You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা, পঁচিশে ও ছাব্বিশে মার্চ

[একাত্তরে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে সাইমন ড্রিং-এর বয়স তখন ২৭ বছর। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক। বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেমন তিনি দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন পাকসেনাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ২৫ ও ২৬ মার্চের ঢাকায় পাকহানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার চাক্ষুস বর্ণনা তিনিই প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে জানান। ঢাকায় এসে তিনি শুনিয়ে গেছেন তাঁরা প্রতিবেদন সংগ্রহের কাহিনী]
পঁচিশে মার্চ সন্ধ্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন)। আমরা জনা চল্লিশকে বিদেশী সাংবাদিক তখন ছিলাম ঐ হোটেলে। কড়া হুকুম জারি করলেন ঐ ক্যাপ্টেন- হোটেলের বাইরে যাওয়া চলবে না কারো। গেলেই গুলি। প্রচ্ছন্ন হুমকি। দিনের বেলা একবার শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। খুব চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। এই নিষেধাজ্ঞার সাথে ঐ দুশ্চিন্তার এতটা যোগসূত্র মনে করে আতঙ্কিত হলাম। রাত ৯টার দিকে খবর পেলাম সেনাবাহিনীর একটি কলাম ক্যান্টেনমেন্ট ছেড়ে শহরে প্রবেশ করেছে। কি ঘটছে ? জানার জন্য মন ছটফট করলেও উপায় ছিল না। সৈন্য চলাচলের খবর দিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফোন করলাম শেখ মুজিবের বাসায়। তিনি জানালেন, বোধহয় ওরা আমাকে ধরতে আসছে। বললাম, আপনি আত্মগোপন করছেন এ কেন ? স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন, আমাকে খুঁজে না পেলে ওরা সারা শহর জালিয়ে দেবে।
রাত দশটার দিকে শুনতে পেলাম প্রথম গুলির শব্দ। অসংখ্য, অজস্র। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি করা হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছিল দু’পক্ষের মধ্যে বুঝি লড়াই বেধে গেল। কখনো-বা মনে হচ্ছিল বিষয়টা একতরফা। রাত যত বাড়ছিল গোলাগুলির শব্দ ততই বেশই হচ্ছিল। হোটেল থেকে বেরুতে না পারার অস্থিরতা নিয়ে লাল-হয়ে আসা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করছিলাম সংঘাতের ভয়াবহতা। মাঝরাতের দিকে আর থাকতে না পেরে আমরা কয়েকজন উঠে পড়লাম হোটেলের ছাদে। এই শোনা আর দেখা মিলিয়ে একটা প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠানোর চেষ্টা করলাম আমার পত্রিকায়। কিন্তু সম্ভব হলো না। টেলিফোন লাইন ছিল কাটা। জানতে পারলাম বাইরে কারফিউ দেওয়া হয়েছে। দারুন হতাশার মধ্যে ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জড়ো হলাম সুইমিং পুলের কাছে।
ছাব্বিশে মার্চ সকাল ১০টায় গেলাম শেরাটনেই অবস্থানরত জুলফিকার আলি ভূট্টোর স্যুটে। দেখলাম রাত জাগার ক্লান্তি তাঁর চোখেমুখে। সামনে এসট্রে বোঝাই সিগারেটের পোড়া টুকরো। বুঝতে চেষ্টা করলাম তিনি কিছু জানেন বা জানতেন কি না। যাই হোক, কিছুক্ষন পরেই দেখলাম সৈন্যরা ভুট্টোকে হোটেল থেকে নিয়ে যাচ্ছে। খুব ভীত দেখাচ্ছিল তাকে।
দুপুরের দিকে আবার গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। এবার পুরোনো ঢাকার দিক থেকে। তখন বিকেল ৫ টা। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম। জনশূন্য রাস্তা। চারদিকে অদ্ভুত এক নীরবতা। মাঝে মাঝে হুসহাস সামরিক ট্রাক আর জিপের আনাগোনা। এরকম অবস্থার মধ্যে হোটেলে ঢুকলেন সেনাবাহিনীর এক মেজর। নাম জানা গেল সালেক সিদ্দিক। তিনি জানালেন, মুজিবের অনুগতরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করায় তাদের সঙ্গে সৈন্যদের লড়াই হয়েছে। পরে বুঝেছিলাম কত বড় মিথ্যা ভাষণ ছিল এটা। মেজরের কাছে আমাদের ভাগ্য জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা যদি ঢাকা ত্যাগ না করো তা হলে তোমাদের জন্য এক বিশেষ পার্টির ব্যবস্থা করবো। আমি আজও জানি না ঐ ‘পার্টি’ বলতে মেজন কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। সে সময়ে মেজরের কাছে এমন ভাব করলাম যে ঢাকা ছাড়তে আমি প্রস্তুত। কিন্ত যখন সাংবাদিকদের ট্রাকে ওঠানোর জন্য জড়ো করা হচ্ছিল তখন আমি লুকিয়ে সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমের প্যাসেজ ধরে ছাদে আশ্রয় নিলাম। সঙ্গে ছিলেন এসোসিয়েটেড প্রেসের ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট, আধ ঘন্টা পরে যখন নিচে নেমে এলাম তখন হোটেলের রান্নাঘরের বাঙালি কর্মচারীরা আমাদের সবচেয়ে ভালোভাবে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
সাতাশে মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। আমি আর মাইকেল বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম পাকিস্তান সরকারের সৈন্যদের চালানো হতবাক করে দেওয়ার মতো এক ধ্বংসযজ্ঞ। পুরো শহরকে যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান অতি যত্নের সঙ্গে যা আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছিল বিশ্ববিবেকের চোখ থেকে। আমরা যে পাক আর্মির কথামতো ঢাকা ছাড়িনি কেমন করে যেন তা জেনে গেল তারা। খুব অল্প সময়ের ব্যাবধানে তিন-তিনবার হোটেলে হানা দিন ওরা। এক্ষেত্রে পুরো কৃতিত্ব দিতে হয় হোটেলের বাঙালি কর্মীদের। আমরা প্রতিবারই আর্মির চোখে এড়িয়ে লুকিয়ে থাকতে পারলাম হোটেলের রান্নাঘরেই।
ধ্বংসযজ্ঞের ২০ রোল ছবি তুলেছিল মাইকেল। এর মধ্যে জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে সে সাতটি রোল পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়। আমি আমার নোটের কাগজগুলো কোমরের বেল্টে আর মোজার ভিতর লুকিয়ে নিই। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানগামী একটি প্লেনে সিট জোগাড় করতে সক্ষম হই। বিমানবন্দরে নিরাপত্তারক্ষী আমার সঙ্গে বাংলাদেশের চারটি পতাকা দেখে সন্দেহাতুর হয়ে ওঠে। ঐ সময়ে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালেক। নিরাপত্তারক্ষী বিষয়টি মেজরকে জানাতে উদ্যত হলে আমি দ্রুত তার হাতে ম্যাপ চারটি গছিয়ে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্লেনে চড়ে বসি। করাচি বিমানবন্দরে দু’দু’বার আমার মালপত্র এবং ব্যাগেজে তল্লাশি চালানো হয়। রক্ষীরা যখন আমার সব কাপড়চোপড় খুলে দেহতল্লাশি চালাতে চাইলো তখন অভ্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে আমার নোটগুলো মোজা থেকে বের করে মেঝেতে বিছানো কার্পেটের তলায় চালান করে দিতে সক্ষম হই। করাচিতে যে কয়েক ঘন্টা ছিলাম কেবলি ছটফট করছিলাম কখন পাকিস্তানের বাইরে যেতে পারবো। অবশেষে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় ব্যাংককগামী একটি প্লেনের টিকিট পেতে সক্ষম হলাম। একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল আমার মন থেকে। সে রাতে আমার কাছে স্যাম্পেনের স্বাদ এত মধুর মনে হলো যেমনটা কখনো হয়নি।
ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান
আল্লাহ্‌র নামে আর অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ভীত নগরী।
ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ২৪ ঘন্টা গোলাবর্ষণের পর ঐ নগরীর ৭ হাজার মানুষ নিহত, বিশাল বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দাবী করেছেন বটে যে পরিস্থিতি এখন শান্ত তবু রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে গ্রামমুখী হাজার হাজার মানুষ। শহরের রাস্তাঘাট এখন ফাঁকা এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে।
তবে সন্দেহ নেই যে ট্যাঙ্কের মদদপুষ্ট সৈন্যদল শহর এবং অন্যান্য লোকালয় নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খুব কমই। যেটুকু প্রতিরোধ এখানে-সেখানে সেটুকু কার্যকর নয়। কারণে অকারণে গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে, বাড়িঘর নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিদিনই সুপ্রতিষ্টিত হচ্ছে।
ঠিক কত নিরীহ মানুষ এ পর্যন্ত জীবন দিয়েছে সে হিসাব করা খুবই কঠিন। তবে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এবং ঢাকার হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা ১৫ হাজারে দাঁড়াবে। যা মাপা যায়, তা হলো সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা। ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বিছানায়, কসাই নিহত হয়েছে তার ছোট্ট দোকানটিতে, নারী ও শিশু ঘরের ভিতর জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানীদের একসঙ্গে জড়ো করে মারা হয়েছে, বাড়িঘর, বাজার, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আর পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে সব ভবনের শীর্ষে। সরকারি সৈন্যদের দিকে হতাহতের সংখ্যা স্পষ্ট নয়। তবে শোনা যাচ্ছে, একজন অফিসার নিহত এবং ২ জন সৈন্য আহত হয়েছে।
বাঙালির অভ্যুত্থান সত্যিকার অর্থেই ভালোভাবে দমন করা গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাঁজোয়া বাহিনীর হামলা
শীর্ষস্থানীয় সব রাজনৈতিক নেতাকে ধরা হয়েছে। অন্য অনেককে করা হয়েছে হত্যা। মুজিবের আন্দোলনের সমর্থক দু’টি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার অফিস ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
তবে ২৫ মার্চ রাতে বের হওয়া ট্যাঙ্কবহরের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা। ঢাকা আক্রমণে তিন ব্যাটালিয়ান সৈন্য ব্যাবহৃত হয়। একটি সাঁজোয়া, একটি গোলন্দাজ, আর একটি পদাতিক। রাত ১০টার কিছু পরে তারা ক্যান্টেনমেন্ট ত্যাগ করে। তাদের প্রথম হামলার শিকার হয় উল্টানো গাড়ি, গাছের গুঁড়ি, আসবাবপত্র, কংক্রিট পাইপ দিয়ে দ্রুত ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টায় এগিয়ে আসা মানুষগুলো।
কেউ একজন ফোনে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দেন যে, শহরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং তিনি যেন বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করেন। তবে তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন- আমি যদি আত্মোগোপন করি তবে তারা আমার সন্ধানে নেমে সারা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।
২০০ ছাত্র নিহত
ছাত্রদেরও অনেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্ত পাকসেনাদের হামলার পরও বেঁচে যাওয়া ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল যে, তারা ভেবেছিল তাদের কেবল গ্রেপ্তার করা হবে। এরকম হত্যাকান্ডের কথা কেউ চিন্তাও করেনি।
মাঝরাতের ঠিক পরপরই আমেরিকার দেওয়া বিশ্বযুদ্ধে ব্যাবহৃত এম-২৪ ট্যাঙ্কের ছত্রচ্ছায়ায় এক কলাম সোইন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। সৈন্যরা ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেটাকে ঘাঁটি বানিয়ে ছাত্রাবাসগুলোতে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সরকারবিরোধী জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি বলে পরিচিত ইকবাল হলে গোলানিক্ষেপ আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে ২০০ ছাত্র নিহত হয়। এ ধরনের হামলায় নিরস্ত্র ছাত্ররা স্পষ্টতই বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল।
দু’দিন পরও দেখা গেল পোড়া রুমের মধ্যে পড়ে-থাকা লাশ, বারান্দায় আর মাঠে লাশ, সবচেয়ে বেশি লাশ দেখা গেছে হলের পাশের লেকে। চিত্রকলার এক ছাত্রের উপুড় লাশ উপুড় হয়ে পড়ে ছিল তার ক্যানভাসের ওপর। কোয়ার্টারে বসবাসকারী ৭ জন শিক্ষক নিহত হন। আউট হাউসে ১২ সদস্যের একটি পরিবারকে গুলি করে মারা হয়। অন্য একটি হলে ছাত্রদের মেরে দ্রুত কবর খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে তারপর ট্যাঙ্ক দিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারী অন্য সাধারণ লোকজনকেও রেহায় দেওয়া হয়নি। একটি রেললাইন বরাবর ২০০ গজ এলাকার বস্তিঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিকটস্থ একটি মার্কেটেও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দোকানের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা লোকজন মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারায়। কাঁধ পর্যন্ত তেনে দেওয়া কম্বলের তলায় মনে হচ্ছিল তারা যেন ঘুমিয়েই আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাজুকা ছোড়া হয়। একটি মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর আক্রান্ত
একদিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হয়, অন্যদিকে আর এক কলাম সৈন্য পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগ আক্রমণ করে। ট্যাঙ্ক প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে সৈন্যরা ঢুকে ঘুমন্ত পুলিশের ব্যারাক মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এই হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায়নি তবে ধারণা করা হয়, ঐ সময়ে সেখানে অবস্থানকারী ১১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কজনই রেহাই পেয়েছিল।
এই অবস্থার মধ্যে অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাসভবন ঘিরে ফেলে। রাত ১টার ঠিক আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি অনেক আগেই এ ধরনের হামলার আশঙ্কা করেছিলেন এবং কয়েকজন কাজের লোক ও দেহরক্ষী বাদে অন্যদের অন্যাত্র সরিয়ে দিয়েছিলেন। মুজিবের এক প্রতিবেশী পরে জানান, রাত ১টা ১০ মিনিটে একটি ট্যাঙ্ক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাক-বোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে মুজিবের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলেন, ‘শেখ আপনি বাইরে আসুন’। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে মুজিব বলেন, ‘ হ্যাঁ আমি প্রস্তুত, এত গোলাগুলির দরকার ছিল না, আমাকে ফোন করে দিলে আমি নিজেই হাজির হতাম’।
অফিসারটি এবার বাড়ির বাগানে ঢুকে বললেন, ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো’। তিনজন কাজের লোক, একজন সহকারী আর দেহরক্ষীসহ মুজিবকে নিয়ে গেল তারা।
সব দলিলপত্র নিয়ে যাওয়া হলো
শেখ মুজিবকে সেনা সদর দপ্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেক দল সৈন্য ঢোকে বাড়ির ভিতর। তারা বাড়িতে রক্ষিত দলিলপত্র নিয়ে যায়, চোখের সামনে যা পায় তা-ই ভাংচুর করে, বাগানের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের লাল, সবুজ, হলুদ পতাকা গুলি করে নামিয়ে ফেলে।
রাত ২টা নাগাদ সারা ঢাকা পরিণত হলো জ্বলন্ত নগরীতে। সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকা দখল করে নিলো এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের গুলি করে মারতে ও স্বাধীনতার পতাকা বদলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যদিও কোনো কোনো এলাকায় মাঝে মাঝে ভারি অস্ত্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল তবুও বোঝা যাচ্ছিল যে, যুদ্ধের তীব্রতা কমে এসেছে। ইতিমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উলতাদিকে অবস্থিত খালি-পড়ে-থাকা ‘পিপল’ পত্রিকার অফিসে এক প্লাটুন সোইন্য ঢুকে সেটিকে জ্বালিয়ে দেয় এবং সে অফিসের একমাত্র নৈশ্যপ্রহরীকে গুলি করে হত্যা করে।
সকাল নাগাদ গোলাগুলি প্রায় থেমেই গেল। যত বেলা বাড়তে লাগলো শহর জুড়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা জেঁকে বসলো-যেন মৃত নগরী। থেমে থেমে কাকের ডাক আর সশব্দ সামরিক গাড়ির অস্তিত্ব ছাড়া আর যেন কিছুই ছিল না। তবে সবচেয়ে খারাপটা তখনও বাকি ছিল। মাঝ-দুপুর নাগাদ বিনা নোটিশেই কয়েক কলাম সৈন্য ঢাকার পুরানো অংশে হামলা চালায়। সংকীর্ণ অলিগলিতে প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস সেখানে। পরবর্তী ১১ ঘন্টা ধরে পাকসেনারা এসব এলাকায় যেন বেশ গুছিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালালো। মুজিবের সমর্থকদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল ঐসব এলাকা। ইংলিশ রোড, নয়াবাজার, ফ্রেঞ্চ রোড, সিটিবাজার এলাকায় হাজার হাজার লোকের বাসস্থান পুড়িয়ে দেওয়া হলো। ফ্রেঞ্চ রোড-নয়াবাজার এলাকায় এক বৃদ্ধের ভাষায়, ‘ওরা হঠাৎ যেন গলির মাথায় উদয় হতো আর ওই গলির সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিত’।
প্রথমে আসত একদল সৈন্য। তাদের অনুসরণ করতে করতে পেট্রোলের টিন হাতে আরেক দল আগুন লাগিয়ে দিত। যারা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত তাদের গুলি করে মারা হতো। আর যারা ভিতরেই থাকত তারা জীবন্ত দগ্ধ হতো। ঐদিন বেলা ২টার মধ্যে পুরানো ঢাকার ৭০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। আর একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অন্য আরো তিন এলাকায়। সৈন্যরা চলে যাওয়ার সময়ে টার্গেট থেকে আরেকটা টার্গেটে হামলা চালায়। পুরানো ঢাকায় তারা একটি থানাতেও হামলা চালায়। একটি বাজারের ধ্বংসস্তূপে দেখা হলো এক পুলিশ ইনস্পেক্টরের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমরা কনস্টেবলদের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছ। আমার সঙ্গে ২৪০ জন ছিল, এ পর্যন্ত ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি-সবাই মৃত’।
পাকসেনাদের এই অভিযানে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় পুরানো ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দাদের সৈন্যরা ঘর থেকে বের করে এনে দল বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। তারপর জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। রাত ১১টা পর্যন্ত সৈন্যরা পুরানো ঢাকায় অবস্থান করে। সৈন্যরা ফ্লেয়ার ছুড়লে বাঙালি ইনফরমাররা আওয়ামী লীগের শক্ত সমর্থকদের বাড়ি দেখিয়ে দিত, তারপর সৈন্যরা ট্যাঙ্কের গোলায়, রিকয়েললেস রাইফেলের গুলিতে অথবা স্রেফ পেট্রোল জ্বেলে আগুন ধরিয়ে ঐসব বাড়ি ধ্বংস করে দিত।
টঙ্গি এবং নারায়নগঞ্জ ছিল শেখ মুজিবের সমর্থক বামপন্থিদের ঘাঁটি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের পাঠানো হয় ঐসব এলাকায়।
শহর এলাকায় রোববার সকাল পর্যন্ত গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। তবে বড় ধরনের অভিযানগুলো ২৬ তারিখ রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সময় লাগে শুরু হওয়ার পর থেকে ঠিক ২৪ ঘন্টা।
সৈন্যদের শেষ টার্গেটগুলোর অন্যতম ছিল বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস। পাকসেনাদের হামলা শুরু হওয়ার সময়ে সেখানে ৪০০ সৈন্য আশ্রয়। ২৬ মার্চ বিকেল ৪টা নাগাদ চারটি ট্যাঙ্ক এসে দাঁড়ায় ইত্তেফাক ভবন-সংলগ্ন রাস্তায়। আর সাড়ে ৪টায় ঐ ভবনটি পরিণত হয় অগ্নিপিন্ডে। শনিবার সকালে ঐ বিল্ডিঙে কয়লা-হয়ে যাওয়া মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
যত দ্রুত সৈন্যরা শহরের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিল ঠিক ততটা দ্রুতই তারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। শনিবার সকালে রেডিওতে সকাল ৭ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। রেডিওর ঘোষণায় সামরিক আইনের বিধানগুলো বারবার বলা হতে থাকে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সরকারি কর্মচারিদের কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং ব্যাক্তিগত অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাজার হাজার মানুষের পলায়ন
আস্তে আস্তে যেন ত্রাস কমে গেল আর ভোজবাজির মতো নগরীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এল। বেলা ১০টা নাগাদ রাস্তাগুলো ভরে উঠলো পলায়নমান মানুষের ভিড়ে। যদিও এখানে-সেখানে তখনও দেখা যাচ্ছিল কালো ধোঁয়ার রেখা। কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায়, কেউবা হেঁটে। সবার সঙ্গে লটবহর। ঢাকার মানুষ পালাচ্ছে হাজার হাজার। আর শোনা যাচ্ছিল কখনো কখনো করুণ আর্তি-‘দয়া করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান, আমি বৃদ্ধ, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমার বাচ্চাটিকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান’।
সরকারি অফিসগুলো ফাঁকা। শত শত কর্মচারী পালিয়ে যাচ্ছে গ্রামের দিকে। আর যারা শহরেই রয়ে গেছে তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব ধ্বংসস্তূপের মাঝে, এক সময়ে যা ছিল তাদের বাসস্থান। বোঝাই গাড়িগুলো ছুটছিল। হয় তাতে ছিল গ্রামমুখী মানুষ অথবা রেডক্রসের পতাকা লাগিয়ে মৃতদেহ অথবা আহতদের বহন করছিল। আর সবকিছুর মাঝখানে মাঝে মাঝেই উদয় হচ্ছিল সৈন্যদের গাড়ি। বিরস বদনে জনতার দিকে বন্দুক তাক করে তাকাচ্ছিল ওরা। জানা গেছে, শুক্রবার রাতে যখন তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তখন তারা ধ্বনি দিচ্ছিল নারায়ে তাকবির-যার অর্থ আমরা যুদ্ধে জিতেছি। আর শনিবারে তারা শ্লোগান দিচ্ছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

বেশিরভাগ মানুষই পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করছিল। পেট্রোল ছাড়া ঐ সময়ে পাকিস্তানি পতাকাই ছিল বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য। নিজেদের অনুপস্থিতিতে বাড়িঘর সম্পদ রক্ষার জন্য তারা যা করছিল তা হলো দরজার তালা দেওয়া আর ছাদে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো।
চারটা নাগাদ রাস্তা আবার ফাঁকা হয়ে পড়লো। রাস্তায় সৈন্যরা অবস্থান নিলো। আর সারা শহরে নেমে এল সুনসান নীরবতা। কিন্তু অল্প সময় পর গুলির শব্দ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিলো। রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হলো কেউ ঘরের বাইরে এলেই গুলি করা হবে। কারফিউ পুনরায় আরোপিত হওয়ার ২ মিনিট পর রাস্তায় বের হওয়ার অপরাধে ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে ছোট্ট একটি বালককে প্রহার করে জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা ক্লাবের একজন গার্ড ক্লাব ভবনের গেট লাগাতে এসে পাকসৈন্যদের গুলিতে মারা যায়। রেসকোর্সের মাঝখানে মন্দিরের আশেপাশের বাসিন্দা একদল হিন্দুকে গুলি করে মারা হয় এই অপরাধে যে তারা খোলা জায়গায় ঘোরাফেরা করছিল।
রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থানকারী সৈন্যরা ছাড়া পুরো রাস্তা ছিল ফাঁকা। একমাত্র ওই সৈন্যরা ছাড়া আর কারো পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল না আসলে কী ঘটেছে। সড়কপথের ভিড় এরাতে গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য অনেকেই বেছে নিয়েছিল নদীপথ নৌকার জন্য নদীর তীরে অপেক্ষা করতে করতেই আবার শুরু হয়ে গিয়েছিল কারফিউ। পরদিন সেখানে দেখা যায় চাপ চাপ রক্তের দাগ।
‘বিশ্বাসঘাতকরা’অভুযুক্ত
ঢাকা অথবা প্রদেশের অন্য কোথাও সংগঠিত কোনো প্রতিরোধের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো কোনো পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারও এ ধরনের কোনো কথা উল্লেখ করেননি। একজন পাঞ্জাবি লেফটেন্যান্টের ভাষায়, ‘এই মানুষগুলো এমনকি চাইলেও আমাদের ওপর পাল্টা আঘাত করতে পারবে না’। অন্য আরেক অফিসার বলেন, ‘অবস্থা এখন অনেক ভালো। কেউই একটি শব্দ উচ্চারণ করতে বা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তারা বিশ্বাসঘাতক, আমরা তা নই। আমরা পাকিস্তান-রক্ষার জন্য আল্লাহ্‌র নামে লড়াই করছি’।
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের পরিকল্পিত এবং পরিচালিত এই অভিযান বাংলার মানুষের সর্বশেষ প্রতিরোধের ক্ষমতা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। শুধু ভারতীয় সরকারের প্রচারযন্ত্র এবং ঢাকার বাইরের কোনো একস্থান থেকে বামপন্থিদের বাংলাদেশ রেডিও ছাড়া কোথাও চলমান যুদ্ধের কোন খবর পাওয়ার উপায় ছিল না। এমনকি যে-ভয়াবহ ক্ষতি পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বপ্নের অবসান ঘটানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সময়ের ব্যাবধানে তা শুকিয়ে গেলেও গত সপ্তাহে চালানো রক্ত-হিম-করা হত্যাকান্ডে এবং ধ্বংসযজ্ঞের যে স্মৃতি তা প্রজন্মান্তরেও ভোলা সম্ভব হবে না।
শেখ মুজিবের আন্দোলনের ধ্বংসস্তূপ থেকে যদি কিছু বেরিয়ে আসে তা হলো এই সত্যবোধ যে, সেনাবাহিনীকে কখনোই আর ছোট করে দেখা যাবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যতই জনগনকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলুন না কেন, তিনি কখনোই কোনো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না তা সে বৈধভাবেই জেতা হোক বা না-হোক।
সাইমন ড্রিং
অনুলিখন : আলমগীর আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!