You dont have javascript enabled! Please enable it! ঢাকায় গেরিলা অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন

[ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা শুধু ঢাকাবাসীকেই নয় সারাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে রাখত একাত্তরের দিনগুলিতে। একাত্তরের ঢাকা শহরের উল্লেখযোগ্য কিছু অপারেশনের কথা এখানে সংকলিত হলো। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা তখন আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমেও স্থান পেয়েছিল।]
২নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং গেরিলা প্রশিক্ষক ছিলে মেজর এ. টি. এম হায়দার। অক্টোবরে মেজর খালেদ মোশাররফ যুদ্ধে আহত হলে এই সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর হায়দার।
খালেদ মোশাররফ বলতেন, “ যুদ্ধ হবে তিন ফ্রন্টে-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক। সামরিক ফ্রন্টের জন্য রয়েছে নিয়মিত সেনাবাহিনী, অন্য দু’টি ফ্রন্টের জন্য প্রয়োজন সারা দেশের তরুণ সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, সাংবাদিক,-সকল স্তরের স্বাধীনতাকামী মানুষ। তাদেরকে এখানে নিয়ে আসতে হবে”। তিনি মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদলকে বলেন, “এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। এ জন্য দরকার রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলা বাহিনী। তুমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। যারা আসতে চায়, মুক্তিযুদ্ধ করতে চায়, তাদের এখানে পাঠাতে থাক”। “ ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য আমার প্রচুর ছেলের দরকার। অথচ আওয়ামী লীগের ক্লিয়ারেন্স, ইউথ ক্যাম্পের সার্টিফিকেট বা ভারত সরকারের অনুমোদন পেরিয়ে যে কয়টা ছেলে আমাকে দেওয়া হয় তা যথেষ্ট নয়। যত পার সরাসরি ছেলে রিক্রুট করে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতিয় যুদ্ধ। দলমত নির্বিশেষে যারাই দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসবে, তাদের সবাইকে আমি সমানভাবে গ্রহণ করব”।
ঢাকা শহরে শত শত ছেলের গেরিলা অপারেশন ছিল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়া, শহর জুরে তাদের ব্যতিব্যস্ত এবং আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখা। বিদেশী সাংবাদিক এবং বিদেশী অর্থনৈতিক সাহায্যদাতা সংস্থার লোকজনদের বোঝানো যে পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত শান্ত পরিস্থিতি শান্ত নয়, এখানে পাকবাহিনীর নাকের ডগায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং আক্রমণ চলছে। ঢাকা শহরের পাওয়ার স্টেশনগুলো এবং অন্যান্য কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিদিনই হামলা চলছে, ফাটছে বোমা কিংবা গ্রেনেড। এঁদের সঙ্গে সবসময় সহযোগিতা করেছে সাধারণ মানুষ। এই সহযোগিতা না হলে এইসব অপারেশন পরিচালনা অসম্ভব ছিল এবং এ কারনেই বিশ্ববাসী জেনেছিল ঢাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নয়। পাক-আর্মি কতৃক সুরক্ষিত নগরী ঢাকা মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে পেয়েছিল ভিন্ন চরিত্র।
৯ জুন : প্রথম সাফল্য
মুক্তিযোদ্ধা মায়া লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে অর্থাৎ মে মাসের শেষের দিকে আগরতলার এক ক্যাম্পে আমাদের ‘কমান্ডো’ আক্রমণের কলাকৌশল সম্পর্কে ক্লাস নিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার (পরবর্তীকালে কর্নেল)। ক্লাস চলাকালে ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন ২নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল)। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে দৃঢ় করার জন্য সংক্ষিপ্ত এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। এরপর তিনি একটি ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ গঠন করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো এই স্কোয়াডের ১৬ জনের একটি দলকে রাজধানী ঢাকা শহরে পাঠানো হবে। … জুনের প্রথমে আমাদের ১৬ জনের দলটি ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। আমাদের এই ১৬ জনের কাছে জনপ্রতি ৪টি করে গ্রেনেড এবং ২০ পাউন্ড করে বিস্ফোরক ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। … ৬জুন আমরা ঢাকা শহরে প্রবেশ করি”।
এর আগে দশ দিন ধরে বিশ্বব্যাংক মিশন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেছে। জাতিসংঘের হাই কমিশনার ফর রিফিউজীজ প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানও ঢাকায়। কারণ ইয়াহিয়া সরকার জাতিসংঘকে বোঝাতে পারছেন না যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা কেবল কিছু সংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ মাত্র। এদেরকে দমন করার পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে এবং সশস্ত্র সেনাবাহিনী রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজে প্রাদেশিক সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করছে। রেডিও, টেলিভিশন, খবর কাগজ ইত্যাদি প্রচার মাধ্যমগুলোতে বারবার গলা উঁচু করে চিৎকার করার পরও পাকিস্তান সরকার বিশ্বব্যাংক কতৃপক্ষের চোখে ধুলো দিতে পারছিল না। ফলে এ সময়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের চাহিদা যাচাই, মে-জুন মাসের কিস্তি ৩ কোটি ডলার শোধ দেওয়া এখন সম্ভব নয় বলে পাকিস্তান কনসর্টিয়ামের কাছে ৬ মাস সময় চেয়ে আবেদন করেছিল ইত্যাদি বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য বিশ্বব্যাংকের এইড-টু পাকিস্তান কনসর্টিয়ামের সেক্রেটারী জেনারেল উ’থান্ট বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে যে সাহায্য দেয়া হবে তা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। পাকিস্তান সরকার তাতে রাজী নয়। ইয়াহিয়া সরকার বিবৃতি দিয়েছে যে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গোলযোগের সময় যেসব প্রকৃত পাকিস্তানী, বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতকারীদের ভীতি ও হুমকি প্রদর্শনের মুখে পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য হয়ে সীমান্তের অপর পারে গমন করেছেন’ তাদেরকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করবেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে ভারত থকে পূর্ব পাকিস্তান প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইত্যাদি ব্যাপারগুলো দেখার জন্য এসেছেন প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান।
এরা সবাই অবস্থান করছেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে-মার্চের শুরু থেকেই এই হোটেলটি ছিল আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ২৬ মার্চ সকালে ভুট্টো এখান থেকে করাচী পালিয়েছিল। এই হোটেলে ৯ জুন ৭-৩০ মিনিটে সামরিক শাসকরা বিদেশী সাংবাদিক ও সাহায্যদাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সম্মানে ডিনারের আয়োজন করে। ঢাকায় অবস্থানরত গেরিলারা এই সময়টিতে উপযুক্ত সময় বলে নির্ধারণ করে।
শুধুমাত্র গ্রেনেড ছুঁড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ৬ জনের একটি দল তৈরি হয়। এই দলে ছিল বাদল, চুন্নু, স্বপন, মায়া, জিয়া ও আলম। সেদিন ৬-৩০ মিনিটে এরা গুলশান থেকে একজন অবাঙালির একটি গাড়ি হাইজ্যাক করে। গাড়ি নিয়ে এরা সিদ্ধেশ্বরীর এক বাসায় আসে। সেখান থেকে ৮টি গ্রেনেড নেয়। হোটেলের সামনের দিকে গাড়ি থামিয়ে তিনজন নামে এবং দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। তখন হোটেলের সামনের দিকে কয়েকটি বড় গাছ ছিল। ওরা হোটেলের মূল প্রবেশপথে পরপর তিনিটি গ্রেনেড ছোঁড়ে। একটি গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল হোটেলের পোরচে রাখা বিশ্বব্যাংকের গাড়ির ওপর। অপর দু’টি হোটেলের সামনের বারান্দার দু’পাশে। ইন্টারকন থেকে ওরা সোজা চলে আসে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজারে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির কর্মকর্তা এডভোকেট এ. কিউ. এম. শফিকুল ইসলামের বাসায়। সেখানে শান্তি কমিটির লোকজনের সভা হচ্ছিল। গাড়ি নিয়ে ওরা বাসায় ঢুকে পড়ে এবং তিনটি গ্রেনেড ছোঁড়ে।
ওখান থেকে ওরা যায় দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকার অফিসের সামনে। গেটের সামনে পাহারায় ছিল পাঞ্জাবী দারোয়ান ও মিলিশিয়া জওয়ান। গাড়ি থেকে ছোঁড়া হয় গ্রেনেড। কিন্ত গ্রেনেড ছোঁড়ার সময় জামার আস্তিন আটকে গিয়েছিল গাড়ির দরজার লকে। ফলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
এরপর এরা পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে সেখানে গাড়ি ফেলে নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে যায়।
এরা ছিল ঢাকা নগরীর আতঙ্ক তৈরিকারী ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। মায়াকে ২নং সেক্টর থেকে এই প্লাটুনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। এজন্য এই দল ‘মায়া ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে পরিচিত ছিল। “গেরিলা কর্মকাণ্ডের ক্রম বিস্তৃতিতে পরবর্তী ধাপে মায়া ক্র্যাক প্লাটুন যে অপারেশনগুলির পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিশেষভাবে সেগুলি ছিল (১) ফার্মগেট অপারেশন (২) দুঃসাহসিক উলান পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (৩) গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (৪) ওয়াপদা পাওয়ার হাউস রেইড (৫) কাঁটাবন মসজিদের উত্তর পার্শ্বস্থ বৈদ্যুতিক স্টেশনে হামলা। (৬) হোটেল ইন্টারকনের বিস্ফোরণ ইত্যাদি। এছাড়া এনারগা রকেট যোগে এম-পি হোস্টেল আক্রমণও ছিল এই পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যাতে ব্রিগেডিয়ার বশীর, লে. কর্নেল হেজাজীর মতো পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররাও ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। এম-কে ১৬ মাইন সংস্থাপন করে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসও এই সময়ের ব্যাপার। এগুলি সবই ছিল জুলাই-আগস্ট মাসের ঘটনা”।
১৮ জুলাই : গ্যানিজ ও ভোগ আক্রমণ
এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল তিনজন-মায়া,মনু এবং গাজী, দস্তগীর। ১৭ তারিখে ওরা রেকি কাজ সম্পন্ন করে এবং পরদিন বিকেল চারটায় ৯০ সিসি হোন্ডায় চেপে ঘটনাস্থলে আসে। সঙ্গে ছিলো একটি স্টেনগান, কয়েকটি গ্রেনেড ৩৬ ও ফসফরাস বোমা। একটি টয়োটা গাড়িতে করে এদেরকে কভার দিয়েছিল সামাদ, উলফত ও জুয়েল।
গেরিলারা হোন্ডা সিসিটি নিয়ে এসেছিল একজন অবাঙালির কাছ থেকে। চালাচ্ছিল মানু তার পেছনে মায়া, শেষে গাজী। গাজীর কাছে ছিল স্টেনগান। নির্ধারিত জায়গায় এসে ওরা দেখলো প্রতিদিনকার মতো চারজন পুলিশ গ্যানিজের পাহারায় রয়েছে। ওরা রেকি করে এসে তৈরি হলো অপারেশনের জন্য। রেকি করার সময়ই মায়া এবং গাজী কালো রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে নিয়েছিল। হোন্ডা এসে থামতেই লাফিয়ে নামলো গাজী, দৌড়ে চলে গেল মেইন গেটের কাছে। দৌড়ানো অবস্থাতেই স্টেনগানে ম্যাগাজিন ভরে নিল। তার পেছনে ছিল মায়া। সে চিৎকার করে বললো, হ্যান্ডস আপ। পুলিশরা হতভম্ব। দোকানের ভেতরের ১২/১৩ জন লোক লুকানোর চেষ্টা করছে। গাজী মুহূর্তেই পুলিশ চারজনের দিকে ব্রাশ ফায়ার করলো সঙ্গে সঙ্গে মায়া দোকানের ভেতরে ছুড়লো গ্রেনেড-৩৬ এবং পরে একটি আগুনে ফসফরাস বোমা। চকিতে চারপাশের রাস্তা শূন্য হয়ে যায়। মানুষজন পালাচ্ছে, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা দেখলো হোন্ডার ওপর বসে রয়েছে মানু এবং কভার দেয়া গাড়িটি স্টেনের নল বের করে রেখে আড়াআড়িভাবে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
ওখান থেকে বেরিয়ে ওরা ভোগের উদ্দেশ্যে রওনা করে। দ্রুতবেগে ছুটে চলে হোন্ডা। হোন্ডাতে ওটার আগে একটি ‘পিন-আউট’ করে ফসফরাস গ্রেনেড মায়া গাজীর হাতে তুলে দেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে ওরা। কারণ একটু বেশি ঝাকুনি লাগলে পিন-আউট করা ফসফরাস বোমার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ঘটনাস্থলে এসে দেখতে পায় যে ভোগের কর্মচারী দোকান বন্ধ করার চেষ্টা করছে। শাটার মাত্র আর এক হাত খোলা। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে সেই দরজা লক্ষ্য করে চলন্ত হোন্ডা থেকে ফসফরাস বোমা ছুঁড়ে মারে গাজী।
‘গ্যানিজ’-এর অপারেশনে অংশগ্রহণকারী জুয়েল পরবর্তী সময়ে শহীদ হয়। একই অপারেশনে নিহত হয়েছিল ৪ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ।
১৯ জুলাই : উলান অপারেশন
এই দলে ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের ৬ জন সদস্য। এরা হলো গাজী, দস্তগীর, হাফিজ, নীলু, জিন্না, মতিন নম্বর এক মতিন নম্বর দুই। অপারেশনের নেতৃত্ব দেয় গাজী।
ট্রান্সফরমার উড়ানোর জন্য ওরা সঙ্গে নেয় ২০ পাউন্ড পিকে ও ১৫ ফুট প্রাইম কর্ড, প্রায় তিন মিনিট মেয়াদী সেফটি ফিউজওয়্যার এবং ডেটোনেটর দশ পাউন্ড করে পিকের দু’টি চার্জ প্রাইমা কর্ড দিয়ে সংযোজিত করে ট্রান্সফার্মারের দু’পাশে ফিট করা হবে বলে ঠিক করা হয় এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় অপারেশনের অগ্রগামী দল হিসেবে থাকবে গাজী ও লীলু, সঙ্গে স্টেনগান। এক নম্বর মতিন ট্রান্সফর্মারের দু’পাশে ফিট করা হবে বলে ঠিক করা হয় এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় অপারেশনের অগ্রগামী দল হিসেবে থাকবে গাজী ও নীলু, সঙ্গে স্টেনগান। এক নম্বর মতিন ট্রান্সফর্মারের গায়ে চার্জ বসাবে। জিন্না গেট পাহারায় থাকবে একটি রিভলবার নিয়ে। দুই নম্বর মতিন টেলিফোনের লাইন কেটে দেবে। স্টেনগানের সাথে আরো নেয়া হয় গ্রেনেড-৩৬ ।
