You dont have javascript enabled! Please enable it!

দাউদকান্দি অপারেশন, কুমিল্লা

১৯৭১ এর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। ফ্রগম্যানশীপ প্রশিক্ষণের পর অপারেশনের জন্য প্রস্তুত কমান্ডোরা। মধ্য আগস্টে দেশের দুটি সামুদ্রিক বন্দর ও দুটি বৃহৎ নৌবন্দর চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ কমান্ডো অপারেশন সিদ্ধন্ত নেয় হাইকমান্ড। সেই অনুযায়ী বাছাই করা কমান্ডোদের নিয়ে ৪টি গ্রুপ আগস্টের প্রথম সাপ্তাহেই পলাশীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছেড়ে গন্তব্যে চলে যায়। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরের জন্য গঠিত তিনটি গ্রুপকে কলকাতার দমদম বন্দর থেকে একটি ভারতীয় ডাকোডা বিমান আসামের গৌহাটি হয়ে আগরতলায় নিয়ে যায়। আগরতলার সিংগারবিল বিমান বন্দর থেকে পার্বত্য ত্রিপুরার অতি নির্জন একটা ক্যাম্প নিয়ে যাওয়া হয় কমান্ডোদের।
এটি ছিল একটা ট্রানজিট ক্যাম্প। অপারেশনের পূর্বে ক্যাম্পে ভারতীয় ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অফিসাররা কমান্ডোদেরকে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্রিফিং দেন। তাদের দেখাশোনার দায়িত্বেও ছিলেন এ সকল অফিসাররা। আগত অফিসারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হায়দার, ভারতীয় নৌবাহিনীর লেঃ কমান্ডার রায়, ক্যাপ্টেন দাশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের ব্রিগেডিয়ার সাবে সিং। উল্লেখিত অফিসাররা নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন অস্থায়ী এই ট্রানজিট ক্যাম্পে।
তিনটি গ্রুপ শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধু নির্দেশের। সমুদ্র ও নৌবন্দর শক্রদের অস্ত্র বোঝাই জাহাজ বারজ ধ্বংস করার যেন তর সইছে না কমান্ডোদের। ঠি এ সময় হাইকমান্ড একটি নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কুমিল্লায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটেও একই সাথে আঘাত হানতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ফেরিঘাট অচল করে দিতে পারলে শক্রদের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে চট্টগ্রাম বন্দর।
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় গ্রুপ ফরম্যাশন নিয়ে। ইতোমধ্যে গঠিত তিনটি গ্রুপ থেকে হয়ত একটি ছোট গ্রুপ গঠন করা যাবে, কিন্ত নেতৃত্ব দেয়ার মতো কমান্ডোর অভাব। প্রতিটি গ্রুপের নেতৃত্বে দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিদ্রোহী সব বাঙালি নৌসেনাদের। দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যায় কতৃপক্ষ।
আগস্টের ৮ তারিখ প্রায় সারাদিন ক্যাপ্টেন দাশ বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে থাকেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌকমান্ডোদের কাউকে দায়িত্বটা দিয়লে কেমন হয়। প্রশ্ন করেন নিজেকে। নৌকমান্ডো শাহজাহান সিদ্দিকীকে তাঁবুতে ডেকে পাঠান।
-আপনাকে একটা ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চায় হাই কমান্ড। শাহজাহান সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে থাকেন ক্যাপ্টেন দাশ।
-দায়িত্বটা জানতে পারি কি ? বিনয়ের সাথে জবাব দেন সিদ্দিকী।
-একটা স্বতন্ত্র গ্রুপকে নেতৃত্বে দিতে হবে। নয় জন কমান্ডো থাকবে আপনার গ্রুপে। অন্যান্য চারটি বন্দরের সাথে দাউদকান্দি ফেরিঘাটকে অন্তর্ভুক্ত করেছি আমরা। ফেরিঘাটটি অচল করে দিতে হবে। এখানে পারাপারের জন্য ব্যাবহৃত সবকয়টি ফেরি ধ্বংস করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে আপনার গ্রুপ ও লিডার হিসেবে আপনাকে। ফেরিঘাটের পন্টুন উড়িয়ে দিতে হবে একই সাথে। ক্যাপ্টেন দাশের কথায় শাহজাহান সিদ্দিকী উজ্জীবিত হয়ে উঠেন। গ্রুপ মিটিং করে অপারেশন কৌশল, যাত্রাপর্ব, ফিরে আসার সময়, অপারেশনস্থলের কাছে অস্থায়ী গোপন অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করেন। বাংলা মায়ের সাহসী এই তরুণ যোদ্ধা ক্যাপ্টেন দাশের সাথে আলোচনা করে অপারেশনের দিন ক্ষণ ঠিক করে নেন। উজ্জীবিত করে তোলেন গ্রুপের কমান্ডোদের।
গ্রুপের প্রত্যেককে দেয়া হয় ১টি লিমপেট মাইন, সাঁতার কাটার জন্য ১ জোড়া ফিনস ও ১টি করে কমান্ডো নাইফ। দলনেতা শাহজাহানকে বাড়তি দেয়া হয় একটি স্টেনগান ও ছোট্ট একটি ট্রানজিস্টার। ছোট অথচ দূরবর্তী কেন্দ্রের অনুষ্টান প্রচারে সক্ষম এই ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে দলনেতা অপারেশনের সংকেত পাবেন নির্ধারিত সময়ে। ক্যাপ্টেন দাশের সাতেহ আলোচনা করে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে অপারেশনের সময় নির্ধারণ করা হয়। অপারেশনের পূর্বে ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে পূর্বদিন অর্থাৎ ১৩ আগস্ট রাত ৮টা একটি গান ও ১৪ আগস্ট একই সময় অপর একটি গানের মাধ্যমে দলনেতা অপারেশনের সংকেত পাবেন নির্ধারিত সময়ে। ক্যাপ্টেন দাশের সাথে আলোচনা করে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে অপারেশনের সময় নির্ধারণ করা হয়। অপারেশনের পূর্বে ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে পূর্বদিন অর্থাৎ ১৩ আগস্ট রাত ৮টায় একটি গান ও ১৪ আগস্ট একই সময় অপর একটি গানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিগন্যাল পৌছানো হবে। গান দুটি নির্ধারিত সময়ে বাজানো হবে বিবিধ ভারতী কোলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে।
প্রয়োজনীয় নির্দেশ নিয়ে শাহজাহান সিদ্দিকী তাঁর গ্রুপটি নিয়ে ১১ আগস্ট সীমান্ত অতিক্রম করে বনাগ্লাদেশে প্রবেশ করেন। এদিন সন্ধ্যায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক কুমিল্লার কংশনগর থেকে পূর্বদিকে সীমান্ত এলাকায় গ্রুপটিকে নামিয়ে দিয়ে যায়। কখনও কাদামাটির গ্রাম্য পথ ধরে হেঁটে কখনও বা নৌকায় দাউদকান্দি থানার বন্ধরামপুর গ্রামে পৌঁছে দলটি। গ্রুপটির সাথে আব্দুল মান্নান ও আবুল কাশেম নামের দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে গাইড হিসেবে প্রেরণ করেন ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হায়দার।
বন্ধরামপুরের পীর কেবলা আল্লামা শাহ কামাল ছিলেন একজন উদারপন্থী মানুষ। মাতৃভূমির মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত এই মহান পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গপনে আশ্রয় দিতেন নিজ বাড়িতে, খাবার দিতেন নিজ সন্তানসম বীর যোদ্ধাদের। শাহজাহান সিদ্দিকী ও তাঁর গ্রুপটিকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা (এফ এফ) ভেবেছিলেন। তিনি তাদের আসল পরিচয় ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারেন নি। নিজ সন্তানদের মতো গোপনে অন্দরমহলে তাঁদের রাখার ব্যবস্থা করেন। থাকা ও খাওয়ার বিষয়ে যত্নের ব্যাবস্থা নেন। শক্র কবলিত এলাকায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রুপটির উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সহায়তা প্রদান করেন। তিনি ততার বিশ্বস্ত মুরিদগণের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন কমান্ডোদের সাময়িক অবস্থান। দলনেতা সিদ্দিকী নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখেন পীর সাহেবের কাছে। এ সময় শাহজাহান সিদ্দিকী ছিলেন শশ্রুমন্ডিত। পীর সাহেবের কাছে থাকা মুরিদগন তাকে খুব সম্মান করতেন। বেশভূষায় ছিলেন মাদ্রাসার একজন তালেব এলেমের মত। সালাম দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতো অনেকে। আর পীর সাহেব আপন পুত্রের মতো তাঁকে স্নেহ করতেন। বাইরে থেকে যে সব লোক পীর সাহেবের কাছে আসতেন তারা শাহজাহান সিদ্দিকীকে পীর সাহেবের একজন বিশিষ্ট খাদেম বা মুরীদান মনে করতেন। সার্বিক বিবেচনায় পীর সাহেবের বাড়িতে কমান্ডোদের অস্থায়ী ঘাটিটি ছিল নিরাপদ। গোপনে কমান্ডোদের অপারেশন প্রস্তুতি চলতে থাকে। ১৩ আগস্ট রাতে ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে অপারেশনের সংকেত প্রাপ্তির আশায় উদ্বিগ্ন সময় কাটান দলনেতা। এদিন রাত আটটায় বিবিধ ভারতী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে ওঠে- “ আমার পুতিল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুর বাড়ি”। অপারেশনের গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে দলনেতা সিদ্দিকী উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এই বংঙ্গ শার্দূলের সারা শরীরে বয়ে যায় শক্র হননের তীব্র প্রবাহ। যেন জেগে ওঠে ঘুমন্ত ব্যাঘ্র। গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে করনীয় বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন অপারেশনস্থল রেকি করার। ১৪ আগস্ট অপারেশনস্থল রেকি করে আসেন তিনি। ফেরী ও পল্টুনের অবস্থান, অপারেশনে যাওয়া ও নিরাপদে ফিরে আসার পথ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্পন্ন করেন একক ভাবে। তবে সহযোদ্ধাদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করেন অপারেশন পরিকল্পনা। ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিগন্যাল যথাসময়ে পেয়ে যান দলনেতা সিদ্দিকী। ১৪ তারিখ রাত ৮ টায় কলিকাতা বিবিধ ভারতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে বেজে ওঠে ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাইনি কোন দান’। চূড়ান্ত সিগন্যাল পেয়ে কমান্ডোরা অপারেশনের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। দলের প্রতিটি সদস্য দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। হাইকমান্ডের নির্দেশমতে ১৫ তারিখ রাতে দলটি পীর সাহেবের বাড়ির অস্থায়ী ক্যাম্প ছেড়ে আসে। মুষলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ নেমে এসেছে মর্তে। বাতাসও বেশ। প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে কমান্ডার তার দলকে নিয়ে খোলা নৌকায় করে অপারেশনে বেরিয়ে পড়েন। দলটি পথিমধ্যে বিপদে পড়ে গাইড কাশেমকে নিয়ে। ২নং সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হায়দার যে দু’জন গাইড হায়দারের খুব বিশ্বস্ত ও কাছের একজন। কাশেম অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সে নৌকা থেকে নেমে অন্যত্র চলে যেতে বায়না ধরে। কমান্ডার সিদ্দিকী গাইড কাশেমের এরূপ আচরণ দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি অপারেশনে যেতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কাশেমকে পথের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন সিদ্দিকী। চরম হতাশার মধ্যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেদিনের মত অপারেশন স্থগিত রাখেন কমান্ডার। সাথী কমান্ডোদের সাথে শলা পরামর্শ করে পরদিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট রাতে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধন্ত গ্রহণ করেন। সেদিন ফিরে আসেন অস্থায়ী ক্যাম্পে। ১৬ আগস্ট। মাগরিবের নামায শেষে স্বল্প আহার সেরে কমান্ডোরা গায়ে প্রচুর সরিষার তেল মেখে নেয়। একটা ছইওয়ালা নৌকায় রাত ১০টার পরপরই কমান্ডোরা অস্থায়ী ক্যাম্প ছেড়ে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কেবল বাদ যায় কমান্ডো হাসান নূর। সে ছিল রাজশাহীর ছেলে। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতো বলে কুমিল্লা এলাকায় তাকে নিয়ে চলাফেরা করা ছিল বিপদজনক। এ কারণে কমান্ডার সিদ্দিকী তাকে অস্থায়ী ক্যাম্প রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য তার মাইনটি বহন করে নিয়ে আসেন কমান্ডার নিজে। সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কমান্ডার সিদ্দিকীর কাছে সময়টা বড় দীর্ঘ মনে হয়। গতকালের অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা যেন বারুদের উত্তাপ ছড়িয়েছে সারা দেহে। অস্থায়ী ক্যাম্প বন্ধরামপুর পীর সাহেবের বাড়ি থেকে ফেরিঘাটের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। মাঝিদেরকে দ্রুত নৌকা চালানোর নির্দেশ দেন সিদ্দিকী। মাঝির প্রাণপণ নৌকা বেয়ে চলেন। যেন তারাও কমান্ডোদের সঙ্গী। অবশ্য মাঝিদের কাছে কমান্ডোদের সত্যিকার পরিচয় গোপন ছিল। তারা দলটিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ভেবেছিল। আনুমানিক রাত ১ টায় ফেরিঘাটি থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার উত্তরে নৌকা থামানো হয়। উত্তর দিক থেকে অনুকূল স্রোতে ফেরিঘাটে সাঁতার কেটে আসা ছিল বেশ সুবিধাজনক। নিরাপদে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে কমান্ডার সিদ্দিকী নতুন সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সাথী কমান্ডোদের নিয়ে সহজে ভাটির দিকে না যেয়ে উল্টো উত্তরদিকে উজানে নৌকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্রোতের উল্টোদিকে ফিরে আসা যদিও খুব কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। কমান্ডারের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন সাথী সাহসী কমান্ডোরা। কমান্ডোদের বহনকারী নৌকাটি নদিড় কাছাকাছি একটি ধান ক্ষেতে রেখে মাঝিদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। অতঃপর সুইমিং কস্টিউম পরে নেয় কমান্ডোরা। কমান্ডার সিদ্দিকী তিনজন করে দুটি গ্রুপে ভাগ করে নিজে কমান্ডো নূরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তিনজনের দুটি গ্রুপকে ফেরিঘাট থেকে অদূরে নোঙর করা দুটি ফেরিকে টার্গেট দেয়া হয়। কমান্ডার তার সঙ্গীসহ ঘাটের পন্টুনটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। কমান্ডোদের প্রত্যেকের কাছে ছিল একটি করে জাহাজ ধ্বংস করার লিমপেট মাইন। কমান্ডার সিদ্দিকী তিনজনের গ্রুপ দুটিকে নৌকায় করে টার্গেটের এক কিলোমিটার দূরত্বে নামিয়ে দিয়ে নিজে সাথী কমান্ডোসহ টার্গেটের অদূরে পানিতে নেমে পড়েন। স্রোতের অনুকূলে সাঁতরে দ্রুত টার্গেটের কাছাকাছি যেতে থাকে কমান্ডোরা। শক্ররা তখন ফেরিঘাটে খোশ গল্পে মত্ত। দু’চারজন রাজাকার ঝিমুচ্ছে বোধ হয়। মাঝেমাঝে শোনা যাচ্ছে হানাদারদের অট্টহাসি। অতি চুপিসারে কমান্ডোরা যার যার টার্গেটে পৌঁছে যায়। দ্রুত প্রতিটি টার্গেটের গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে কমান্ডোরা স্রোতের প্রতিকূলে প্রাণপণ ব্যাকস্ট্রোক সাঁতার কাটতে থাকে। দ্রুত নিরাপদ পৌছাতে হবে। থানা হলে যে কোন মুহূর্তে বিপদের আশংকা রয়েছে। অসীম সাহসী কমান্ডোরা অবশেষে নিরাপদে ফিরে আসে নৌকায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন কমান্ডার সিদ্দিকী। আনন্দে এঁকে অপরকে জড়িয়ে ধরে কমান্ডোরা। নৌকায় ফিরে অস্থায়ী ক্যাম্পে যাত্রা করে গ্রুপটি। মাইন বিস্ফোরণের শব্দের প্রহর গুনতে থাকে বীর যোদ্ধারা। ৪৫ মিনিট পর ভয়ংকর শব্দে একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে মাইনগুলো। দাউদকান্দি ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। মাইনের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেরি দুটি দেখতে দেখতে মেঘনার কালো জলে হারিয়ে যায়। ঘাটের পল্টুনটি খন্ড বিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পানির তলদেশে। কাছে থাকা হানাদার ও রাজাকাররা আতংকে দৌড়াতে থাকে। বাংকারে আশ্রয় নেয় আহত অনেকে। নিখোঁজ হয় কয়েকজন। ঘটনার আকস্মিকতায় হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে মেশিনগান থেকে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। আত্মরক্ষায় মরিয়া তারা। বিরতি না দিয়ে হানাদারদের নিস্ফল প্রতি আক্রমণ অব্যাহত থাকে। কমন্ডোরা ততক্ষণে অনেক দূরে নিরাপদ আস্তানার কাছাকাছি। পাকসেনারা ভেবেছিল মুক্তিযোদ্ধারা হয়ত নদীর অপর পাড় থেকে দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণ করেছে। সেটা অনুমান করে হানাদার বাহিনী পশ্চিম পাড় লক্ষ করে বৃষ্টির মত গুলি ছুড়েছে, মর্টারও ব্যাবহার করেছে মাঝে মাঝে। ফেরিঘাট আক্রমণের সংবাদ দ্রুত পৌঁছে যায় কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। হানাদার বাহিনী সাঁজোয়া বহর নিয়ে ছুটে আসে। বিধ্বস্ত দাউদকান্দি ফেরিঘাটের ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষ করা ছাড়া অসহায় পাক সেনাদের করনীয় আর কিছু ছিল না।
[৫৯৪] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!