You dont have javascript enabled! Please enable it!

দাগনভূঁইয়া গেরিলা অপারেশন, ফেনী

দাগনভূঁইয়া এলাকার জামাতে ইসলামী নেতা ছিলেন ডা. ওবায়দুল্লা। দাগনভূঁইয়া বাজারে তার একটা ফার্মেসি ছিল। এই ফার্মেসিতে জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল এবং তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের সমাবেশ হত। এখানে বসে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শলাপরামর্শ করত। তারা আশপাশের স্থানীয় সাধারণ যুবকদেকে ডা. ওবায়দুল্লার ফার্মেসিতে এনে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে রাজাকারবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্ররোচিত করত। গ্রামের সাধারণ মানুষদের ভয়-ভীতি, প্রলোভন, প্ররোচনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের কারো বাড়িতে আশ্রয় প্রদান না-করার জন্য ভীতি প্রদর্শন করত। তখনো দাগনভূঁইয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো উল্লেখযোগ্য গেরিলা অপারেশন হয়নি। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন, আইয়ুবুর রহমান এবং আবদুল আলী এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে ডা. ওবায়দুল্লাহ ফার্মেসিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্তানায় গেরিলা অপারেশন চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল বয়েসে তরুণ। এদের সবার বাড়ি এয়াকুবপুর ইউনিয়নে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তখনো এলাকায় তারা খুব একটা পরিচিত নয়। সপ্তাহের প্রতি শনিবার এবং বুধবার হাটের দিন প্রচুর লোক সমাগত হত। বুধবার হাটে এরা তিনজন ঔষধ কেনার অজুহাতে ডা. ওবায়দুল্লার দোকানে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আসে। পরবর্তী শনিবার হাটের দিন তিনজন গেরিলা ডাক্তারের দোকানে সন্ধ্যার পরপরই গ্রেনেড চার্জ করে জনতার সঙ্গে মিশে যায়। এই গ্রেনেড হামলায় ডা. ওবায়দুল্লাহসহ প্রায় ১৫/১৬ দালাল আহত হয়। গ্রেনেড বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে এবং মুহূর্তের মধ্যে বাজার মানুষশুন্য হয়ে যায়। বাজার থেকে পালায়নরত মানুষের মধ্যে সেদিন খুবই উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে। বাড়িঘরের দিকে ছুটে যাওয়া মুক্তিকামী মানুষ বলাবলি করছিল যে, আমাদের এলাকায় যখন মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে, আর কোনো চিন্তা নেই। এবার দালালরা ঠিকই শায়েস্তা হবে। পরবর্তী সপ্তাহে দাগনভূঁইয়ার পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ থানার বসুরহাটে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার এরফান মিয়ার অফিসে একই ধরনের আর একটি সফল গেরিলা-অপারেশন পরিচালনা করে ফেনীর ঐ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। ফেনী থানা কমান্ডার কাজী নূর নবীর গ্রুপটি ফেনী থানার শেষপ্রান্তে বসুরহাটের নিকটবর্তী দুধমাখা বাজারে অবস্থান করছিল। তাদের কাছে ইনফরমারের মাধ্যমে খবর আসে যে, জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের যেসব লোককে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছে তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য মাইজদী নিয়ে যাওয়ার আগে সেদিন সন্ধ্যায় ইরফান মিয়ার অফিসে প্রশিক্ষণপূর্ব ব্রিফিং দেয়া হবে। জামাতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃবৃন্দ মাগরেবের নামাজের পর সভার কাজ শুরু করে। তিনজন বক্তার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর রাজাকার কমান্ডার এরফান মিয়া বক্তৃতা শুরু করা মাত্রই মুক্তিযোদ্ধারা সভাস্থলে পর পর কয়েকটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বহুসংখ্যক রাজাকার হতাহত হলেও এরফান মিয়া অক্ষত অবস্থায় প্রানে বেঁচে যায়।
এই এরফান মিয়া পড়ে রাজাকারদের কোম্পানীগঞ্জ থানা কমান্ডার হয়ে সমগ্র কোম্পানীগঞ্জ থানায় ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করার জন্য বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ধূর্ত এরফান প্রত্যেকবারই প্রাণে বেঁচে যযায়। নোয়াখালী জেলা হানাদারমুক্ত হওয়ার ১৫ দিন আগে ২১ নভেম্বর রাজাকার ক্যাম্প থেকে নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার এরফান মিয়া আরো ছয়জন রাজাকারসহ নিহত হয়। ফেনী-মাইজদী মহাসড়কে সেবারহাট থেকে উত্তরদিকে একটি রাস্তা প্রতাপপুর গ্রামের মাঝখান দিয়ে এসে ফেনীর দরবেশের হাঁট এবং নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কানকিরহাট সংযোগ সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই রাস্তায় মিজিপুকুরের উত্তরদিকে নুইয়ানী পুলের পাশে একটি গ্রাম্য দোকানঘর ছিল। দোকানের মালিকের নাম শামছুল হক। সে জামাতে ইসলামীর একজন কট্টর সমর্থক। এই রাস্তা দিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের শরণার্থী পরিবার-পরিজন নিয়ে সিন্দুরপুর কানকিরহাট প্রভৃতি মুক্তাঞ্চলে এসে সেখান