অপারেশনের সময় ছিল রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টা। ট্রান্সফর্মার এলাকা ছিল তারকাটার বেড়া দিয়ে ঘেরা। পাওয়ার স্টেশনের পুলিশ ও দারোয়ানদের ‘হ্যান্ডস আপ’ করিয়ে রেখে ওরা ট্রান্সফর্মারের গায়ে চার্জ বসায়। এর কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সমগ্র এলাকা। ধ্বংস হয়ে যায় ৩০/৪০/৫০ এম ভি এ ট্রান্সফর্মারটি, মেরামতেরও উপযোগী ছিল না এটি। ফেরার পথে রামপুরা টিভির মিলিটারিরা রাস্তার ওপর পজিশনে নিলে গেরিলাদের বিল সাঁতরে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়েছিল। এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী হাফিজ পরবর্তীকালে শহীদ হয়।
গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন
উলানের সঙ্গে একই দিনে একই সময়ে এই অপারেশন কাজ সংঘটিত হয়। এতে অংশ নিয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের আটজন-পুলু,সাঈদ, জুয়েল, হানিফ, মুখতার, মোমিন, মালেক ও বাশার। এই অপারেশনের জন্য ওরা নিয়েছিল ৪০ পাউন্ড পিকে। ২০ পাউন্ড পিকের দু’টো চার্জ বানানো হয়েছিল দু’টি ট্রান্সফর্মারের জন্য। ট্রান্সফর্মগুলোর গায়ে চার্জগুলো বাঁধা দৈরঘের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছিল ডেটোনেটর-২৭। ১ মিনিটের ফিউজ ওয়্যার দেয়া হয়েছিল। প্রথমবার চার্জ লাগানোর পর পুলু দেখলো যেখানে লাগানো হয়েছে তাতে ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করা যাবে কিন্ত ‘বেস-বার’ উড়ানো যাবে না। ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার নতুন পজিশনে চার্জ লাগায়। আটটা চুয়াল্লিশ মিনিটে পুলূ ইগনাইট করে। আটটা সাতচল্লিশ মিনিটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ট্র্যান্সফর্মারের মাথা উড়ে গিয়ে পরে পাশের বাড়ির টিনের চালের ওপর। অন্ধকারে ডুবে যায় পুরো এলাকা। বিধ্বস্ত হয় ওয়াপদার ৩৩/৩১ কে ভি গুলবাগ পাওয়ার-সাব-স্টেশন। ৫ এম ভি এ বিশিষ্ট ট্রান্সফর্মারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরই উলান পাওয়ার স্টেশন বিধ্বস্ত হয়।
২ আগস্ট : খিলগাঁও বাজার
এই অপারেশনে ছিল তিনজন গেরিলা : ফারুক, সালাম ও মুজিবুর। বাজারে পাকিস্তানী সেনারা প্রায়ই অত্যাচার করতো। বিনে পয়সায় জিনিসপত্র নেয়া ছাড়াও টাকা-পয়সা ওঠাতো। ঘটনার দিন গেরিলারা রামপুরা থেকে গাড়ি হাইজ্যাক করে খিলগাঁও বাজারে আসে। ফারুক ও সালামের কাছে ছিল রিভলবার এবং মুজিবরের কাছে স্টেনগান। বাজারে তখন তিনজন পাকিস্তানী সেনা লোকজনকে হ্যান্ডস আপ করিয়ে টাকা-পয়সা নিচ্ছে। পেছন দিক থেকে মুজিবর গিয়ে স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওকে কভার দেয় ফারুক ও সালাম।
৩ আগস্ট : স্টেট ব্যাংকের গেট
এই দলে ছিল ৫ জন গেরিলা। সবাই ক্র্যাক প্লাটুনের। এরা হলো সিরাজ, মুজিবর, আজহার, হাবীব ও খালেদ। এঁদের অস্ত্র ছিল একটি স্টেনগান ও দু’টি হ্যান্ডগ্রেনেড। বিস্ফোরণ ঘটায় একটি ‘প্লোটার চার্জ’। ওতে ছিল ২০ পাউন্ড পিকে এবং ৭ সের ইসপিলিন্টার।
স্টেট ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন। সে কারণেই এর প্রতিটি প্রবেশপথে অত্যান্ত কড়া পাহারা থাকতো। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাবধানে সে পাহারার বদল হতো। এই পাহারায় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করা হতো। ব্যাংকের একপাশের বাংকারে পাহারায় থাকতো পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। ব্যাংকের ভবনের দেয়াল ঘেঁষে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের দু’টো ক্যাম্প। এই পাহারার দুর্ভেদ্য দুর্গ ভেদ করে ওরা ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিল দুররানীর ঢাকা আগমনের সময়টায়। দুররানী ছিল পি. আই. এ-তে বাঙালি বিরোধী চক্রান্তের হোতা। বাঙালিরা তার নাম তখন ঘৃনায় উচ্চারণ করতো। সে নতুন দায়িত্ব নিয়ে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হয়। আগস্ট মাসের শুরুতে সে ঢাকায় আসছে চারদিনব্যাপী এক সম্মেলন উদ্বোধন করতে। এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্টানসমূহের প্রধান কর্মনির্বাহকরা।
ঘটনার দিন আজাহার ব্যাংকের একজন পিয়নের সাহায্যে বেলা বারোটায় রেকি কাজ সম্পন্ন করে। সন্ধ্যা ছয়টায় ওরা রিক্সায় করে আসে। ঠিক হয় সিরাজ ও আজহার বিস্ফোরক প্লেটারটি নিয়ে ব্যাংকের উত্তর দিকের গেটে পুলিশদের বাংকারের পাশে বসাবে। হাতের আড়ালে স্টেনগান লুকিয়ে মুজিবর কভার দেবে। গ্লাক্সোর দফতর ভবনের কাছে খালেদ ও হাবীব গ্রেনেড নিয়ে তৈরি থাকবে।
পরিকল্পনা মাফিক সিরাজ ও আজহার প্লেটার চার্জ নিয়ে এগিয়ে এল। বাক্সটি ছিল ওজনে ভারী এবং দেখতে অদ্ভুত। পাহারারত পুলিশরা সন্দেহ করে এগিয়ে আসে। বেকায়দা দেখে আজহার ও সিরাজ ওটা রেখে দূরে সরে যায়। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় মুজিবর। এক মুহূর্তে দেরি করলে সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। অদ্ভুত জিনিসটি দেখার জন্য পুলিশের সঙ্গে কিছু পথচারিও ভিড় করেছিল। মুজিবুর অত্যান্ত ক্ষিপ্রতায় ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটি জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে চার্জকে ইগনাইট করে নিমিষে পালিয়ে যায়। ব্যাপার অন্যরকম দেখে পুলিশসহ সবাই পালাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই প্রচন্ডবেগে বিস্ফোরণ ঘটে।
এই প্লেটার বানাতে আড়াইশো টাকা খরচ হয়েছিল ওদের।
৭ আগস্ট; ফার্মগেট অপারেশন
এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল ছয়জন গেরিলা-জুয়েল, বদিউজ্জামা,আলম, পুলু, স্বপন ও ড্রাইভিংয়ে সামাদ। এরা সবাই ক্র্যাক প্লাটুনের।
ফার্মগেটের মিলিটারি চেকপোস্টটা ছিল বেশ বড়। ক্যান্টেনমেন্ট, অপারেশন হেডকোয়ার্টার, এম. পি. এ. হোস্টেল এবং সে সময়কার দ্বিতীয় রাজধানীর সংযোগস্থলে এখানে বসেছিল কড়া চেকপোস্ট। অন্যদিকে ট্রাফিক আয়ল্যান্ডের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়ে মিলিটারি পুলিশ ও তাদের সহযোগীদের থাকার ব্যাবস্থা ছিল। গ্রীন রোডে ঢোকার মুখে মোড়ের বামদিকে একটা সিনেমা হল (বর্তমান আনন্দ সিনেমা হল) তৈরি হচ্ছে। তার মাথাতে পাহারায় ছিল লাইট মেশিনগান হাতে মিলিটারি। ট্রাফিক আয়ল্যান্ড সংলগ্ন ফুটপাথে রাইফেল ও লাইট মেশিনগান হাতে নিযুক্ত ছিল চেকপোস্টের প্রহরী। সুতরাং এই গেরিলা অপারেশনটি ছিল অত্যান্ত দুঃসাহসী ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
এই দলের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল আলমের কাছে একটি চায়নিজ এস.এম.জি অন্যদের হাতে ছিল স্টেনগান। এছাড়া জুয়েল ও পুলুর হাতে ছিল একটি ফসফরাস গ্রেনেড ও একটি গ্রেনেড-৩৬। সামাদের কাছে ছিল রিভলভার।
অপারেশনের সময় ছিল রাত আটটা থেকে আটটা পাঁচ মিনিট। প্রথমবারের রেকি কাজ শেষ হয় দুপুরের দিকে। সন্ধ্যা সাতটায় চুড়ান্ত রেকি কাজ সম্পন্ন করে আলম ও সামাদ। তারা ব্যাবহার করে একটি ফোক্স ওয়াগন গাড়ি। তারা দেখতে পায় চেকপোস্টে রয়েছে মিলিটারি পুলিশ ও রাজাকার। মিলিটারি কেউ নেই। রাস্তা দিয়ে মিলিটারি জীপ ও কনভয় আসা যাওয়া করছে। সিনেমা হলের মাথায় পাহারারত মিলিটারি এল. এম. জি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিভাবে আক্রমণ হবে তার একটা পরিকল্পনা করে ফেলে ওরা। যেমন গাড়ি থেকে নামলে ওপেনিং কমান্ড দেবে বদিউজ্জামান। এক মিনিট ব্রাশ ফায়ারের পর স্বপন দেবে ক্লোজিং কমান্ড। পালিয়ে যাওয়ার আগে জুয়েল ও পুলু ছুঁড়ে দেবে ফসফরাস বোমা ও গ্রেনেড-৩৬।
৭-৫০ মিনিটে সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাড়ি থেকে সবুজ রঙের টয়োটা গাড়িতে ওরা রওনা হয় ফার্মগেটের দিকে। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে একটি সফল অভিযান পরিচালনা করে ওরা। যখন ওপেনিং কমান্ড কলো ‘ফায়ার’ তার থেকে পুরো এক মিনিট চললো ব্রাশ ফায়ার। ঠিক এক মিনিট পর কমান্ড হলো ‘রিট্রিট’- মুহূর্তের মধ্যে গাড়িতে উঠে ওরা হাওয়া। পালানোর আগে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল গ্রেনেড ও ফসফরাস বোমা। কিন্ত ও দু’টোতে ডেটোনেটর ফিউজ লাগানো ছিল না বলে ও দু’টো ফাটে নি। তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে অপারেশন সম্পন্ন হয়।
এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী বদিউজ্জামান পরবর্তীকালে শহীদ হন।
অপারেশনে নিহত হয় পাঁচজন মিলিটারি পুলিশ ও তাদের সহযোগী ছয়জন রাজাকার।
১১ আগস্ট : আবার ইন্টারকন্টিনেন্ট
জুন মাসের প্রথম বিস্ফোরণের পর ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাহারা আরো জোরদার হয়েছিল। প্রচুর পরিমাণে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। হোটেলের তিন কোণে ছিল বালির বস্তা প্রতিরোধ দেয়াল। সেখানে লাইট মেশিনগান, এস. এল. আর. বা জি-৩ নিয়ে সারাক্ষণ পাহারায় থাকতো সেনাবাহিনীর লোক।
এই অপারেশনের মূল উদ্যোক্তা ছিল সামাদ ও বাকের। অন্য সহযোগীদের মধ্যে ছিল উলফত, মায়া ও গাজী। সামাদ নিজের ভাষায় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে : “ হোটেল ইন্টারকনের ওপর জুন মাসের হামলার পর খান সেনারা কড়া পাহার বসিয়েছিল। সেখানে প্রবেশ করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। মিঃ জামাল ওয়ারিস নামে জনৈক বিহারীর বোদৌলতে হোটেলের প্রেমিসেসে অবস্থিত থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের নতুন অফিস কক্ষের জন্য গ্লো-সাইন তৈরির অর্ডার সংগ্রহ করে সেই সুবাদে হোটেলে প্রবেশের সুযোগ করে নিই এবং কিভাবে অপারেশন করা যায় সে সম্বন্ধে রেকি করি। ব্যাবসার নাম করে আমি সব সময় একটি ব্রিফকেস বহন করে নিয়ে যেতাম। গ্লো-সাইন তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পরদিনই ব্রিফকেসে ২৮ পাউন্ড পি-কে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদী ‘টাইম পেন্সিল’ ভরে বিকেলে গাড়িতে চেপে রওয়ানা হলাম। আমি, বাকের,মায়া ও গাজী। এদের দু’জন গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো”। হোটেলের মূল দরজা দিয়ে ঢুকে ‘সুইস এয়ার’ অফিস দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সামাদ ও বাকের। সহায়তা করেছিল ঐ অফিসে কর্মরত একজন বন্ধু। প্রথমে সামাদ টয়লেটে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর ব্রিফকেস নিয়ে কোণার ল্যাট্রিনে ঢুকলো বাকের। বাক্স খুলে ‘টাইম পেন্সিল’ প্রেস করলো। ব্রিফকেসটি রাখলো কমোডের পেছনে। তারপর দরজা লক করে রেখে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এল। মূল দরজায় কভারে ছিল সামাদ। সামান্য সময়ের ব্যাবধানে দু’জন বেরিয়ে গেল। বিকেল ৫-৫৬ মিনিটে ঘটলো বিস্ফোরণ, প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠলো হোটেল। শপিং আরকেড, লাউঞ্জ এবং আশেপাশের ঘরের কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভেঙে পড়ে লাগোয়া দেয়াল। আহত হয় বেশ কয়েকজন। বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার কাহিনী ছাপা হয় এই ঘটনার পর। তার মধ্যে একটি লাইন ছিল এমন : “ ইট শোজ দ্যাট দ্য গেরিলাস ক্যান মুভ এট ঢাকা সিটি এট দেয়ার উইল”।
এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী বাকের পরবর্তী সময়ে শহীদ হন।
১৩ আগস্ট : তিনজন গোয়েন্দা খতম
গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তানী বাহিনীর তিনজন অফিসারকে দিনের বেলায় হত্যা করে গেরিলারা। ওদের কাছ থেকে ওরা পেয়েছিল দু’টি পয়েন্ট ৩৮ স্মিথ এন্ড উইলসন রিভলবার এবং একটি ২২ রাউন্ডের চাইনিজ পিস্তল। আরও পেয়েছিল একটি মানচিত্র। এই দলে ছিল নজমুল, হানিফ ও পুলু।
নজমুলের ক্যাম্প ছিল সায়েদাবাদের কাছে ধলপাড়ায়। সেদিন ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের এক বাসায় গেরিলাদের সভা ডাকা হয়েছিল। বেলা আড়াইটার দিকে নজমুল আরো কয়েকজনকে নিয়ে রওনা হয়। গোপীবাগ মিউনিসিপ্যাল কসাইখানার কাছে এসে দেখতে পায় সেই তিনজন জীপে করে আসছে। ওদের খতম করে দেয়ার জন্য মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফাইনাল রেকি করার জন্য একজনকে অপারেশন স্পটে পাঠানো হয়। হানিফ নেয় চাইনিজ এস. এম. জি. এবং পুলু ও নজমুল নেয় স্টেনগান। স্পতে পৌঁছে নজমুলরা বেলি পজিশন নিয়ে গুলি বর্ষণ করে। দু’জনে লুটিয়ে যেতেই অফিসারটি গুলি করে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। সঙ্গে সঙ্গে নজমুল অফিসারকে গুলি করলে সে নিহত হয়।
শেষের এই অফিসারটি ছিল সেনাবাহিনীর সিকিউরিটি অফিসার। নাম সুলতান শাহ খাটক। এদের পরিচয়পত্র থেকে জানা যায় যে একজন ছিল বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এবং অপরজন সেনাবাহিনীর সিকিউরিটি অফিসার।
দাউদ পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পেট্রোল পাম্প অপারেশন
আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে এই অপারেশন সংঘটিত হয়। এই দলে ছিল পাঁচজন। এরা হলো গাজী, দস্তগীর, টুলটুল, নীলু, মায়া ও সামাদ। টয়েনবী সার্কুলার রোডে বঙ্গভবনের পাশে ছিল এই পেট্রোল পাম্পটি। এখানে গেরিলারা হানা দিয়েছিল কালো মুখোশ পরে, শুধু চোখদু’টো বের করা ছিল। ওরা এসেছিল একটি ফোক্স ওয়াগনে করে। ওদের দেখে পাম্পের অবাঙালি কর্মচারী দু’জন ‘ফ্যান্টোমাস আ গেয়া’ বলে চিৎকার করে পালিয়ে যায়। গেরিলা দল একটি পাম্পের গায়ে ১০ পাউন্ড পিকে চার্জ এবং অন্যটিতে ৫ পাউন্ড পিকে চার্জ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়।
এই অপারেশনে স্টেনগান হাতে ছিল গাজী, দস্তগীর ও টুলটুল। পাম্প অফিস ঘরের পাহারার দায়িত্বে ছিল নীলু। বিস্ফোরক চার্জ বসিয়েছিল মায়া এবং গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিল সামাদ। গাড়িটি ছিল বাংলাদেশ বিমান-বাহিনীর উইং কমান্ডার কে.এম. আমিনুল ইসলামের।

১৮ আগস্ট : পীরজঙ্গীমাজার পাওয়ার স্টেশন অপারেশন
এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল নজমুল, মীজান, আমান, জসীম, আমীর ও শিবলী। ওয়াপদার এই পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকা, মতিঝিল আবাসিক কলোনী, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনী এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে।
এই অপারেশনের জন্য পাঁচ পাউন্ড করে মোট দশ পাউন্ড পিকে দিয়ে তৈরি করা হয় দু’টো ‘ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড’। এর সঙ্গে দেয়া হয় দু’টো নন-ইলেকট্রিক ডেটোনেটর-২৭ এবং প্রত্যেকটিতে দেড় মিনিটের ফিউজ ওয়্যার। ওদের সঙ্গে আরো ছিল একটি স্টেনগান এবং দু’টি গ্রেনেড ৩৬। ওরা পরেছিল লুঙ্গি ও জামা। পাওয়ার স্টেশনের পাহারায় ছিল দু’জন পুলিশ। ওদের পাশ কাটিয়ে স্টেনগান হাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে নজমুল ও মীজান। ওরা পুলিশদের হ্যান্ডস আপ করায়। জসীম জুডো জানতো। সে কারাতের আগাহতে প্রহরীদের অজ্ঞান করে ফেলে। এরপর প্রহরীদের হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে। এরপর ওরা ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড ফিট করে বিস্ফোরণ ঘটায়।
ফেরার পথে শাহজাহানপুর কলোনীর লোকোশেডের সামনে স্থাপিত রাজাকারদের চেকপোস্টের সামনে পড়ে যায়। রাজাকাররা ওদের চ্যালেঞ্জ করে এবং কয়েকজনকে জাপটে ধরে। শিবলী গ্রেনেড ছুড়ে মারে। ওটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে রাজাকাররা বিমুঢ় হয়ে গেলে ওরা নিজেদের মুক্ত করে। পরে স্টেনগানের গুলিবর্ষণ করে। গুলিবর্ষণে নিহত হয় দু’জন রাজাকার এবং একজন রিকশাওয়ালা। পাওয়ার স্টেশনের বিস্ফোরণে নিহত হয় একজন প্রহরী।
২৫ আগস্ট : ২৫ মার্চ স্মরনে
তিনমাস আসগে এই তারিখে বর্বর পাকিস্তান আর্মি বাংলাদেশের বুকে যে গণহত্যার সূচনা করেছিল তার জন্য ওরা চেয়েছিল এই তারিখে এমন কিছু করবে যাতে ওদের কিছু শিক্ষা দেয়া যায়।
ওরা জানতো ধানমন্ডির বিশ নম্বর রাস্তার একটি বাড়িতে চীনা দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা বাস করে। বাংলাদেশে এতবড় গণহত্যার পরও চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করছে। ওই বাড়ির সামনে পাহারা দেয় বেশকিছু পাকিস্তানী মিলিটারি পুলিশ। ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে জনৈক ব্রিগেডিয়ার থাকে। সেখানেও পাহারা দেয় কয়েকজন মিলিটারি পুলিশ। ওরা দু’টো বাড়িকেই টার্গেট করে। ওরা দু’দলে ভাগ হয়ে যায়। এক দলে থাকে আলম, বদি, কাজী, রুমী, স্বপ্ন ও সেলিম। অন্য দলে থাকে হ্যারিস, জিয়া, মুক্তার ও আনু ও আরো দু’জন ছেলে। দু-দলই অপারেশনের জন্য দু’টি গাড়ি হাইজ্যাক করে। বদি, আলম ধানমন্ডির চার নম্বর রোড থেকে একটি মাজদা গাড়ি এবং হ্যারিসরা একটি ফিয়াট ৬০০ হাইজ্যাক করে ধানমন্ডি ২২ নম্বর রোড থেকে।
সন্ধ্যা ৭-২৫ মিনিটে আলম, বদিরা ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোড থেকে বের হয়। গাড়ি চালায় আলম। তার বাঁ পাশে প্রথমে সেলিম ও পরে কাজী। পেছনের সীটে রুমী, বদি ও স্বপন। ওরা চীনা ডিপ্লোম্যাটের বাসার সামনে গিয়ে দেখে মিলিটারি পুলিশরা নেই। সেখান থেকে ওরা ১৮ নম্বর রোডে আসে। সেখানে পুলিশরা আড্ডা দিচ্ছিলো। গাড়িটার গতি কমিয়ে বাড়িটার সামনে দিয়ে চালানোর সময় আলম নিচু গলায় কমান্ড দেয় ‘ফায়ার’। মুহূর্তে গাড়ির দুই জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি ছুটে যায়। দুই স্টেনগান থেকে দু’টো লেভেলে এবং কাজীর স্টেনগান তাক করা হয়েছিল ওদের বুকের লেভেলে। সব ক’জন পুলিশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘটনাটি ঘটে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। এরপর ওরা ধানমন্ডির বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে সাত নম্বর রোডের ভেতর দিয়ে এসে মীরপুর রোডে ওঠে। দেখতে পায় ট্রাক এবং জীপ দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড এবং রাস্তার ওপর এল. এম. জি. নিয়ে মাটিতে শুয়ে আছে দু’জন পুলিশ। ওদের দেখে মুহূর্তে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বদি আর রুমী বলে উঠে ‘ফায়ার’, সঙ্গে সঙ্গে আলমও। মুহূর্তে গুলি ছুতে যায় এবং ওরা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওদের গাড়ি ধানমন্ডি পাঁচ নম্বর রোডে ঢুকে যায়। একটু পর রুমী খেয়াল করে যে একটি মিলিটারি জীপ ওদের পিছু ধাওয়া করছে। সঙ্গে সঙ্গে রুমী স্টেনের বাঁট দিয়ে পেছনের কাঁচ ভেঙে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে গুলি করে বদি এবং স্বপন। ওরা দেখতে পায় জীপটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোড়ের ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যায়।
এই অপারেশনে অংশ গ্রহণকারী রুমীকে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। রুমী শহীদ হন। এই রুমির মা জাহানারা ইমাম।
২৬ আগস্ট : সিটি টেরোরাইজিং অপারেশন
গেরিলাদের প্রতি নির্দেশ ছিল ছোট-বড় নানা ধরনের একশন করে শহরের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত করে দিয়ে পাকিস্তানী-আর্মিদের সবসময় আতঙ্কের ভেতর রাখা। শহরের সমস্ত এলাকাজুরে এমনভাবে এ কাজগুলো করতে হবে যেন ওরা মনে করে শহরজুড়ে গেরিলারা তৎপরতা চালাচ্ছে। খালেদ মোশাররফের ভাষায় এর নাম ছিল ‘সিটি টেরোরাইজিং অপারেশন’। উদ্দেশ্য পাকিস্তানী আর্মিকে ‘মুকুতের ভয়’ দেখানো। এই উদ্দেশ্যে ওরা এমকে-১৪ ও এমকে-১৬ নামের কতগুলো মাইন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আগস্টের সন্ধ্যা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এই দলে ছিল পাঁচজন। সামাদের নিজস্ব টয়োটা করোলার ড্রাইভিংয়ে ছিল সামাদ নিজে, বাকিরা হাফিজ, উলফত, গাজী ও বাপী।
মোহাম্মদপুরের অবাঙালি এলাকা থেকে এরা যাত্রা শুরু করে। আইয়ুব (বর্তমানে আসাদ) গেটের কাছাকাছি এলে ওরা দেখে মিরপুরের দিক থেকে একটি আর্মি কনভয় আসছে। পেট্রোল নেবার ছল করে ওরা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থামায়। কনভয় আসার আগেই উলফত দ্রুত রাস্তায় ক’টি মাইন পেতে দিয়ে আসে। কনভয়ের প্রথম দু’টি গাড়ি বিনা বাঁধায় পেরিয়ে যায়। তৃতীয় গাড়ির চাকা মাইনের আঘাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বারস্ট করে।
আসাদ গেটে সফল অভিযানটি ঘতিয়ে ওরা চলে আসে হাইকোর্ট ময়মনসিংহ রোড ক্রসিং-এর ট্রাফিক রাউন্ড এবাউটের কাছে। কার্জন হলের সামনে এখন যেখানে জোড়া দোয়েল সম্বলিত আয়ল্যান্ড সে জায়গাটিতে। ওখানে আসতেই ওরা দেখতে পেলো হাইকোর্টের দিক থেকে আসছে দোতলা বাস। এই বাসে ছিল সব অবাঙালি যাত্রী। বাস-স্ট্যান্ডে গাড়িটি দাঁড়াতেই উলফত ও বাপী চাকার নিচে পেতে দিলো মাইন। কিছুক্ষণ পর বাসটি চালাতে শুরু করার মুহূর্তে প্রচন্ড শব্দে ফেটে গেল বাসের টায়ার। সঙ্গে সঙ্গে বাসটি কাত হয়ে পড়ে গেল।
এরপর ওরা নিউমার্কেটের দিকে আসে। গ্রীন রোডের মোড়ে আসতেই ওরা দেখতে পায় মোড়ের পেট্রল পাম্পে কয়েকটি মিলিটারি জীপ পেট্রল নিচ্ছে। ওরা নিজেদের গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির রাস্তায় হাফিজ এম কে-১৬ মাইন বসিয়ে দেয়। ওদের গাড়ি মোহাম্মদপুরের দিকে এগোতেই ভেসে আসে বিস্ফোরণের শব্দ। ওরা পরে খবর পেয়েছিল যে জীপটি শূন্যে উঠে ছিটকে পড়েছিল। ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ভেতরের দুই তিনজন পাকিস্তানী সেনা।
১০ সেপ্টেম্বর : শুক্রবারের বাসাবো, বেলা দেড়টা
এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল ১৫ জন গেরিলা। নজীবুল হক ছিল এর নেতৃত্বে। বাসাবোর কদমতলীর ফাঁড়িতে ছিল পুলিশ ও রাজাকারদের ঘাঁটি। এরা আশেপাশের লোকদের ওপর অত্যাচার করতো। গ্রামের লোকেরা এদের জ্বালায় শহরে আসা-যাওয়া করতে পারতো না। ডাইগদিয়া গ্রামে ছিল নজীবদের ক্যাম্প। গ্রামের লোকেরা ওদের বলে এর একটা ব্যবস্থা করতে। ওরা ঠিক করে অতর্কিতে পুলিশ ক্যাম্প ঘেরাও করে পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেবে এবং দোষীদের খুঁজে চরম শাস্তি দেবে। পরিকল্পনা মাফিক ৭ ও ৮ তারিখে রেকি কাজ করা হয়। ১০ তারিখে ১৫ জন গেরিলা তিনটি নৌকায় রওনা হয়। ওদের সঙ্গে ছিল একটি মেশিনগান, ৬টি স্টেনগান এবং ৬টি এস. এল. আর। ১০ তারিখে ওরা কদমতলী ফাঁড়ির প্রায় ২০০ গজ দূরে নামে এবং দ্রুততার সঙ্গে ডবল মার্চ করে ফাঁড়ি ঘিরে ফেলে। ফাঁড়ির সেন্ট্রি গেট থেকে পুলিশ ও রাজাকাররা গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন শুরু হয় গেরিলাদের অবিরাম গুলিবর্ষণ। ঢাকার মতো সুরক্ষিত নগরীতে এ ধরনের ‘রেইড অপারেশন’ অবিশ্বাস্য ঘটনা।
এই সফল হামলায় নিহত হয় ১৩ জন পুলিশ ও রাজাকার এবং আহত হয় ৪ জন। হামলা শেষে গেরিলারা চলে যাবার পর ৪-টার দিকে পাকিস্তানী সেনারা আসে। ফেরার পথে ওদের একটি নৌকা ডুবে যায়। অপরদিকে কমলাপুরের মুগদা ক্যাম্প থেকে ওদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে ওরা ডুবন্ত নৌকা ছেড়ে অন্য নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা গুলি চালায়। ওরা ছোঁড়ে ট্রেসার বুলেট-যে বুলেট থেকে আগুন ছোটে। কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় লাইট মেশিনগান। গেরিলাদের একজনও হতাহত হয়নি।
২৫ সেপ্টেম্বর : মন্ত্রীর গাড়িতে গ্রেনেড
মন্ত্রীর গাড়িতে গ্রেনেড ছুঁড়েছিল এনায়েত। হোন্ডায় তার সহযোগী ছিল আবুল। মন্ত্রী ছিল মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক। সে ছিল নেজামে ইসলাম পার্টির এবং তার দফতর ছিল মৌলিক গনতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। ঘটনাটি ঘটেছিল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সময় ছিল বেলা বারোটা পঞ্চান্ন মিনিট। মওলানা লালবাগে অনুষ্টিত নেজামে ইসলামের এক কর্মীসভায় যোগদান শেষে সচিবালয়ে যাচ্ছিল।
লালবাগের এক রেস্তোরায় বসে মন্ত্রীকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় এনায়েত এবং আবুলের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। পথে আবুলের সঙ্গে দেখা হয়। দু’জনে প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য নওয়াবগঞ্জে দলের অপর সহযোগীর কাছে যায়। তারা প্যান্ট-শার্ট বদলে পায়জামা, পাঞ্জাবী ও কিস্তি টুপি পরে। সঙ্গে নেয় একটি গ্রেনেড-৩৬ ও ফসফরাস-৭৭। হোন্ডার নাম্বার প্লেটে আবছাভাবে চুন লাগিয়ে নেয়।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারা মন্ত্রীর মার্সিডিজ গাড়ির পিছু নেয়। গাড়ি মেডিক্যাল কলেজ চৌরাস্তার মোড়ে পৌছুতেই ট্রাফিকের লাল আলো জ্বলে ওঠে। হোন্ডা এসে দাঁড়ায় গাড়ির পাশে। এনায়েত গাড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মন্ত্রীয় গায়ে ছুঁড়ে দেয় গ্রেনেড-৩৬। বিদ্যুৎগতিতে হোন্ডা ছুটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। আহত হয় মন্ত্রী। আহত হয় গাড়ির ড্রাইভার সাজ্জাদ।
এই অপারেশনে অংশগ্রহনকারী আবুল ১৬ দিসেম্বর সকালে নৌকা ডুবিতে মারা যায়।
১৩ অক্টোবর : মোনেম খান নিহত
১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর মোনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে ছিল। আইয়ুব খানের হুকুমের দাস এই মানুষটি ছয় বছরের বেশি সময় ধরে বাঙালিদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের ওপর চালিয়েছে অকথ্য নির্যাতন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের রোষে আইয়ুবের পতনের কিছু আগে তার বিদায় ঘটে। এরপর বেশ কিছুকাল নীরবই ছিল। একাত্তরের জুলাই-আগস্ট মাস থেকে তৎপর হতে শুরু করে।
১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় তার বনানীর বাসায় অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে গল্প করছিল। দরজার দিকে মুখ করে বসেছিল মোনেম পুত্র। লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট পরা একজন গেরিলা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়। গুলি তার তলপেট ভেদ করে, সোফা ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে লাগে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রাত তিনটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মারা যায়।
আসাদুল্লাহ
লালবাগের বাসিন্দা শান্তিকমিটির আসাদুল্লাহ মে মাসে বখশি বাজারের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
১৮ অক্টোবর : রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল
এই স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র এই বিস্ফোরণ ঘটায়। বড় ভাইয়ের বইয়ের ভেতর গর্ত করে তার মধ্যে পিকে এবং আধ পাউন্ড ইসপ্লিন্টার পুরে ছেলেটি স্কুলে যায়। শেষ পিরিয়ডে বাথরুমে গিয়ে ফিউজ ওয়্যার আগুন লাগায়। বিস্ফোরণে বাথরুমের জানালার কাচ প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে গিয়ে পড়ে।
২ ডিসেম্বর : দ্বিতীয়বার
৭ ডিসেম্বর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। তার আগে আর একটি বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রস্তুতি নেয় ছেলেটি। মোটা ফিজিক্স বইয়ের মধ্যে দশ পাউন্ড পিকে ভরে নেয়। প্রথমবার বিস্ফোরণের পর স্কুল গেটে বসেছে রাজাকারদের পাহারা। ছেলেটির সাথে ছিল স্কুলের সহযোগী বন্ধু। ওরা ঠিক করেছিল ১ ডিসেম্বর বিস্ফোরণ ঘটাবে। কিন্তু গেটে রাজাকাররা বই চেক করতে চাইলে ওরা বিপদে পড়ে। একজন বন্ধু রাজাকারদের সঙ্গে তর্ক করার ফাঁকে অন্যজন বই নিয়ে সরে পড়ে। পরের দিন ছেলেটি মাকে নিয়ে আসে। অভিবাবক সঙ্গে থাকলে রাজাকাররা গেটে বাধা দিত না। ছেলেটির মা’র বোরকার নিচে ছিল পিকে ভরা বই।
শেষ পিরিয়ডে শিক্ষককে ফাঁকি দিয়ে ছেলেটি বই নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। কয়েকবার চেষ্টার পর ফিউজ ওয়্যার আগুন জ্বললো। ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল প্রচন্ড বিস্ফোরণ।
২০ অক্টোবর : আবার স্টেটব্যাংক
এই অপারেশনের দলে ছিল পাঁচজন। এরা হলো নজমুল, সাদেক, আমান, জসীম এবং স্টেট ব্যাংকের একজন কর্মচারী। এই অপারেশনে ব্যাবহৃত হয়ে ছিল ৮ পাউন্ড পিকে।
ব্যাংকের সহায়ক বন্ধুর কাছ থেকে গেরিলারা জানতে পারে যে ব্যাংকের ছয় তলায় টয়লেটের পাশে কয়েকজন ‘হায়ার ট্রেইনড কমান্ডো’ অবস্থান নিয়েছে। তারা সাধারণত দুপুরে সবাই ঘরে থাকে। সেজন্য রেকি করার পর সিদ্ধন্ত নেয়া হয় যে দুপুরেই বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। একটি ব্রিফকেস সাজানো হয় পিকে চার্জ, সাত মিনিটের ফিউজ ওয়্যার এবং একটি গ্রেনেড-৩৬। নির্ধারিত সময়ে লুঙ্গি, পাঞ্জাবী এবং পাম্প সু পড়ে স্টেনগান লুকিয়ে গেটের অদূরে অপেক্ষা করে। সাদেক, আমান ও জসীম গাড়িতে করে বিস্ফোরক নিয়ে আসে। সহায়ক বন্ধু গেটেই ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে ব্রিফকেস নিয়ে ভেতরে চলে যায়। বাথরুমে গিয়ে ফিউজ ওয়্যারে ইগনাইট করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। দু’জন কমান্ডো নিহত হয়।
২৮ অক্টোবর : ডি আই টির সাততলায়
এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল তিনজন। একজন ডি আই টির কর্মচারী মাহবুব আলী ও অন্য দু’জন গেরিলা জন আর ফেরদৌস। এরা দু’জনেই ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। এদের মূল পরিকল্পনা ছিল ডি আই টি টাওয়ারের উপর টেলিভিশনের ‘এন্টেনা টাওয়ারটি’ কাটিং চার্জ করে ফেলে দেয়া। তখন টেলিভিশনের স্টুডিও ছিল ডি আই টি ভবনে। কিন্তু মাঝপথে বাধ্য হয়ে তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়।
এই অপারেশনে ব্যাবহৃত হয়েছিল ১২ পাউন্ড পিকে, ৬ ফুট ফিউজ ওয়্যার এবং ১টি ডেটোনেটর।
তেলিভিশন স্টুডিও থাকার কারণে এই ভবনের প্রতিরক্ষা ছিল অত্যান্ত সুরক্ষিত। ভিতরে প্রবেশের জন্য খোলা থাকতো প্রধান দু’টো গেটের একটি। গেটে ছিল চেকিং ব্যাবস্থা। মূল ভবনে ঢোকার মুখে ছিল চেকপোস্ট। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ও লিফটের কাছে ছিল আর একটি চেকপোস্ট। প্রত্যেক তলার সিঁড়ি মুখে ছিল চেকপোস্ট। এভাবে ছয়টি চেকপোস্ট পেরিয়ে সাত তলায় পৌছুতে হতো।
ডি আই টি ভবনে ঢোকার জন্য মাহবুব আলী, জন ও ফেরদৌসকে পাশ জোগাড় করে দেয়। ওরা সাততলায় রেকি কাজ করে। জায়গা মাপে এবং কাটিং চার্জ বসাবার জায়গা ঠিক করে। ওরা হিসেব করে দেখে যে বিস্ফোরণের জন্য ১৬ পাউন্ড পিকে প্রয়োজন হবে। ঠিক হয় মাহবুব আলী প্রতিদিন মাল পাচার করবে। অফিস যাওয়ার আগে মাহবুবের বাসায় গিয়ে পায়ে প্যান্টের নিচে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয় জন। ব্যান্ডেজের নিচে রাখা হয় ৮ আউন্স পিকে। দুই পায়ে জুতোর ভেতর পায়ের পাতার নিচে আরো আট আউন্স পিকে দেয়া হয়। মাহবুব এভাবে ১২ দিনে ১২ পাউন্ড পিকে বহন করে। এই জিনিসগুলো সাততলার একটি ঘরে পুরনো ফাইলপত্রের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হতো। এর মধ্যে দেখা দিল সমস্যা। সাততলার সেই ফাইলরুম গোছানোর তোড়জোড় চলছে। খবর পেয়ে জন আর ফেরদৌস মূল পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। মাহবুবের নকল ব্যান্ডেজের নিচে বেঁধে দেয়া হয় ৬ গজ ফিউজ ওয়্যার এবং ফাউন্টেন পেনের মধ্যকার অংশগুলো ফেলে দিয়ে খোলের মধ্যে ভরে দেওয়া হয় একটি ডোটেনেটর। জন ও ফেরদৌসের অডিশনের অজুহাত দিয়ে দু’টি পাশ জোগাড় করা হলো। নির্ধারিত তারিখে বেলা পৌনে একটায় দু’জনে ডিআইটি ভবনে প্রবেশ করে। ৬-তলা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চেকপোস্ট পেরিয়ে এল। সাততলায় উঠবার মুখে পুলিশ আটকালো । কি জন্য যাবে জিজ্ঞেস করলে ওরা বললো যে ওরা অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে বুড়িগঙ্গায় কতটুকু পানি বেড়েছে তা দেখবে। এই সময় অন্য লোক এসে পড়ায় পুলিশ ওদের ছেড়ে দেয়।
ওরা দ্রুত সেই ঘরে গিয়ে পিকে একত্র করে। জন চার্জ সেট করে। ফিউজ ওয়ারের ইগনিশন পয়েন্ট ও ডেটনেটর ফিট করে ফেরদৌস। বেলা ১-১২ মিনিটে ফিউজ ওয়্যার অগ্নিসংযোগ করে ওরা। মাত্র তিন মিনিট সময়। এর মধ্যে ওদের পেরিয়ে যেতে হবে এই ভবনের চত্বর। ওরা যখন স্টেডিয়ামের বারান্দায় পৌছে তখন ঘটে বিস্ফোরণ।
বিস্ফোরণ ফলে টাওয়ারের এক অংশে বিরাট ফোকরের সৃষ্টি হয় এবং সাততলায় মেঝেতে গর্ত হয়। আগুন সাততলা থেকে ছয় তলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং অফিসের কিছু কাগজপত্র পুড়ে যায়।
১ নভেম্বর : প্রাদেশিক নির্বাচনী কমিশন
খবরের কাগজ থেকে জানা যায় যে ১ নভেম্বর প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশন অফিসে বোমা বিস্ফোরণে ১জন নিহত, ২ জন আহত, দু’টো ঘর বিধ্বস্ত হয়। বোমার আগুনে কাগজপত্র পুড়ে যায়। ঘরের ছাদ ধসে পড়ে।
২ নভেম্বর : কাকরাইল পেট্রোল পাম্প
খবরের কাগজ থেকে জানা যায় যে এই দিন সন্ধ্যায় কাকরাইল পেট্রোল পাম্পের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। একই দিন রাত আটটায় আজিমপুর আর্মি রিক্রুটিং কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরিত হয়।
৩ নভেম্বর : সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজ
খবরের কাগজের খবর: “গতকাল বুধবার ভোরে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজে পর পর তিনটি বোমা বিস্ফোরণের ফলে পাওয়ার হাউজের বিশেষ ক্ষতি হয় এবং ৪টি জেনারেটরই বিকল হয়ে পড়ে”। ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলামের সাহায্যে ম্যানেজারের গাড়ির ড্রাইভার গোপনে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে যায়। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, টঙ্গী ও শহরতলী এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় এক সপ্তাহ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম পড়ে শহীদ হন।
৩নভেম্বর: মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক লুট
ব্যাংক থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার কাজে অংশ নিয়েছিল আসাদ, মুনীর, ফিরোজ, জন, ফেরদৌস এবং আরিফ। অপারেশন নেতৃত্ব দেয় আসাদ।
“ঢাকা সদর উত্তর মুক্তিবাহিনীর শিমুলিয়া ক্যাম্প থেকে অধিকৃত ঢাকা নগরীর সহযোগী বিচ্ছুদের কাছে পয়লা নভেম্বর সোমবার একটি চিঠি এল। চিঠির বক্তব্য, ‘টাকার অত্যান্ত প্রয়োজন। আহতদের জন্য রক্ত ও ঔষধপত্রের দরকার। জলদি টাকা ম্যানেজ কর’। এই চিঠি পাওয়ার পর আদমজীদের ব্যাংক মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে টাকা ছিনিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। ঠিক হয় ৩ তারিখ, বুজধবার বেলা ১১টা থেকে টাকা ছিনিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। ঠিক হয় ৩ তারিখ, বুধবার বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে কাজ সারতে হবে। সে অনুযায়ী আগের দিন মঙ্গলবার ওরা রেকি কাজ সারে। আরিফের বাড়ির মরিস মাইনর গাড়িটির নম্বর বদলে গাড়িটি অপারেশনের কাজে ব্যাবহার করা হয়।
বেলা ১১টায় জন ব্যাংক এলাকা জোনাকী সিনেমা হলের পাশে পলওয়েল মার্কেটের কাছে চলে এল। ওর দায়িত্ব ছিল পর্যবেক্ষণ এবং মূল দলকে গ্রীন সিগন্যাল দেয়া। গাড়িতে আসাদের হাতে ছিল স্টেনগান, ফেরদৌসের হাতে রিভলভার, মুনীরের হাতে ডামি রিভলভার এবং সঙ্গে আরো ছিল ফিরোজ। নির্দিষ্ট স্থান থেকে জন সিগন্যাল দিলে ব্যাংকের সামনে গাড়ি এসে থামে। আরিফ ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গাড়িতে বসে থাকে। প্রথমে ফিরোজ গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে ওর ঘাড়ে ‘করাতের’ এক কোপ দিয়ে বন্দুক কেড়ে নিয়ে দরজার কাছে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আসাদ, ফেরদৌস ও মুনির ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ব্যাংকের ভেতর ছিল ৭ জন কর্মচারী ও ৪ জন ক্লায়েন্ট। আসাদ স্টেনগান উঁচিয়ে সবাইকে হ্যান্ডস আপ করায়। মুনির ম্যানেজারের সামনে ডামি রিভলভার উঁচিয়ে ধরে।
ব্যাংকের একজন বলে, আপনারা কিসে টাকা নেবেন? ফিরোজ ওর জামা খুলে দেয়। ক্যাশ কাউন্তার থেকে সে জামায় টাকা বেঁধে ওরা ছুটে বেরিয়ে যায়।
এই এক দিনে একই সময়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে তিন-চারজন গেরিলা মৌচাক মার্কেটে অবস্থিত ইউনিয়ন ব্যাংকে ঢুকে ৭ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

৪ নভেম্বর : সবুর খানের ধানমন্ডির বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে।
৮ নভেম্বর : নবীগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে।
১১ নভেম্বর : বায়তুল মোকাররম
এই অপারেশনের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা অংশ নিয়েছিল তারা হলে প্লাটুন কমান্ডার আসাদ, ফিরোজ, ফেরদৌস, আরিফ, জন, বাবু, সহর, মুনীর ও জাহেদুল।
এই অপারেশনের জন্য ওরা সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে গাড়ি হাইজ্যাক করে। ওদের প্লান মাফিক চার্জ বারস্ট ও অন্যান্য কাজের জন্য আসাদ, জন, সহর, আরিফ ও অন্যান্যরা আগেই বায়তুল মোকাররমে আসে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি ও বিস্ফোরক নিয়ে ফিরোজ, ফেরদৌস ও বাবু আসে। বেলা ১২-৩০ মিনিটে ওদের গাড়ি এসে থামে ফ্যান্সী হাউসের সামনে ফুটপাতের পাশে। কিন্তু প্রথমবার ফিউজ ওয়্যার অগ্নিসংযোগ করার পরও বিস্ফোরণ ঘটে না। ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার ওরা বেলা আড়াইটার দিকে আবার তৈরি হয়ে আসে। প্রথমবার ইগনাইট করেছিল ফেরদৌস। ঠিক হয় এবার অগ্নিসংযোগ করবে আসাদ। সহর ও জন গ্রেনেড নিয়ে তৈরি হয়েছে। আরিফের কাছে আছে বেয়োনেট। ফ্যান্সী হাউসের সামনে ৬জন পাকিস্তানী সেনা কলা কিনছিল। ফ্যান্সী হাউসের ভেতরে কেনাকাটা করছিল গোয়েন্দা বিভাগের মেজর ফতেহ মোহাম্মদ মালিক। আরো ছিল কয়েকজন অফিসার ও তাদের পরিবারের লোকজন। গেরিলাদের ইচ্ছে ছিল যে ঈদের কেনাকাটার ধুমধাড়াক্কায় বাধ সাধতে। সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর দালালরা ঈদের আনন্দে মেতে উঠেছে। ফিউজ ওয়্যার ইগনাইট করে আসাদ। কয়েক মিনিট মাত্র, প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বায়তুল মোকাররম বিপণিকেন্দ্র। জন, ফিরোজ ও সহরের গ্রেনেড চার্জ করার কথা ছিল। কিন্তু বিস্ফোরণের পর বিদ্যুৎগতিতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল বলে প্রথম দু’জন আর চার্জ করতে পারে নি।
এই অপারেশনে ৩ জন পাকিস্তানী সেনা মারা যায়। অনেক হতাহত হয়। ৬ জন বেসামরিক লোকও মারা যায়।
১৪ নভেম্বর : গেরিলারা টঙ্গী ও ধীরাশ্রমের মধ্যবর্তী রেললাইন তুলে ফেলে।
১৫ নভেম্বর : নবাবগঞ্জ থানার বান্দুরায় মিলিটারিদের স্পিডবোট দখল করা হয়।
১৯ নভেম্বর : মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ৬টি গাড়ি ধ্বংস হয়। ডেমরায় এসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স লিমিটেডের প্যাকেজিং কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের শান্তিবাগে অবস্থিত অফিসে বিস্ফোরণ ঘটে।
২১ নভেম্বর : মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার কাছে রেললাইনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
২৪ নভেম্বর : পোস্তোগোলার একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে বিস্ফরণ ঘটে।
২৭ নভেম্বর : ঢাকা রেল স্টেশনের কাছে রেললাইন উড়ানো হয়।
১১ ডিসেম্বর : ইউসিসে বিস্ফোরণ
এই অপারেশনে যারা অংশ নিয়েছিল তারা ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। এরা হলো মোবাশশার হাসান বাবুল, মানু, নীলু এবং ড্রাইভিঙে ছিল জিয়া। অপারেশন কাজের জন্য দু’দিন রেকি করে বাবুল। ৯ ডিসেম্বর সে বিস্ফোরক, ২টি স্টেনগান ও ৮টা স্টেনের ম্যাগাজিনসহ বাইরের ক্যাম্প থেকে ঢাকায় আসে। ঢাকা থেকে ক্যাম্পে ফেরার সময় বাবুল একটি বড় আকারের ব্রিফকেস কেনে। ব্রিফকেসে সাজানো হয় ২৫ পাউন্ড পিকে, ১টি ডেটোনেটর-২৭ এবং দেড় মিনিটের ফিউজ ওয়্যার। ব্রিফকেস ফুটো করে হাতলের পাশ দিয়ে বের করে রাখা হয় তারের মুখ।
অপারেশন কাজে ব্যবহৃত হয় একটি ভক্সোয়াগন গাড়ি। ঘটনার দিন মানু ও নীলু নেয় স্টেনগান। বাবুলের হাতে থাকে ব্রিফকেস। ১০-২৫ মিনিটে ভক্সওয়াগন এসে দাঁড়ায় ইউসিসের অডিটোরিয়ামে যাওয়ার গেটের সামনের রাস্তায়। ব্রিফকেস হাতে গাড়ি থেকে নেমে যায় বাবুল, পেছন পেছন যায় মানু। গাড়িতে থাকে নীলু ইউসিস ভবন কভার দেয়ার জন্য। মানু ঢুকে পড়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বলে, এভরিবডি হ্যান্ডস আপ। বাবুল চার্জ ফিট করতে শুরু করে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো করে বেরিয়ে পড়ে ওরা। গাড়িতে স্টার্টের সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ইউসিস ভবন।
১৬ ডিসেম্বর : মগবাজার ওয়্যারলেস
এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল চারজন গেরিলা : শামস, মাসুদ চৌধুরী, বাপ্পী ও মাহবুব। সহযোগিতা করেছিল বোন সুরাইয়া আখতার বেবী।
গেরিলারা মগবাজার ওয়্যারলেসের রিসিভিং সেন্টারটি বিকল করে দেয়ার চেষ্টা করে ডিসেম্বরের ৯ তারিখে। কিন্তু এই অপারেশনে ব্যর্থ হয়। অপারেশনের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দিন ঠিক করা হয় ১৫ ডিসেম্বর। এই দিন পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি।
১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা থেকে শুরু হয় গুলি এবং পাল্টা গুলি। ঘটনা গড়াতে গড়াতে দুপুর হয়। যখন আত্মসমর্পণের দলিলে জেনারেল নিয়াজীর স্বাক্ষর দানের প্রস্তুতি চলছে তখন রিসিভিং সেন্টারের ভেতর ৩৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার এই চারজন গেরিলার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানী সেনার গুলিতে শহীদ হয় মুক্তিবাহিনীর সহায়তাকারী বোন সুরাইয়া আখতার বেবী।
টি এন্ড টি কলেজ
এই অপারেশন করেছিল তিনজন গেরিলা : আজহার, সিরাজ ও মুজিবর। ওদের পরিচিত কলেজের একজন দারোয়ান ছিল সহায়ক-বন্ধু। কলেজ গেটে পাহারা দিতো মিলিশিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। রেকি করার জন সিরাজ বেলা বারোটায় কলেজে প্রবেশ করে। পরীক্ষার সীট দেখার নাম করে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয় দারোয়ান। এইচ.এস. সি. পরীক্ষার আগের দিন এই অপারেশন করা হয়।
রেকি করার পর বিস্ফোরণের জায়গা ঠিক হয় দোতলায় সিঁড়ির লাগোয়া অংশ। অপারেশনের সময় স্থির হয় সন্ধ্যা থেকে রাতের প্রথম ভাগ। ৯ পাউন্ড বিস্ফোরকের একটি চার্জ তৈরি হয়। সন্ধ্যার পর কলেজের পেছন দিকের একটি পাইপ বেয়ে দোতলায় সিঁড়ির কাছে উটেহ যায় আজহার। মুজিবর ও সিরাজ নিচে ‘কভার’ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। ফিউজ ওয়্যারছিল তিন মিনিটের। ইগনাইট করে দ্রুত নেমে আসে আজহার। তারপর প্রচন্ড শব্দ।
[৬৩] সেলিনা হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত