আর্মির সকল বাংকার যথেষ্ট সুরক্ষিত করে তৈরি করা ছিল, তাই সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া এই নিয়মিত প্লাটুন যা ৩১ পাঞ্জাবের সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত। ছিল, দখল করা অসম্ভব ছিল। ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনীর কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। দিনই এই টিলা দখলের পরিকল্পনা করা হয়। ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ও আমার নেতৃত্বে আমার কোম্পানির একটি প্লাটুন আক্রমণের জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত হই । সেই অনুযায়ী সেদিন রাতে আমরা মুক্তাপুর থেকে দিগারাইলের পার্শ্ববর্তী বাইরাখেল গ্রামে রাত প্রায় ১২টায় পৌছি । আমাদের সামনেই দিগারাইল টিলা, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। পরিকল্পনা মাফিক আমরা নিঃশব্দ আক্রমণে যাব। যতক্ষণ পর্যন্ত পারা যায়। টিলা বেয়ে উপরে উঠতে হবে। শুধু বাড়তি সুবিধা আমাদের গাইড অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও এলাকার খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। শুখা কোম্পানি কমান্ডার মেজর শামভায়া, ক্যাপ্টেন জান্ডে, আর্টিলারি ক্যাপ্টেন সিং যিনি এফওও (ঋড়ৎধিৎফ ড়নংবৎাধঃরড়হ ড়ভভরপবৎ) আমাদের কোম্পানি ও প্লাটুনসহ পাহাড়ের পাদদেশে গেলাম । ধান ক্ষেত ও গ্রামের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে একটি কোম্পানিসহ আমার দল অতিক্রম করার সময় সামান্যতম শব্দও হয়নি। আমাদের গাইড আশ্বস্ত করলো যে, মাইন ফিল্ড বাঁচিয়ে আমরা জঙ্গলের রাস্তায় টিলায় উঠব ।। অতি সন্তর্পণে প্রায় তিন ঘণ্টার মধ্যে আমরা টিলার উপর উঠে গেলাম । দুই একবার পা ফস্কে আমি এবং আমার সঙ্গীরা নিচে পড়ে গেলে টেনে উঠানারে কসরৎ করলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল একটা গুর্খা সৈন্যও অন্ধকারের মধ্যে পা পিছলে পড়েনি। তাদের শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা, সাহস ও ক্ষিপ্রতা আমাদের জীবনের এক অবিস্মরণীয় শিক্ষা হয়ে রইল। আমাদের বাঙালি গাইড হঠাৎ আমাদেরকে থামতে। বললো, আমরা ততক্ষণে শত্রু বাংকার থেকে প্রায় ২৫০ গজ কাছে এসে গেছি। ছোট ছাট জঙ্গল থাকায় আমাদের কাউকে পাকিস্তানী সেনারা দেখতে পায়নি। জোক, মশা নিঃশব্দে রক্ত খেয়ে মুক্তিযাদ্ধোকে বিরক্ত করছে কিন্তু সামান্য নড়াচাড়াও যুদ্ধে নিষেধ। কারণ সামনেই শত্রু। স্বাধীনতা তাে আর ভিক্ষায় আসে না। কারাে সঙ্গে কারারে কথা নেই, এভাবে রাত প্রায় ৪টা ৫০ মিনিট হবে আমরা। দেখতে পেলাম পাকিস্তানী সেন্ট্রিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর বাকিরা বাংকারে অঘােের ঘুমাচ্ছে। এদিকে অনেক দূরে মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে । কিছু কিছু মোরগ অনেক দূরে দূরে ডাকছে, আমাদের সকল অটোমেটিক প্রস্তুত শুধু আদেশের অপেক্ষা। পূর্বাকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্য ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় পূর্ব নিধারিত সংকেত অনুযায়ী একটি পাখির ডাক শুনলাম অর্থাৎ চূড়ান্ত আঘাত হানার সময়। আমাদের সবচেয়ে সেরা স্নাইপাররা ব্রাশফায়ারেই শত্রুর প্রহরীদের কুপাকোত করল । ততক্ষণে আমরা আয়াখোলী ও ‘জয় বাংলা’ বলে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। হঠাৎ এই আক্রমণে প্রহরীরা এতই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে, কেউ বাধা দিতে পারেনি চেষ্টা করেও। তাদের ধারণা ছিল না যে, এমনটি ঘটতে পারে। সামনের বাংকারগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরাস্ত হলো গ্রেনেড চার্জের মাধ্যমে। পিছনের বাংকার থেকে কিছু ফায়ার আসতে লাগলো, ততক্ষণে পাকিস্তানি আর্মির অয়্যারলেস অপারেটর এসওএস কল দিয়ে আর্টিলারি ফায়ার চাইলো। আমরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে আর পাক আর্মি বাংকারে, অকস্মাৎ আক্রমণে শত্রু সৈন্য পিছনের বাংকার থেকে পলায়ন শুরু করে কিন্তু