You dont have javascript enabled! Please enable it!

ট্যাক্সেরহাটের যুদ্ধ, দিনাজপুর

ট্যাক্সেরহাটের যুদ্ধের যদিও সঠিক রণকোউশলগত গুরুত্ব কম ছিল তথাপি এটি উত্তর নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ও পার্বতীপুর এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। ট্যক্সেরহাট এলাকায় প্রাথমিক অবস্থায় সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তবে এই ট্যাক্সেরহাটের যুদ্ধে বিজয় মুক্তিবাহিনীকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস ও পারস্পরিক সমঝোতা। তাই এদিক বিবেচনা করলে যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা পার্বতীপুর এলাকার জন্য একটি মাইলফলক। সেনাবাহিনী সৈয়দপুর ও পার্বতীপুরের মধ্যে খুব সহজে তাদের সামরিক যোগাযোগ ও রসদ সরবরাহ করে রেলপথের মাধ্যমে। এছাড়া সৈয়দপুরে ছিল অবাঙালিদের বসবাস, যারা শক্রভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দমন করার জন্য রাজাকার বাহিনী গঠন করে যুদ্ধের শুরুতেই ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকের অপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে অনেক সৈন্য হত্যা করে। উত্তরবঙ্গের এই সৈয়দপুর এলাকা মুক্তিবাহিনীর জন্য অত্যান্ত বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল। এমতাবস্থায় সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সৈয়দপুরে অবস্থিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অপর গেরিলা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ২০ জনের একটি দল বাছাই করা হলো। দলের ভেতর শাহনাজ ও মনসুরের (মধ্যবয়সী এক সময়ের পার্বতীপুরের নামকরা ডাকাত) কাজ ছিল পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর যাওয়ার পথে ২-৩টি রেলব্রিজ ধ্বংস করে যোগাযোগব্যাবস্থা পর্যুদস্ত করা। মনসুর ওই দলের কমান্ডারের রানার হিসেবে নিযুক্ত হয়। কমান্ডার তারেক ক্যাম্প এয়ডজুটেন্ট মহসীনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাইন ও বিস্ফোরক দরব্য বুঝে নেন। তারা বড়হাট ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার গ্রহণ শেষে ভাঙ্গারহাট শরণার্থী শিবির হয়ে রাতের গভিরে সীমানা পার হয়ে ৭-৮ মেইল ভেতরে এসে পৌঁছান আনুমানিক রাত ২টায় এবং এক পরিত্যাক্ত হিন্দুবাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধারা আনুমানিক রাত ২টার দিকে ট্যাক্সেরহাট গ্রামে এসে পৌঁছান। ট্যাক্সেরহাট হয়ে পার্বতীপুর রেললাইন ব্রিজ এবং এ ব্রিজে বিস্ফোরক লাগাতে এবং বিস্ফোরক ঘটাতে অনেক সময় লাগবে বলে তারা ওই দিন ব্রিজ থেকে হাজার গজ দূরে পাশের গ্রামে অবস্থান করেন। রাতে ২ জন করে পালাক্রমে ডিউটি করেন। পরের দিন দুপুরে ঠিক খাবার সময় শক্ররা তাদের দিকে তিন দিক দিয়ে ফায়ার শুরু করল। তখন মুক্তিযোদ্ধারা তাড়াহুড়া করে বাড়ির চারদিকে অবস্থান নেয়। শাহনাজ ও তার দলকে রেল ব্রিজের দিকে, খালেদ ও তার দল ট্যাক্সেরহাট বাজার, আবু ও তার দল আমবাগানের দিকে পজিশন নিয়ে ফায়ার করতে থাকে। পাকসেনারা আমবাগান অতিক্রম করে প্রায় গ্রামের কাছাকাছি চলে আসে কিন্তু আবুর দলের এলএমজি ও এসএসআর-এর বৃষ্টির মত গুলিতে