বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৭ই নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৩, ১লা অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
উপকূলীয় মানুষের অসহায়ত্বের চির অবসান হোক
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন রেডক্রস অয়ারলেস চ্যানেলের মাধ্যমে রেডক্রস কর্মীদের উদ্দেশে এক ভাষণ দিয়েছেন। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় বিশ হাজার রেডক্রস স্বেচ্ছাসেবকের উদ্দেশে দেওয়া এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ভবিষ্যতে যেকোনো দুর্যোগের মোকাবেলা করার জন্যে রেডক্রসের সদস্যদের সর্বাত্মকভাবে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তিনি উপকূলীয় অঞ্চলে বন তৈরী করার জন্যে রেডক্রস কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কয়েকদিন পূর্বে যে সাংঘাতিক ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিলো তার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু আগামীতে যে কোনো মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনার মুখে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর জন্যে রেডক্রসের কর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। কয়েকদিন পূর্বে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্যে হাজার হাজার রেডক্রস কর্মী যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সদা প্রস্তুত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেজন্যে তাদেরকে ধন্যবাদ জানান। যে কোনো জরুরী অবস্থার মোকাবেলার জন্যে দেশের রেডক্রস সম্পূর্ণ যোগ্য বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। উপকূলীয় অঞ্চলে যে সকল রেডক্রস সদস্য বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন তাদের প্রতি উপকূলীয় এলাকায় বন তৈরীর যে আহ্বান বঙ্গবন্ধু করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ সুদূরপ্রসারী বলে আমরা মনে করি। উপকূলের চর অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ করলে একদিকে যেমন জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ প্রশমিত হতে পারে তেমনি রোপিত গাছপালা উপকূলের বাঁধকে মজবুত করতেও সক্ষম হবে। অন্যদিকে উক্ত গাছপালার ফল জনগণেরই প্রয়োজনে আসবে। বহু প্রাচীনকাল থেকে উপকূলে যে সকল বৃক্ষ ছিলো তা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার দরুণ ঘূর্ণিঝড়ে নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ক্ষতি যাতে আর না হতে পারে তার জন্যে উপকূলে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এ আশা বাস্তবানুগ বলে আমরা মনে করি। এ ব্যাপারে রেডক্রসের কর্মীরা সাড়া দেবেন বলেও আমাদের বিশ্বাস।
কয়েকদিন পূর্বে সৃষ্ট মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের দরুণ যে কোনো আঘাতের মোকাবেলার জন্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি আমরা গোটা জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলাম। সরকার বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধু সেদিন হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও রেডক্রস সদস্যদেরকে যে কোনো আঘাতের মোকাবেলা করার জন্যে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা স্মরণকালের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। সৌভাগ্যক্রমে প্রকৃতির নির্মম আঘাতে সেদিন উপকূলীয় মানুষকে সর্বস্বান্ত করতে পারেনি। সৃষ্ট ঝড়ের গতি পরিবর্তন হয়ে ঝড়ের প্রকটতা হ্রাস পেয়েছিলো। আর সে কারণেই উপকূলের মানুষ রক্ষা পেয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে যে কোনো অবস্থার মোকাবেলার জন্যে কর্তৃপক্ষকে এখন থেকেই সজাগ হওয়ার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো এখন থেকেই বৃক্ষরোপণের কাজ ত্বরান্বিত করা হোক। এবং সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় বাঁধ ও অন্যান্য গৃহীত ব্যবস্থার দ্রুত সমাধান করার প্রতিও আমরা আমাদের অভিমত জানাই। উপকূলীয় অসহায় মানবতার দুঃখ কষ্ট ও ঘূর্ণিঝড়জনিত হাহাকারের চির অবসান হোক এটাই গোটা জাতির কামনা।
সাহায্যকারী দেশগুলোর যুক্ত ইশতেহার
চলতি বছরের শেষে বাংলাদেশে আনরবের ত্রাণ অভিযান শেষ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে রিলিফ অভিযানের সমস্ত দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবার কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল স্যার রবার্ট জ্যাকসনের সভাপতিত্বে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের সাহায্যদাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিদের শেষ বৈঠকে বিবৃতি প্রদানকালে আনরবের প্রধান ফ্রান্সিস ল্যাকোস্টে এ কথা জানিয়েছেন। সাহায্যদাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিদের বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর গত ১২ই নভেম্বর প্রকাশিত একটি যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এদেশে অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হয়েছিলো। কিন্তু বাংলাদেশে একজন লোকও অনাহারে মারা যায়নি। উপরন্তু জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন কৃষির উন্নতি ঘটেছে। ইশতেহারটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বিপুল সাফল্যের পেছনে রয়েছে সুসংহত লক্ষ্য, জাতিসংঘ সাহায্য ও পুনর্বাসন সংস্থার পূর্ণ সহযোগিতা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের সুদৃঢ় প্রত্যয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজে অংশ গ্রহণকারী এবং সাহায্য প্রদানকারী ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, রেডক্রস সহ অন্যান্য সংস্থা এগিয়ে এসেছিলো। এদের মধ্যে পূর্বতন আনরড এবং পরবর্তীতে আনরবের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধের সময়ে দেশত্যাগী প্রায় এক কোটি লোকের পুনর্বাসন, বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং এজন্যে বিশেষ করে বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবহন সংকট দূরীকরণে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান ইত্যাদি ছিলো আনরবের প্রধান লক্ষ্য। আশার কথা আনরব তা সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করেছে। এবং তার ফলে ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁর সরকার অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষ শুধু রোধ করতেই সক্ষম হননি, উপরন্তু এক্ষণে বাংলাদেশ নিজেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজের উপর নির্ভরশীল হতে পারবে বলে যুক্ত ইশতেহারটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য তাই বলে সমস্ত সংকট কেটে গেছে সে কথা বলা যায় না, যুক্ত ইশতেহারটিতেও তা বলা হয়নি। আমরা জানি, এখনো বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত এক বিপুল সংখ্যক জনগণের পুনর্বাসন ইত্যাদি সমস্যার ন্যায় আরো সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। এসব সমস্যাগুলোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগুলো রোধ করার জন্যে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
দোষটা রোগীদেরই!