আর্টিলারি ফায়ার শত্রুরা তাদের বাংকারের ওপর ফেরতে থাকে, এতে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকে। আর্টিলারি ফায়ারের তীব্রতা বাড়তে থাকায় আমার পাশে যুদ্ধরত ক্যাপ্টেন সিং শত্রুর আর্টিলারি পজিশনের ওপর কাউন্টার বাম্বোরডমেন্ট আনার জন্য অনুরাধে করেন। আস্তে আস্তে শত্রুর আর্টিলারি ফায়ারের তীব্রতা কমতে থাকে, কারণ আমাদের আর্টিলারি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে এবং আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। আমরা সকল বাংকারের দখল নিই। আমাদের তখন যুদ্ধ জয়লাভের আনন্দ, হঠাৎ আমার সহযাদ্ধো রংগু বানোজ একটি বাংকারের উপরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ডাকছিল। সঙ্গে সঙ্গে একটি বুলেট তার ডান বাহুতে ঢুকে উল্টো দিকে বের হয়ে যায়। সে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কয়েক জন গুর্খা সৈন্যের রক্তে পুরো এলাকাতি হয়ে যায়। এত রক্ত তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আর্টিলারি শেলিং-এ একজন গুর্খা সৈন্যের মাথা দুভাগ হয়ে যায়। সঙ্গে তার এলএমজিটিও। একটি আর্টিলারি স্প্রিন্টার আমার ডান হাতে লেগে এসএমজির ম্যাগজিন ছিদ্র হয়ে যায় এবং সকল গুলি পড়ে যায়। প্রথমে কিছুই আমি টের পাইনি পরে ফায়ার করতে গিয়ে দেখি যে, ম্যাগাজিনের দফারফা, সঙ্গে সঙ্গে স্পেয়ার একটি ম্যাগাজিন চড়িয়ে গুলি চালাই। এই ম্যাগজিনটি আমাকে স্মরণ করে দিত সামান্য একটু এদিক ওদিক হলে আমার ভাগ্য কি বরণ করত। ইতামেধ্যে আমরা সম্পূর্ণ টিলার দখল নিয়েছি। কিছু মৃত সৈনিকের পকেট থেকে উর্দুতে লেখা চিঠি ও ফটো পাওয়া যায়। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি আমার কলেজ অর্থাৎ সিলেট মুরারী চাদ (এমসি) কলেজের কয়েকজন সহপাঠীর ফটো সেগুলির মধ্যে। পাক আর্মির মৃতদেহ ও গালোবারুদ চারিদিকে ছড়ানো। আমরা আমাদের অবস্থান মজবুত করলাম। দিনের আলায়ে সব পরিষ্কার। আমাদের প্রাতঃরাশ ততক্ষণে সবার কাছে পৌঁছে গেছে। বিজয়বার্তা অধিনায়কসহ সকলে পেয়ে গেছেন। আহত ও নিহতদেরকে পেছনে পাঠানো শেষ। থেমে থেমে আর্টিলারি ফায়ার হচ্ছে। সকাল ১০ টা পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনীর কোনো সাড়া-শব্দ নেই, টুপী পাহাড় থেকে তারা শুধু পর্যবেক্ষণ করেছে। সকাল প্রায় ১১ টার দিকে আমাদের অবস্থানে আর্টিলারি শেলিং শুরু হয়। আমরাও প্রস্তুত, প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে ঢুপী টিলার পাশে শক্র সৈন্য জমায়েত হতে শুরু করে। আমরা প্রতি-আক্রমণে প্রস্তুত। অন্তত ৩ বার আক্রমণ শাণাতে গিয়ে পাক আর্মি পযুরদস্ত হয়। এভাবে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আমরা দিগারাইল টিলার অবস্থান করলাম। টিলার দক্ষিণাংশে স্থল মাইন দিয়ে সুরক্ষিত করা হল। ইতিমধ্যে বেতার বার্তা এল, সন্ধ্যার মধ্যে আমরা যেন দিগারাইল টিলার প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে বাইরাখেলি ফিরি, যেখানে শুধু আমার কোম্পানি থাকবে। গুর্খারা তাদের ক্যাম্পে অর্থাৎ মুক্তাপুরে চলে যাবে কারণ তখনও বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেয়নি। তাই কৌশলগত কারণে ভারতীয়রা থাকতে পারে না যেহেতু দিগারাইল সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের অনেক ভিতরে। সন্ধ্যায় বাইরাখেল গ্রামে আমার কোম্পানি ও গুর্খা কোম্পানি ফল ইন (সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানে) হলো। উদ্দেশ্য মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করে নীরবতা পালন, যা প্রত্যেক যুদ্ধ শেষে রীতি। দু’মিনিটের নীরবতার সময় সকলের চোখ ছলছল করে উঠলো। তবু সৈনিকের লোকচক্ষুর সামনে চোখের জল ফেলা ভীরুতা। তাই আমি অতি কষ্টে সংরক্ষণ করলাম। ভালো লাগলো একটা বিরাট জয় পেয়ে। দিগারাইল টিলা আর পাক আর্মি দখল করতে পারলো না। এটা রইলো একটা নোম্যান্স ল্যান্ড হিসেবে টুপীটিলা দখলের পূর্ব পর্যন্ত।
[৪১] জয়ন্ত কুমার সেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত