You dont have javascript enabled! Please enable it!

তাহিরপুর রণাঙ্গন, সুনামগঞ্জ

জামালগঞ্জ-তাহিরপুরে পাক-বাহিনীর অবস্থান। ভাটি এলাকার জনগণ শংকিত। সাধারণ মানুষের ও মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা যাতে নির্বিবাদে যাতায়াত করতে পারে এজন্য মুক্তিযোদ্ধারা পাক অবস্থান তাহিরপুরে ও জামালগঞ্জে ঘন ঘন চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালায়। ফলে তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ থানা সদরে অবস্থানরত পাক সৈন্যরাথানা সদর ছেড়ে বের হত না। বেহেরী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প জামালগঞ্জ-তাহিপুর পাক-বাহিনীর যাতায়াতের বিঘ্ন ঘটায়। ফলে মুক্তি বাহিনীর নৌকাগুলো অবাধে মাটিয়ান হাওড় দিয়ে দক্ষিণ দিকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করতে থাকে। অক্টোবরের মাস এভাবেই কেটে যায়।
অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় তেত্রিশ শত। এদের অনেকেই খন্ড যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ। রেশন বা নৌকার অভাব নেই, ক্রুটি নেই অস্ত্র ও গোলা বারুদের। সাহসী যোদ্ধা মেজর দীন সাব-সেক্টর কমান্ডার। অতএব সিদ্ধান্ত-তাহিরপুর জামালগঞ্জ পুনর্দখল করা চাই, যে কোন মূল্যে। প্রথমে তাহিরপুর তৎপর জামালগঞ্জ।
৯ নভেম্বর ১৯৭১ সন। তাহিরপুর থানায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। এ যুদ্ধে দুটি মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার আঃ হাই (বি. ডি. আর) ও মুজাহিদ মিয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শাহগঞ্জ, শ্রীপুর হতে এসে শুবলার গাঁও রতন শ্রী থেকে ভাটি তাহিরপুরে পাক সেনাদের আক্রমণ করে। গুলি পাল্টা গুলি চলতে থাকে সারারাত। সকালের দিকে পাক-বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম শহীদ হন, কমান্ডার মুজাহিদ গুরুতর রূপে আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হন।
১৫ নভেম্বর ১৯৭১। বিকট শব্দে আকাশ বাতাশ যেন কেঁপে ওঠে। পরিকল্পনা মোতাবেক সিক্স পাউন্ডার বোমা পাক-আর্মির তাহিরপুর অবস্থানে নিক্ষেপ করা হয়। সাথে সাথে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। জবাবে পাকসেনারাও গুলি বর্ষণ করতে থাকে। পাক সেনাদের গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, আর মুক্তিযোদ্ধারা গুলির নিচ দিয়ে ক্রলিং করতে করতে এগুছে। মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য পাক সেনাদের বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করা। তাদের দৃঢ় প্রত্যয়, তাহিরপুর তারা দখল করবেই। এরূপ জটিল পরিস্থিতিতে হঠাৎ দেখা গেল দু’জন অল্পবয়স্ক লোক মুক্তিযোদ্ধাদের সমুখ দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। জনৈক মুক্তিযোদ্ধা বলে উঠলো, ‘দেব না-কি শেষ করে স্যার ? ‘মেজর দীন উত্তরে বললেন- না। এদের আর শেষ করার কি আছে, ওরা তো এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে। রাইফেল ফেলে প্রাণের ভয়ে বাংকার থেকে পালাচ্ছে। ওরা রাজাকার, প্রাণ ভিক্ষা চায়’।
মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে ক্ষমা করে দের। হঠাৎ দূর থেকে লঞ্চের আওয়াজ শোনা যায়। সবার মনে হলো পাকবাহিনীর সাহায্যকারী দল আসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করলো। মেজর দীন নিজে অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকে ডক্তার জালাল আহমেদের মাধ্যমে কিঞ্চিৎ পেছনে অবস্থানরত মিত্র বাহিনীর মেজর বাথ ও সালেহ চৌধুরীকে অগ্রবর্তী অবস্থানের বর্ণনা দিয়ে সাহায্য চান। অন্যান্যদের সঙ্গে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী সাহায্য নিয়ে যেতে তৈরি হন। সাহায্যকারী দল যখন রওয়ানা হয়েছে, তখনই মেজর দীন বাকী সকলকে নিয়ে ফিরের আসেন। কৌশলগত কারণে তিনি এ দিনের যুদ্ধ স্থগিত রেখে দেন।
এদিন সন্ধ্যায় করাচী বেতার থেকে ফলাও করে বলা হয় তাহিরপুরের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই নিহত হয়েছে। পাক প্রচার যে কতটুকু অন্তঃসার শূন্য তা অংশ গ্রহণকারী ও সংশ্লিষ্ট সবার নিকট আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১৫ নভেম্বর যুদ্ধে তাহিরপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে না এলেও পাকসেনা ওরাজাকারদের মনোবল ভেঙে যায়। অতঃপর তার যে ক’দিন তাহিরপুর ছিল বাংকার ছেড়ে বের হয়নি। নভেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ পাকবাহিনী দক্ষিণে জামালগঞ্জ চলে যায়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তাহিরপুরে বাংলাদেশের সরকারের প্রশাসন ব্যাবস্থা কায়েম হয়ে যায়।
[৯৪] মো. আলী ইউনুছ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!