You dont have javascript enabled! Please enable it!

তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া

২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় অবস্থানকারী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ রাতে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থানকারী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২৭ মার্চ বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে এই কোম্পানিটি ব্যাটালিয়নের অন্য কোম্পানির সাথে একত্রিত হয় এবং মেজর খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৮ এবং ২৯ মার্চ জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে অবস্থানকারী দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করে ময়মনসিংহে মেজর কেএম শফিউউল্লাহর নেতৃত্বে একত্রিত হয়। মেজর শফিউল্লাহ ৩০ মার্চ কিশোরগঞ্জের স্টেশন এলাকায় নিজস্ব হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর বাহিনীর বিদ্রোহী সৈনিকদের নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাকিস্তানী জঙ্গিবিমান এবং দূরপাল্লার আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্টের প্রতিকূলে ঢাকা অভিযানটি একটি আত্মঘাতী অপারেশন হবে ভেবে তা থেকে বিরত থাকার জন্য একটি পত্র লিখে মেজর খালেদ মোশাররফ লে. মাহবুবকে একটি ট্রেনের স্পেশাল ইঞ্জিন নিয়ে কিশোরগঞ্জ পাঠান। মেজর খালেদ মোশাররফ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসার আমন্ত্রণ জানান। মেজর খালেদ মোশাররফের অনুরোধে ৩১ মার্চ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শফিউল্লাহ’র নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে একত্রিত হয়। ২৯ মার্চ লে.কর্নেল সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা নামের একজন বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে চতুর্থ বেঙ্গলের যাথে যোগ দেন। লে. কর্নেল এস এম রেজা ছিলেন ঢাকার আর্মি রিক্রুটিং অফিসের কমান্ডিং অফিসার। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় মানব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত হলে ২৭ মার্চ কর্নেল রেজা হেঁটে ঢাকা থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছেন। এসএম রেজাই ছিলেন কর্মরত লে. কর্নেল, যিনি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাকি সবাই ছিলেন মেজর পদমর্যাদার। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর লে. কর্নেল এসএম রেজাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন কোন দায়িত্বই দেয়া হয় নি। অথচ কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানীর পরবর্তী পদটির দাবিদার ছিলেন তিনিই।
সম্ভাব্য পাকিস্তানী বিমান হামলা থেকে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগান এলাকায় দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টদ্বয়ের একটি অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। ২ এপ্রিল কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানী এমএন এ তাঁর অতি প্রিয় গোঁফ কেটে ছদ্মবেশে সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা শহর সংলগ্ন মতিনগরে পৌছেন। ওই দিনই বিকেলে ভারতীয় বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার পান্ডে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে লে. কর্নেল এসএম রেজা, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে দেখা করে কর্নেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম এবং অষ্টম ইস্টবেঙ্গলের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়ার রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সংবাদ দেন। মেজর জিয়া তাঁকে সাহায্যের জন্য কিছু সৈন্য প্রেরণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও ব্রিগেডিয়ার পান্ডে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গলের বিদ্রোহী ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। লে. কর্নেল এসএম রেজা বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর কার্যক্রম সমন্বিত করা এবং ভারতীয় বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সাহায্যের ব্যাপারে ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোর একটি জরুরি আলোচনা সভার প্রয়োজনীয়তা কথা তুলে ধরেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্য সামরিক কর্মকর্তাদের ওই কনফারেন্সে এনে হাজির করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে দ্রুত তেলিয়াপাড়া এলাকা ত্যাগ করেন।
পূর্ব সিদ্ধনাত অনুযায়ী ৪ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী, আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল এবং কর্নেল ওসমানীকে সঙ্গে নিয়ে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হন। তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে ইতোমধ্যেই লে.কর্নেল এসএম রেজা, মেজর (অব) কাজী নূরুজ্জামান, মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম (শিশু), মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুর হসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আব্দুর মতিন এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিনসহ আরও কিছু সংখ্যক সেনা অফিসার উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সের লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর খালেদ মোশাররফ। কনফারেন্সে আলোচনার বিষয়বস্তু এবং সিদ্ধান্তসমূহ ছিল নিম্নরূপঃ
এক. কনফারেন্সে উপস্থিত সেনাকর্মকর্তাগন সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য বিএসএফ-এর মাধ্যমে ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেশন সরবারহের সম্ভাবনার কথা জানিতে চান। এ ব্যাপারে বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার পান্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সীমিত আকারে হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের আশ্বাস দেন। তিনি শীঘ্রই তাঁর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানান।
দুই. মুক্তিকামী হাজার হাজার ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণদানের লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যাবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে সভায় উপস্থিত আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
তিন. মেজর খালেদ মোশাররফ বিভিন্ন বিদ্রোহী সদস্যদের একটি কমান্ড চ্যানেল এনে স্মন্বিত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার যুদ্ধরত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কোথায় কী ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে, তা নিয়মিত মনিটরিং করার দায়িত্ব নেন। তিনি সীমান্তবর্তী বিএসএফ-এর কর্মকর্তাদের বিদ্রোহী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সাহায্যের নির্দেশ দেবেন বলেও আশ্বাস দেন। উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাগণ এ দিনের কনফারেন্সে দেশটিকে ৪ টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাবার জন্য একজন করে সেনা কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চটতগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেবার দায়িত্ব নেন মেজর খালেদ মোশাররফ। বৃহত্তর সিলেট জেলার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেবার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর শফিউল্লাহকে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে নেবার দায়িত্ব থাকেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী।
চার. সভায় ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে সকলকে অবহিত করেন যে, চট্টগ্রাম বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর সেনাদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমানে রামগড়ে অবস্থান করছেন। বন্দরনগরী চট্টগ্রা দখলে আনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাঁর জন্য কিছু সঈন্য পাঠানো দরকার। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, ওই দিনই ক্যাপ্টেনমতিনের নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি রামগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাবে। ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে ওই রাতেই বিএসএফ-এর গাড়ি দিয়ে এ দু’টি কোম্পানিকে ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন। কোম্পানি দু’টি এদিন সন্ধ্যার পরপরই রামগড়ের উদ্দেশ্যে তেলিয়াপাড়া চা বাগান এলাকা ত্যাগ করে।
পাঁচ. মেজর মোশাররফ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙ্গালি সেনা সদস্যদের বিদ্রোহকে আইওনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সীমান্তে অতিক্রমকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি “অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার” গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে জানান যে, তাঁর জানা মতে প্রায় ৭০/৮০ জনের মতো এমএনএ এবং এমপিএ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়ে আছেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানী একজন নির্বাচিত এমএনএ বিধায় তাঁকে শীঘ্রই সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্য গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযগ করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের উদ্যোগ নেবার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কর্নেল (অব.) ওসমানী এ ব্যাপারে চেষ্টার ক্রুটি করবেন না বলে জানান। ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রাজমজী, ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে এবং আগরতালার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে জানান।
এদিনের কনফারেন্সে আলোচ্য বিষয়গুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করার জন্য ১০ এপ্রিল একই স্থানে আরেকটি কনফারেন্স অনুষ্টানের সিদ্ধন্ত নেয়া হয়। ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সে মেজর শাফায়াত জামিল ছাড়া ৪ এপ্রিলের সভায় উপস্থিতদের সকলেই ছিলেন। এদিন মেজর শাফায়াত জামিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। এ দিনের কনফারেন্সে মেজর জিয়াউর রহমান ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড় থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন।
১০ এপ্রিলের অনুষ্টিত তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের আলোচ্য বিষ্যবস্তু ও সিদ্ধন্তগুলো ছিল এমন:
এক. এ দিনের সভায় প্রথমেই কর্নেল (অব) এম এ জি ওসমানীর নিকট গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘অন্তবর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেহস সরকার’ গঠনের ব্যাপারে তিনি কত দূর সফলকাম হয়েছেন তা জানাতে অনুরোধ করা হয়। কর্নেল ওসমানী এ বিষয়টি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমকারী বেশ কিছু সংখ্যক এমএনএ এবং এমপিএ’র সাথে আলোচনা করেছেন বলে জানান। অধিকাংশ গণপ্রতিনিধিই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেও তিনি উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন। তাজউদ্দিন আহমদ শীঘ্রই একটি ‘অন্তবর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের ঘোষণা দেবেন বলে কর্নেল ওসমানীকে আশ্বস্ত করেছেন বলেও তিনি সকলকে জানান। উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাগণ পুনরায় কর্নেল ওসমানীকে গণপ্রতিনিধিদের চাপ দিয়ে শীঘ্রই আনুষ্টানিকভাবে ‘অন্তবর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গথনের ব্যাপারে তাঁর প্রচেষতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান। কেননা এ কাজটি করতে দেরি হলে পাকিস্তান সরকার আমাদের মহান সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিতান্তই একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনা বিদ্রোহ হিসেবে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করবে। কর্নেল ওসমানী এবং ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে এ ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে উপস্থিত সকলকেই আশ্বস্ত করেন।
দুই. ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধটিকে সমন্বিত অ্যাকশনে রূপ দেয়া এবং কমান্ড চ্যানেলে আনার লক্ষ্যে এ দিন পুরী দেশটিকে ৬ টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ফেনী নদী পর্যন্ত (শুভপুর ব্রিজ) নোয়াখালী জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পড়ে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী জেলার অংশ বিশেষ এবং ঢাকা জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে মেজর খালেদ মোশাররফের ওপর। বৃহত্তর সিলেট জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেবার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নাজমুল হককে। আর বৃহত্তর কুষ্টিয়ান, ফরিদপুর ও যশোর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে রাখা হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে।
তিন. ৬টি অঞ্চলের কমান্ডারদের তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিত অ্যাকশনে যাবার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।
চার. সভায় ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে এবং আগরতলা জেলা ম্যাজিস্টেট সায়গল জানান যে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার লক্ষ্যে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে ইতোমধ্যেই অস্থায়ীভাবে বেশ কিছু ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। শরণার্থীদের জন্যও ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএসএফ-এর সৈন্যরা বিদ্রোহী বাহিনী গঠনের পরপরই ভারতীয় পক্ষ থেকে সাহায্যের পরিমাণ বাড়বে বলে ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে সকলকে অবহিত করেন।
পাঁচ. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষতির ব্যাপারটিও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত চ্ছিল। এ ব্যাপারে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে জানানো হয়। তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের ফলশ্রুতিতেই ১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের’ ঘোষনা দেন। ঐ ঘোষনারই আনুষ্টানিক বাস্তবায়ন ঘটে ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মাধ্যমে।
তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের সিদ্ধান্তকে অনুকরণ করেই পরবর্তীকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্টানিক ভিত রচনায় তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স একটি মাইলফলক ঘটনা হিসেবে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
[৫৭৪] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!