থেকে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিত। অনেকে পুলের নিচ দিয়ে প্রবাহিত নদীপথে মুক্তাঞ্চলের দিকে যাতায়াত করত নৌকাযোগে। স্থানীয় জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের কয়েকজনকে নিয়ে শামছুল হক শরণার্থীদের মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করত। তার এই অপকর্ম সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারে শরণার্থীদের কাছ থেকে। জামাত-নেতা শামছুল হক ও তার সহযোগীদের শায়েস্তা করার জন্য ফেনী থানার কমান্ডার কাজী নূর নবী এবং ডেপুটি কমান্ডার মাহফুজুল হক, মোহাম্মদ মুসা মিয়া, শ্যামল কান্তি বিশ্বাস, শাজাহান কবির, রুহুল আমিন, আইয়ুবুর রহমানসহ সাত-আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে আগস্ট মাসের প্রথমদিকে একরাতে সেখানে পাঠানো হয়। রাত আনুমানিক দশটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা তার দোকানে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে দোকান লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। গ্রেনেড দোকানের চালে লেগে বাইরের দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলে শামছুল হকসহ তার দলবল ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা স্টেনগানের ব্রাশফায়ারে সব কজনকে হত্যা করে খালের পাশে ফেলে রেখে স্থান ত্যাগ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অপারেশনের পর সেই রাস্তাসহ সমগ্র এলাকা শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াতের জন্য বিজয় অর্জন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ফেনী জেলার বর্তমান দাগনভূঁইয়া থানার ছয়টি ইউনিয়নঃ সিন্দুরপুর, রাজাপুর, পূর্বচন্দ্রপুর, দাগনভূঁইয়া ও ইয়াকুবপুর এবং নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ থানা নিয়ে গঠিত প্রাদেশিক পরিষদের আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন কোম্পানীগঞ্জের হেকিম ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারবাহিনীর দালাল শান্তিকমিটির বিশিষ্ট নেতা। তিনি সবসময় আসকান, শেরোয়োনি ও কালো জিন্নাটুপি পরে পাকিস্তানী সেজে থাকতেন। কথাবার্তাও বলতেন বেশিরভাগ উর্দু ভাষায় । বসুরহাটে তার একটি ইউনানী চিকিৎসালয় ছিল । এতে তিনি দেশীয় গাছগাছড়ায় তৈরি ঔষধ বিক্রি করতেন এবং চিকিৎসা করতেন। তার বিশাল ঔষধের দোকানে প্রায়ই জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ স্বাধীনতাবিরাধেীদের আড্ডা চলত। স্বাধীনতাবিরাধেীদের নিয়ে মাঝেমধ্যে মিটিং বসত। প্রত্যেক হাটের দিন মিটিংগুলো হত। এইসব মিটিঙে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযাদ্ধোদের সম্পর্কে নানাভাবে অপপ্রচার চালানারে বিষয়ে এবং মুক্তিযাদ্ধো ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লাকেদের কীভাবে প্রতিহত করা যায় সেইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হত। আগস্ট মাসের শেষদিকে আইয়ুবুর রহমান, আব্দুল আলী, শফিউল্লা, আবদুর রশীদ (প্রয়াত), রুহুল আমিন, সিরাজ প্রমুখ মুক্তিযাদ্ধো (বিএলএফ) ফেনী থানা কমান্ডারের নির্দেশে হেকিম ইলিয়াসের ইউনানী চিকিৎসালয়ে অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী হাটের দিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার দিকে হাটের জনগণের সঙ্গে মিশে অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলার পর মুক্তিযাদ্ধোরা নিরাপদে ফিরে আসে। এই হামলায় কয়েকজন স্বাধীনতাবিরাধেী আহত হয়। পাকসেনা ও রাজাকাররা বাজারের নিরীহ জনগণের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালায় এবং বিভিন্ন দোকান থেকে নগদ অর্থ লুটপাট করে। গেরিলা অপারেশনের পরপরই বাজার জনশূন্য হয়ে যায়। অনেকে তাদের হাতে নির্যাতিত হয়। এই অপারেশনের প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় দালালদের মধ্যে প্রচ- ভয়ভীতির সঞ্চার হয়। অপরদিকে জনসাধারণের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। সানোগাজী থানার পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে নবাবপুরে বিএলএফ ও শফিকুল হােেসন চৌধুরীর ভাই সিরাজুল হােেসন চৌধুরীকে বাজার থেকে ধরে এনে বন্দিশিবিরে আটক রেখে পরবর্তীতে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। একইভাবে শলিয়া গ্রামের বড় পুকুরপাড়ে পূর্ব অনন্তপুরের প-িত অধন ও নাম-না-জানা এক দিনমজুরকে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনা এবং রাজাকার পরশুরাম থানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আমিনুল করিম মজুমদার খাকো মিয়ার শলিয়া গ্রামস্থ বাড়ি এবং কোলাপাড়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আনায়োরুল হকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তারা একইভাবে উত্তর শলিয়া মজুমদার বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়।
[১১৩] শফিকুর রহমান চৌধুরী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!