পাকসেনারা আমবাগান ছেড়ে পাকা রাস্তায় চলে যায়। যাওয়ার সময় ফেলে যায় দুজন মৃত পাকসেনাকে। অদিকে শাহনাজ রেলব্রিজের ওখানে পাকসেনাদের একটুও নড়তে দেয়নি। ওরা আসার চেষ্টা করছিল কিন্তু ফিরে যেতে বাধ্য করেছে শাহনাজ। কমান্ডার বুঝতে পারলেন চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করেছে। বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকসেনাদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে, যাতে তারা গ্রামের ভেতর ঢুকতে না পারে। কারণ এখন সময় বেলা সাড়ে তিনটা। দিনের বেলায় পেছনে পালানোর উপায় নেই। ওরা দেখেশুনে টার্গেট করে গুলি করবে। তাছাড়া পেছনে বিরাট একটা বিল, বিলের বুকসমান পানির ভেতর দিয়ে পালাতে হবে। দিনের বেলা এভাবে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল। যেভাবে হোক সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকসেনাদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে। দৌড়ে প্রত্যেক দলের কাছে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন। আরো বললেন, পাকসেনাদের না দেখা পর্যন্ত মিছামিছি গুলি করে যেন গুলি শেষ না করে। গুলি শেষ হলেই ওরা আক্রমণ করবে। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত এই গুলি দিয়ে টিকে থাকতে হবে। ছেলেরা সবাই এই কথার মূল্য মর্মে মর্মে বুঝতে পারল। ওদিকে পাকসেনাদের দিক থেকে অজস্র গুলি হচ্ছে। চারদিকে ওদের গুলি এসে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারাও গুলি করছে মিতব্যায়িতার সাথে। খালেদের দলের ডান দিকে এক ঘরের ধারে তারেক ওসমানকে ২ ইঞ্চি মর্টারটা বসিয়ে ট্যাক্সেরহাট ও আমবাগানের অপর ফায়ার করতে বললেন। পরপর দুটো করে চারটা গোলা ওদের পজিশনে পড়ার পর ওদের গুলির বেগ কমে গেল। এলোপাতাড়ি গুলি করা ওরা বন্ধ করে দিল। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের একটু নড়াচড়ার আভাস পেলেই গুলি করছে। বুঝতে পারা গেল গ্রামে এগিয়ে আসার সাহস ওই হানাদারদের আর নেই। গ্রামের লোক ইতিমধ্যে কে যে কোথায় লুকিয়েছে বুঝতে পারা গেল না। হঠাৎ একজন গ্রাম্য বধূ দৌড়ে এসে কমান্ডার তারেককে ডানদিকের একটি পুকুর পাড়ে শক্রুদের অবস্থান দেখায়। আবু কমান্ডারের নির্দেশে তিন-চারবার এলএমজি ফায়ার করে। তখন পাকবাহিনী পালাতে থাকে। পুরো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর স্বাধীনতাকামী সেই গ্রামের বধূটি আবারও হানাদারদের অবস্থান প্রদর্শন করে। অতঃপর শেষ বারের মতো মুক্তিযোদ্ধারা কভারিং ফায়ার দিয়ে পেছন দিক দিয়ে বিলের বুকসমান পানি পার হয়ে অন্য অবস্থানে চলে যায়। দুই দিন পর জানা যায় যে, পাক হানাদারদের চারজন নিহত ও দুজন আহত হয়। ওই গ্রামে রাজাকার থাকার কারণে তারাই পার্বতীপুর আর্মি ক্যাম্পে খবর দেয়। ওই রাতেই পশ্চিম দিকে প্রায় তারা আট মেইল এগিয়ে যায়, সেখানে এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে ওঠে ও পাক হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন খবর নেয়। অতঃপর শাহনাজকে দলের দায়িত্ব দিয়ে কমান্ডার তারেক, খালেদ, ও ওসমান রেকির উদ্দেশ্যে বেইর‍্যে যায়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!