আবার হাসপাতাল থেকে শিশু চুরির খবর পাওয়া গেছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গত বৃহস্পতিবার দুপুর বেলায় ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে জনৈকা গোলাপরাণীর একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। কিন্তু বিকেল চারটায় শিশুটি চুরি হয়ে যায়। শিশুটি জন্মাবার পর তাকে তার মায়ের কাছ থেকে অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়। এবং দীর্ঘ তিন ঘন্টা পরেও মায়ের শয্যাপার্শ্বে নেওয়া হয়নি। বিকেল চারটায় শিশুর পিতা এসে শিশুকে দেখেছেন। তিনি তার পাশে একজন অজ্ঞাতনামা মহিলাকেও দেখেছিলেন। তারপর তিনি সন্তানের জন্যে মধু কিনতে যান। কিনে এসে দেখেন শিশু সহ ঐ অজ্ঞাতনামা মহিলাটি উধাও। বাবা যাহোক এক ফাঁকে শিশুর মুখ দেখতে পেরেছিলেন। মা গোলাপরাণীর ভাগ্যে তাও জোটেনি। যদিও দশমাস দশদিন যাবত প্রতিটি পলেপলে নিজে দেহের রক্তকণা দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গর্ভে গড়ে তুলেছিলেন শিশুটিকে—যদিও প্রসবকালীন সময়ে চরমতম মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তবুও সন্তানের মুখ দেখা তার ভাগ্যে জোটেনি। অন্য কথায় সন্তানের মুখ দেখতে তাকে দেওয়া হয়নি। এর জন্যে কে বা কারা দায়ী?
আমাদের মনে হয়, এসব ঘটনার জন্যে বস্তুতঃ সার্বিক দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উপর বর্তালেও তাদের দায়ী করা উচিত নয়। কেননা তাদের কাজ তারা করেছেন। এর আগেও এমন করেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আরেকটি শিশু চুরি হয়েছিলো। সেবারও দায়িত্ব কিন্তু হাসপাতালেরই ছিলো। কিন্তু কারো কিছু হয়নি সে ব্যাপারে। সেজন্যে কেউ কোনো কেয়ারই করেননি। এমতাবস্থায় হাসপাতালগুলো থেকে প্রতিনিয়তই যদি শিশু চুরি হতে থাকে অথবা রোগীর বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’এক খানা হাত পা বা হাড়-গোড় ভেঙে ফেলেন, এমনকি মারাও যান, তবুও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স কাউকেও দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ দোষ তো তাদের নয় সব দোষই তো যারা সন্তান প্রসব করতে হাসপাতালে যান—যারা রোগ চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে যান তাদের। যদি তাদের দোষই না হবে তবে তাদের সন্তানই বা প্রসব করতে হবে কেন—কেনই বা রোগ হবে, আর তার জন্যে কেনই বা তারা যাবেন হাসপাতালে আমাদের ‘মহান’ ডাক্তার-নার্স প্রমুখদের সুখ নিদ্রা বা প্রাইভেট প্রাকটিসে বিঘ্ন ঘটিয়ে এসব ঝামেলায় ফেলতে?
কাজেই গোলাপরাণীর ছেলে চুরি যাওয়ার দোষ তো গোলাপরাণীরই—মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি বলেন? তাদের কোনো দোষ নেই—বরং ছেলে চুরি যাওয়ার জন্যে গোলাপরাণীর কোনো ক্ষোভ প্রকাশ না করে তারা যে এতো ঝামেলা পোহায়ে তার সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করেছেন সেজন্যে তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তাই না?
গোলাপরাণীরও এক্ষেত্রে সান্ত্বনা পাওয়া উচিত। কেননা তিনি ও তাঁর মতো আরেকজন মা হাসপাতালে নিজেদের সদ্যজাত শিশু হারিয়ে আর যারা মা হচ্ছেন বা হবেন, তাদের সামনে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। সেই শিক্ষাটি হলো সন্তান প্রসবের সময় যতই কষ্ট পান না কেন—এমনকি মৃত্যুপথ যাত্রীও হোন না কেন হাসপাতালে যাবেন না—আমাদের পাষন্ডকূল শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তার আর নার্স সাহেবাদের ঝামেলায় ফেলবেন না—তাদের প্রাইভেট প্রাকটিসের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না। কেননা সন্তান সম্ভবা মা বা রোগী-রোগিনীদের যত্ন আত্তি বা তাদের সদ্যজাত সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে পূর্ণ সেবা করার মতো সময় কোথায় তাদের?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক