টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অপারেশন, গোপালগঞ্জ
গোপালগঞ্জ মহকুমা হেড কোয়ার্টারে পাকসেনারা স্থায়ীভাবে ঘাঁটি করার পর তারা পাকহানাদার বাহিনীর এদেশিয় দোসরদের খবর অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। টুঙ্গীপাড়ার স্থানীয় পাকদালালাদের সংবাদ এবং সহযোগিতায় তারা টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। ২৫ মার্চের পর শেখ কামাল ও শেখ সেলিম ঢাকা থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া চলে আসে। ওদিকে খুলনা থেকেও বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ নাসেরও তার পরিবার-পরিজন জিয়ে টুঙ্গীপাড়া এসে অবস্থান করছিলেন। শেখ কামাল ও শেখ সেলিম বাড়ি এসে নিস্ক্রীয় হয়ে বসে থাকেনি। তারা ৫/৬ টি সিভিলগান সংগ্রহ করে গ্রামের যুবক ছেলেদের নিয়ে টুঙ্গীপাড়া শেখ বাড়ির খেলার মাঠে ট্রেনিং দেওয়া শুরু করে। এইরূপ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কাজ ১৫ দিন পর্যন্ত চালিয়ে শেখ কামাল ও শেখ সেলিম ভারত চলে যান। কিন্তু তারা টুঙ্গীপাড়া যুবকদের নিয়ে যে ট্রেনিং দিচ্ছিলেন এই সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গোপালগঞ্জ হানাদারবাহিনী কতৃক দখল হওয়ার পর টুঙ্গীপাড়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম পাঁচকাহনিয়ার পাকদালাল মাওলানা আক্কেল আলী ও অন্যান্য দালালরা পাকসেনাদের সহিত যোগাযগ করে এই মর্মে সংবাদ দেয় যে, টুঙ্গীপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি এবং সেখানে যুবকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।
ফলে এই সংবাদ পেয়ে ১৯ মে পাকহানাদার বাহিনীর ১৫০ জন পাকসৈন্য রণসাজে সজ্জিত হয়ে লঞ্চযোগে গোপালগঞ্জ হতে আসে। তাদের সাথে ঐ কুখ্যাত পাক-দালাল মাওলানা আক্কেল আলীসহ মুসলিম লীগের অন্যান্য দালালরাও ছিল। পাকসেনাদের লঞ্চ নদীর কূলে শেখ পাড়ার রাস্তার নদীর দিকের শেষপ্রান্তে এসে নোঙ্গর করে। নদী দিয়ে আসার সময় প্রথমে নজরে পড়ে শেখ বাড়ির শেখ বোরহান উদ্দীন ও তার এক চাচাত ভাই শেখ কাইয়ুমের। তখন সকাল অনুমান ৬ ঘটিকা। পাকসেনারা লঞ্চ থেকে নিচে নামলে পাকদালাল মাওলানা আক্কেল আলী তাদের সামনে থেকে পথ দেখিয়ে দিয়ে শেখ বাড়িতে নিয়ে আসে। শেখ বরহান ও শেখ কাইয়ুম যারা প্রথম পাকসেনাদের আগমন দেখতে পেয়ে বলেছিল, ‘তোমরা সবাই পালাও’। কিন্তু এই ঘটনার পূর্বেও কয়েকবার পাকসেনাদের আসার মিথ্যা ক্সংবাদ রটেছিল। সুতরাং বোরহানও কাইয়ুমের কথায় বাড়ির লোকজন প্রথম বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু যখন বাড়ির সামনে এসে বাড়ি পাকমিলিটারীরা ঘেরাও করতে থাকে তখন সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। হঠাৎ পাকসেনাদের এই আগমনে শেখ বাড়ির সবাই তখন মরণমুখী বিপদে বাড়ি ঘর আসবাবপত্র ফেলে গ্রামে চলে যায়। পাকসেনারা বন্ধবন্ধুর বাড়িতে এসে ঘেরাও করে ফেলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী পাবে কোথায় ? হঠাৎ এই আগমনে যেসব বৃদ্ধ ও যুবকরা পালাতে পারেনি, তারা মিলিটারীর হাতে ধরা পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বৃদ্ধা মা ও বৃদ্ধা বাবা পালাতে না পেরে বাড়িতেই ছিলেন। পাকসেনারা তাদেরকে খুব সম্মানের সাথে ঘর থেকে বের করে বাইরে চেয়ারে বসিয়ে রাখে। অতঃপর পাকসেনারা বঙ্গবন্ধুর টিনের ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে সিন্দুক ও ষ্টীলের আলমারী ভেঙ্গে সোনা, রূপা ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে পাউডার ছিটিয়ে গুলি করে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। অনুরূপ ভাবে শেখ মুসার ঘরও লুঠ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই দুটি ঘর জ্বালিয়ে ভস্মিভূত করে দেওয়ার পর পাশেই খানসাহেব মোশাররফ হোসেনের ঘরের দিকে পাকসেনাদের নজর পড়ে। কিন্তু তারা যখন খান সাহেবের ঘর এই কথা শুনল তখন আর জ্বালাল না। শেখ বোরহান পালিয়ে যেতে পারেননি, তাদের ঘরের মধ্যেই সে ছিল। ঐ ঘরে ৪ জন বৃদ্ধা মহিলাও ছিলেন। তারা সবাই দোয়া দরুদ বা কেউ কেউ কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। বোরহান যুবক ছেলে। সবারই তখন চিন্তা বোরহানকে নিয়ে। পাকসেনারা ঘরে ঢুকে তাকে দেখতে পেলেই গুলি করে মেরে ফেলবে। একসময় পাকসেনারা ঘরে ঢুকে পড়ে। তারা বোরহানকে ধরে ফেলে। বৃদ্ধা মহিলাদের মধ্যে উর্দুতে একজন কথা বলতে পারতেন। তিনি পাকসেনাদের বুঝিয়ে বললেন, ‘আমরা খুব শরীফ লোকও ছেলেটিও ভাল। তাকে ছেড়ে দেন’। এই বলে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। একজন পাকসেনা ধরে নিয়ে যেতে চায়, অন্যজন ছেড়ে দিতে বলে। অবশেষে বোরহানকে ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে পাকসেনারা বের হয়ে যায়। শেখ বোরহানের বাবা শেখ আব্দুল হান্নান, চাচা শেখ মুনসেরুল হক ও শেখ জাহাঙ্গীর আলমকে খানসেনারা ধরে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে ছেড়ে দেয়। গ্রামের আরও ৬/৭ জন বৃদ্ধ লোককে ধরে এনে মারপিট করে। পাশের বাড়ি হতে যুবক ছেলে মিঠুকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেনের বাড়ির চাকর আরশাদ আলী পাকসেনাদের নিকট গিয়ে চা খাওয়ার প্রস্তাব দিলে তাকে মারপিট করে এবং গুলি করে হত্যা করে। শেখ বাড়ি মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আছে বলে পাকসেনাদের নিকট সংবাদ দিয়ে পাকদালাল মওলানা আক্কেল আলী তাদের টুঙ্গীপাড়া নিয়ে আসে। কিন্তু এখানে এসে মুক্তিবাহিনীর লোক না পেয়ে তারা আক্কেল আলীকে এই বলে ধমকায়, ‘তোম জুট বলতা হায়’। মুক্তি বাহিনীর লোক হিসাবে সনাক্ত করায় পাকসেনারা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। সর্দার ও লিকু নামে দুটি ছেলেকে দিয়ে লঞ্চ পর্যন্ত লুঠের মালামাল বহন করিয়ে নিয়ে যায় এবং পরে লঞ্চের নিকটই তাদের গুলি করে মেরে ফেলে। এই ঘটনার প্রায় ২০ দিন পর, বাংলা তখন বৈশাখ মাস-স্থানীয় পাকদালালরা শেখ বাড়ি জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প করে। গেমডাঙ্গার হাফেজ আবুল কাসেমের নির্দেশে শেখ বাড়ি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মাওলানা আক্কেল আলী, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অন্যান্য শরীকের ঘরগুলি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। দ্বিতীয় দফা পোড়ালে শেখ বাড়িতে কোন ঘরই ছিল না। বহু পুরানা আমলের টুঙ্গীপাড়া বনিয়াদী এই শেখ বাড়ির বাসিন্দাদের যুগের পর যুগ সঞ্চিত লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল ও আসবাবপত্র প্রভৃতি সব কিছু সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা খান সাহেবের নাম শুনে সম্মান দেখিয়ে তার ঘরগুলি জ্বলায় নি। কিন্তু স্থানীয় এই দালালরা সেই খান সাহেবের ঘরগুলিও অগ্নিকান্ড থেকে রেহাই দেয়নি।
[৬৩৫] মোঃ সোলায়মান আলী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত