You dont have javascript enabled! Please enable it!

তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ, হবিগঞ্জ

মাধবপুর (হবিগঞ্জ) বাগসাইর গ্রামে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি জিপ, ট্রাক ও কতিপয় সৈন্য নিহত হওয়ার পর এ এলাকায় তাদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের ভয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের নিরীহ মানুষ বাড়ীঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এসময় শক্র সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে। তাদের এহেন নির্বিচারে জুলুম অত্যাচারে এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠে। এদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্টুরতায় মুক্তিফৌজরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী বাহিনীর কবল থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার শপথে নিয়ে মুক্তিফৌজরা সুযোগ পেলেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় মাহবুব-ই-খোদাসহ তাঁর অন্য সহযোদ্ধারা লে. মোরশেদের সাথে মাধবপুর এলাকা ছেড়ে তেলিয়াপাড়া চলে আসেন। ১৬ মে তেলিয়াপাড়ায় আবার এম্বুশ করা হয়। এ এম্বুশে ৪০ জন শক্র সেনা নিহত হয়। অপরদিকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিফৌজরা চা বাগানে সিলেট সড়কের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর দু’টি গাড়ি ধ্বংস, দু’টি গাড়ি বিকল ও ৬৫ জন সৈন্য নিহত করে। এ পর্যায়ে পাকিস্তানী বাহিনীর সাহায্যার্থে চুনারুঘাট থেকে একদল সৈন্য আসে। এ সময় মুক্তিফৌজ তাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। ফলে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। এ ভয়াবহ যুদ্ধে ৪০ জন শক্র সেনা নিহত হয়। তেলিয়াপাড়া সেক্টর হেডকোয়ার্টার দখল করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা বহু চেষ্ট করেও সফল হচ্ছিল না। মুক্তিফৌজরা তাদের চরম মনোবল ও সাহসের সাথে শক্রসেনাদের প্রতিরোধ ও নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অটুট রাখেন। অধিকন্ত মুক্তিফৌজের পরপর কয়েকটি সফল হামলার শিকার হয়ে চুনারুঘাট এলাকার পাকিস্তানী সোইন্যরা হতাশ হয়ে পড়ে। অবশেষে পাকিস্তানী সৈন্যরা চুড়ান্ত আঘাত হানার অভিপ্রায়ে চুনারুঘাটকে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দুই কোম্পানি সৈন্য আনয়ন করে। এদিকে তেলিয়াপাড়া সেক্টর হেডকোয়ার্টার দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির সৈন্যরা কয়েকদিন একটানা যুদ্ধ করে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। তেলিয়াপাড়া মুক্ত রাখতে গিয়ে তাঁর কোম্পানির ৫০ জন সৈন্য শহীদ হয়েছেন। ফলে তাদের এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। এমতাবস্থায় ১৯ মে ক্যাপ্টেন মতিনের স্থলে লে. মোরশেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে মাহবুব-ই-খোদা ও তাঁর সহযোদ্ধারা এতদিন এম্বুশ করার পর এবার এক্টর হেড কোয়ার্টার রক্ষা করার দায়িত্ব লাভ করেন। তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণের পর সিদ্ধন্ত নেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত পাকিস্তানী অতিরিক্ত সৈন্যদের তেলিয়াপাড়া চুনারুঘাট মহাসড়ক ব্যাবহার করতে দেয়া হবে না। এজন্য তাঁরা রাতের অন্ধকারে মহাসড়কে ৪টি এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন স্থাপন করে শক্রদের আগমনের প্রতীক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকেন। পাকা রাস্তার উপর স্থাপিত মাইনগুলোকে কয়লাজাত আলকাতরা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এরপর তাঁরা যেন বুঝতে না পারে সেজন্য আলকাতরার ওপর মোটরগাড়ির একটি পুরনো টায়ার চালিয়ে তার উপর চাকার দাগ বসিয়ে দেয়া হয়। এরপর পার্শ্ববর্তী জঙ্গলের মাঝে নিরাপদ স্থানে মুক্তিফৌজরা এম্বুশে অবস্থান নেয়। পরদিন সকাল ৮ টার পড়ে প্রত্যাশিত কনভয়টা আসে। প্রথম একটি জিপ, এর উপর দিয়ে চলে গেলেও কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি। এর পিছনে একটি ট্রাকও ওই স্থানটি অতিক্রম করতে গেলেই মাইন বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথে কনভয়টি স্থির দাঁড়িয়ে যায়। সমস্ত সৈন্যরা নেমে ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে মধ্যবর্তী একটি ফাঁকা স্থানে গিয়ে একত্রিত হয়। লে.মোরশেদের নির্দেশে মাহবুব-ই-খোদাসহ সমস্ত মুক্তিফৌজ তাদের অস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। আর মুক্তিফৌজরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ একটি গাড়ি হস্তগত করে। এম্বুশের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাহবুব ই-খোদা বলেন, “ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উপর ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রেখে আমরা ৪০ জন অদূরবর্তী একটা জঙ্গলের ভিতর অপেক্ষা করছিলাম। এ সময় দূরে মসজিদে ফজরের আযান শোনা গেল। আমরা ক’জন তায়াম্মুম করে নামাজ আদায় করে নিলাম। এ স্থানটি তেলিয়াপাড়ার রহমান টি গার্ডেনের উত্তর দিকে। এটি ছিল অত্যান্ত বিপদ-সংকুল। ঝোপ-ঝাড়ে ও গাছে প্রায় সর্বত্র বড় বড় অসংখ্য জোঁক দেখতে পেলাম। কাঁটাযুক্ত এসব জোঁক দেখে রীতিমতো ভীতির সঞ্চার হলো। এরই মধ্যে আমাদের কয়েকজন এই বীভৎস জোঁকের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। আমরা যে স্থানটিতে বসে গোপনে শক্রসেনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেখানেও প্রতি মুহূর্তে জোঁকের আতঙ্কে উৎকণ্ঠিত ছিলাম। তবু এরই মধ্যে অতি সতর্ক অবস্থায় আমরা সময় কাটাচ্ছিলাম”। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে একবার মাহবুব-ই-খোদার জীবনহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “ তখন সকাল প্রায় ৬টা। পাকিস্তানীদসেনাদের আগমনের কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। এদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছিল। আমার সঙ্গে লে. সেলিম (পড়ে ঢাকার মিরপুরের শহীদ), লে. আনিসসহ আরো অনেকে চীনা বাদাম ও চানাচুর দিয়েই নাস্তার কাজ শেষ করলাম। এসময় পাকিস্তানীদের গাড়ির আওয়াজ শুনে আমরা সতর্ক হলাম। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে পুরো পজিশনে চলে গেলাম। প্রথম একটি জিপ দ্রুত চলে গেল। এর একটু পরেই কয়েকটি ট্রাক বোঝাই পাকিস্তানী বাহিনী আসতে দেখলাম। দূর থেকেই শোনা গেল শক্র সৈন্যরা গান গেয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম তারা বেশ খোশ মেজাজে আছে। যেখানে এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে রেখেছি, ঠিক তার কাছাকাছি একটি ট্রাক আসতেই শক্রসৌন্যদের উল্লসিত কন্ঠে শোনা গেল, ‘তু জাহা কাহাভি যা-রে, মেররে পিয়ার ইআদ রাখ না’- গানের এ কলি শেষ হতে না হতেই দ্রিম শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হলো। ট্রাকশুদ্ধ পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ৩০ ফুট উপরে উঠে গেল। এ দৃশ্য বর্ণনার কোনো ভাষা নেই। ট্রাক টুকরো টুকরো হয়ে কোথায় ছিটকে পড়েছে, কে এর খেয়াল করে। শুধু দেখলাম শক্রসৈন্যরা যেন পাখিরা ঝাঁকের মতো উপর উঠেছে, আর সাথে সাথে তাদের খন্ডিত হাত-পা মাথা এদিকে-সেদিকে ছিটকে পড়ছে। ওই এম্বুশে আমাদের নির্দেশ ছিল পাঁচ মিনিট ধরে গুলি বর্ষণ করতে হবে। পাঁচ মিনিট শেষ হওয়ার সাথে সাথে সংকেত মতো পেছনে নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থানে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমি অবিরাম গুলি করে চলছি। কখন পাঁচ মিনিট শেষ হয়েছে, তা টের পাইনি, এমনি সংকেতের কথাও বলতে পারবো না। কিন্তু যখন আমার হুঁশ হলো তখন আমার কাছে আর কোন গুলি নেই। ওদিকে শক্র সৈন্যরা তিনটি ট্রাক থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করছে। আমার ডানে বামে আর মাথার উপর দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর কি অপার মহিমা, একটি গুলিও আমার শরীরে লাগেনি। এক পর্যায়ে দেখলাম, কতিপর শক্রসেনা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এবার পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমার পালাবার উপায় নেই-মৃত্যু অবধারিত। জীবনের চরম সংকট মুহূর্তে পরম দয়াময় আল্লাহ পাকের কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে তাঁর দয়া কামনা করলাম। হঠাৎ কোমরে হাত রাখতেই টের পেলাম আমার কাছে দুটি গ্রেনেড আছে। সাথে সাথে গ্রেনেড দু’টি বের করে শক্রদের প্রতি ছুঁড়ে দিলাম। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হবার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল। আর শক্র সৈন্যরা মাটিতে শুয়ে পড়লো। এই সুযোগে আমি ক্রলিং করতে করতে কোন দিক থেকে কোনদিকে চলে গেছি, তাঁর কোন কেয়াল নেই। এভাবে দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর পাকিস্তানীবাহিনীর একটি জিপ খালি অবস্থায় পেয়ে গেলাম, দেখলাম এর আশেপাশে কোন সৈন্য নেই। তখন চা বাগানের একজন ড্রাইভারকে ধরে এনে ঐ জিপ চালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাই। এদিকে পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, অপরদিকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলতে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরছে। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। এ অবস্থায় দুইদিন পরে ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছলাম। ক্যাম্পে গিয়ে শুনি আমাকে না পেয়ে আমার সাথীদের স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে, আমি শক্রর হাতে ধরা পড়েছি অথবা নিহত হয়েছি। কারণ, এম্বুশের নির্দেশ ছিল- মাইন বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে পাঁচ মিনিট ধরে গুলিবর্ষণ করতে হবে। পাঁচ মিনিট পর সংকেত মতো পিছনে চিহ্নিত নিরাপদ স্থানে ফিরে যেতে হবে। চিহ্নিত নিরাপদ স্থানকে বলে ‘আর-বি’। এরূপ তিনটি ‘আর-বি’ থাকে। পাঁচ মিনিট গুলিবর্ষণের পর প্রথম ‘আর-বি’তে ফিরে গিয়ে সকল সাথীদের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ‘আর-বি’তে চলে যেতে হয়। এখানেও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ সময়ের মধ্যেও যদি এখানে কোনো সাথী এসে পৌছতে না পারে তাহলে তৃতীয় ‘আর-বি’তে গিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এখানেও যদি কোনো সাথী এসে পৌছতে না পারে তখন নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া হয়, এম্বুশকালে শক্রপক্ষের হাতে সে হয় নিহত হয়েছে অথবা ধরা পড়েছে। সুতরাং তৃতীয় ‘আর-বি’তে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে ক্যাম্পে ফিরে যেতে হয়। কাজেই আমাকে কোনো ‘আর-বি’তে না পেয়ে আমার সাথীরা ধারণা করেছিল, আমি হয়তোবা নিহত হয়েছি অথবা ধরা পড়েছি। ফলে ভগ্ন হৃদয়ে তারা ক্যাম্পে ফিরে যায়”। মাহবুব-ই-খোদাকে ক্যাম্পে ফিরে পেয়ে তার সহযোদ্ধারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেন। কেউ আবার ছুটে এসে তার গলা জড়িয়্বে ধরেন। কেউ বা আনন্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দরবার শুকরিয়া আদায় করেন। তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারকে ধরে রাখার জন্য এতসব করেও তা ধরে রাখা সম্ভব হলো না। কারণ, ক্লান্ত, শ্রান্ত ক্যাপ্টেন মতিনের কাছ থেকে তেলিয়াপাড়া রক্ষার দায়িত্ব লে. মোরশেদ গ্রহণ করে। তার অনিয়মিত সৈনিকদের নিয়ে গঠিত বাহিনীর অবস্থান সুসঙ্ঘত করার আগেই পাকিস্তানীরা ব্যাপক অভিযান শুরু করে দেয়। গোলান্দাজ বাহিনীর অবিরাম গোলাবর্ষণের পাশাপাশি আরো এক ব্যাটালিয়ন অতিরিক্ত সৈন্য তেলিয়াপাড়ায় এসে মুক্তিফৌজের উপর আক্রমণে যোগ দেয়। শক্রদের প্রতিহত করার জন্য মুক্তিফৌজরা মর্টার, এসএমজি, এলএমজি ব্যাবহার করে। কিন্তু শক্ররা আবেষ্টনি ভেঙ্গে ফেলার জন্য তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করে। ফলে শক্রদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে ১৯ এপ্রিল মুক্তিফৌজরা তেলিয়াপাড়া ছেড়ে সীমান্তের ওপারে চলে যায়।
[৫২] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!