You dont have javascript enabled! Please enable it!

তিনলাখ পীরের যুদ্ধ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

‘তিনলাখ পীর’ কসবা থানায়। ধারণা করা হয়, হযরত শাহজালাল (রাঃ) যখন ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন তখন তিনি তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে এ স্থান হয়ে যাতায়াত করেন। এছাড়াও সিলেট এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা ছিল এ স্থানটি। এ স্থান দিয়ে বহুসংখ্যক পীরের যাতায়াত ছিল বিধায় জায়গাটির নামকরণ হয় ‘তিনলাখ পীর’। ৮ জুন ক্যাপ্টেন গাফফার মন্দভাগ থেকে কোনাবন এলাকায় নতুন দায়িত্ব নেওয়ার জন্য চলে যান। কসবা দেবীপুর সাব সেক্টরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় লে. হুমায়ুন কবীর-এর ওপর। লে. হুমায়ুনের নিকট দুই কোম্পানির অধিক সৌন্য ছিলো। একটি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) কোম্পানি আর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল ও কিছু অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আর এক কোম্পানি সৈন্য। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএন্ডবি রোড (বর্তমান হাই ওয়ে রোড) পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর উভয়ের নিকট অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান তখন সিএন্ডবি রোড থেকে ২/৩ কি.মি. পূর্বে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায়। আর পাকবাহিনী এই রোডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেমন সৈয়দাবাদ, কুটি, কসবা ঘাঁটি স্থাপন করে প্রতি রাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টহল দিতে থাকে। সেই সময় পাকবাহিনী রাস্তার দুই পাশের গ্রামগুলির উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার চালাত এবং এখান থেকেই মুক্তিবাহিনীর উপর কোন প্রকার আঘাত হানা হতো, তাহলে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির ইপর শেলিং এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতো। আর্টিলারির শেল যখন মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ওপর দিয়ে যেতো, তখন সবার মনে ত্রাসের সঞ্চার হতো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা কোন প্রতি উত্তর করতে পারতো না। কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শুধু ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিলো, যা নিয়ে পাকবাহিনীর অবস্থান পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিলো না। সৈয়দাবাদ পজিশন থেকে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ করতো। আর এই আক্রমণ ও অত্যাচারের ধারা উত্তর নরসিংঘ থেকে শুরু করে দক্ষিণ শালদা নদী পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। পাকবাহিনীর এই অবস্থা দেখে লে. হুমায়ুন কবির পর্যবেক্ষণকারী পাঠিয়ে খবর সংগ্রহ করেন, সেই সঙ্গে পাকবাহিনীর গান পজিশনের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নেন। সৈয়দাবাদের পূর্বে তিনলাখ পীর নামক স্থানে একটি ব্রিজ আছে, যে ব্রিজটি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাতায়াতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এ ব্রিজের দক্ষিণ পাশেই ছিলো পাকবাহিনীর গান পজিশন। মোট চারটি কামান-দুটি উত্তর মুখি ও দু;টি দক্ষিণ মুখি ছিলো এর অবস্থান, এই গানগুলোর নিরাপত্তার জন্য এক কোম্পানিরও বেশই সৈন্য মোতায়ন করা হয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা হল, পাকবাহিনীকে হত্যা করে তাদের গোলা-বারুদ ও অস্ত্রের ক্ষতিসাধন করা। এই আক্রমণের জন্য দুই প্লাটুন সৈন্য (প্রতি প্লাটুন ১৫ জন সৈন্য) নেওয়া হয়। এই প্লাটুন দুইটির নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার সাত্তার ও শহিদ এবং তাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন ফজলু, হাসেম, জিয়াউল, গিয়াস, বাচ্চুসহ আরো অনেকেই। শুরুতেই যুদ্ধের কলা-কৌশল সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা হয়, যাতে করে কোন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয় এবং বলে দেওয়া হয় যে, হুমায়ুন কবিরের গুলিই হবে আক্রমণের নির্দেশ। এই যুদ্ধের জন্য সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করেছিল। কারণ, এই যুদ্ধটা ছিলো এই কোম্পানির জন্য বড় ধরনের যুদ্ধ। সন্ধ্যার সাথে সাথেই একটা প্যাট্রোল সেকশন পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যার দায়িত্ব ছিলো ব্রাহ্মণগাঁও-মজলিশপুর এলাকায় পেট্রোলিং করা, যাতে ইমাম বাড়ি-নিমতাবাদ থেকে কোন পাকিস্তানী পেট্রোল এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করতে না পারে। মুক্তিযোদ্ধারা রাত সাড়ে এগারটায় সাব-সেক্টর সদর দপ্তর কোণাবন থেকে যাত্রা শুরু করে অকাবপুর, চন্দপুর হয়ে রাত দুটোর দিকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছান। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে মাটির উচু-নিচু আড়ালের সাহায্য নিয়ে যতদূর সম্ভব শক্রর কাছাকাছি অবস্থান নেন। মহাসড়কের পূর্ব পাশে শুধু একটা সেকশন রাখা হয় শক্রর সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার (ফ্ল্যাংক প্রটেকশনের) জন্য, যেন উত্তরে অবস্থিত পাকবাহিনীর ছোঁড়া গুলি মূল আক্রমণকারী দলটির উপর এসে না পড়ে এবং সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে তুলে নিবে সবার শেষে। নির্দেশ ছিল মূল আক্রমনকারী দলটি আক্রমণ করবে মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে। অবশ্য পাকবাহিনী কোন প্রকার আক্রমণের চিন্তা করে নি। তাই মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই পজিশনগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে থাকে। এরই মধ্যে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থান থেকে দুই তিনটা গুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। অন্ধকারে যতটুকু সম্ভব আঁচ করার পর তিনভাগে ভাগ করে পজিশনে পাঠানো হয়। দুইটি লাইট মেশিন গান (এল. এম. জি) দুইপাশে, আর মধ্যখানে মিলিমিটার মেশিন গান (এম.এম. জি) ও এম. এম. জি এবং একটা এল.এম. জি রাখা হয়েছিলো রাস্তার পূর্ব পাশে। মূল দল খালের নিচে বাঁশঝাড়ের তলায় অবস্থান নিয়েছিলো, এবং এখানেই ছিলেন লে. হুমায়ুন। রাত প্রায় পৌনে চারটার সময় নিকটতম সেন্ট্রি পজিশনের প্রতি নিশানা করে গুলি ছোঁড়া হয়। মুহূর্তের মধ্যেই সব পজিশন থেকে প্রচণ্ড শব্দে গর্জে উঠল এল.এম.জি রাইফেল, স্টেনগান। সাথে সাথে পাকিস্তানী পজিশন থেকে ভেসে আসে চিৎকারের আওয়াজ। পাকবাহিনীর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করতে পেরেছিলো। তাই প্রথম কয়েক মিনিট কোন আক্রমণের চিহ্ন ছিলো না। কিন্ত কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানীরা লক্ষ্যহীনভাবে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও নিজস্ব পজিশন থেকে অনবরত গুলি করতে থাকে। এভাবে ঘন্টাখানেক চলে এবং এতে মুক্তিবাহিনী তাদের বাংকারের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর গুলি করতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে ছিলো বিধায় তাদের উপর কোন গুলির আঘাত আসে নি। সকল গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার উপর দিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করে উড়ে গিয়েছিল। এরপর শুরু হয় পাকবাহিনীর স্যাবর জেট থেকে গুলিবর্ষণ। তখন মুক্তিযোদ্ধারা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশন বন্ধ করে সামরিক কায়দায় মুহূর্তেই স্থান ত্যাগ করে খাল ও ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে সরে আসে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বাদৈর’ গ্রামে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে সকাল হয়ে এসেছে এবং গ্রামবাসীগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। হঠাৎ খবর আসে যে, রাজাকাররা বাড়ির আশপাশ খোঁজ-খবর নিচ্ছে। পাকবাহিনী সার্চ পার্টি পাঠাতে পারে মনে করে মুক্তিযোদ্ধারা বাদৈর গ্রাম ছেড়ে হাতুরা বাড়ি গ্রামের এক বাড়িতে গিয়ে ওঠে, যার চারপাশেই ছিলো অনাবৃত। পাকবাহিনী যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পিনা-অনুসারে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারে নি। এ নিয়ে ক্যাম্প ও সদর দপ্তর বেশ উৎকণ্ঠায় ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে বিকালের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে প্রায় ৮০/৯০ জন পাকসেনা মারা যায়। এ যুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনার জন্য হুমায়ূন কবিরকে “বীর প্রতীক”খেতাব দেওয়া হয়।
মোঃ আবু মুসা

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!