ঝিকুরা অপারেশন, ব্রাক্ষণবাড়িয়া
কুমিল্লা-ব্রাক্ষণবাড়িয়া প্রধান সড়ক হতে সামান্য পূর্বপার্শ্বে কসবা থানাধীন ঝিকুরা গ্রাম অবস্থিত। জুলাই মাসের ১০ তারিখে এই গ্রামের ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সি কোম্পানির ৭ নম্বর প্লাটুন অভিযান চালায়। এই অভিযানে ১২ জন হানাদার সহ একটি স্পীডবোট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। সহজ পরিকল্পনা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা ও সমন্বয় সাধন এবং উদ্দেশ্য কার্যকর করার মনোবল থাকলে দিনের বেলাতেও যে অ্যাম্বুশ/অপারেশন পরিচালনা করা সম্ভব এটা তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।
মে/জুন মাসে শত্রু কসবা থানার শালদানদী, মন্দভাগবাজার কামালপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে। সুবেদার ওহাব ও মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্ব উপর্যুপরি কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা ফলে শত্রু রেললাইন ধরে চলাচল বন্ধ করে দেয়। এইসব এলাকায় যোগাযোগ জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তারা কুমিল্লা থেকে সিএন্ডবি সড়ক যোগে কালামুড়িয়া ব্রিজ পর্যন্ত আসার পর সেখা থেকে উল্লেখিত স্থানসমূহে রসদ গোলাবারুদ ও সৈন্য পাঠানোর জন্য নদীপথ ব্যবহার করতে শুরু করে। শত্রুকে এই জলপথে অবাধে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্য নদীপথে অ্যাম্বুশ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সুবেদার ওহাব ২২ জন সৈনিক নিয়ে ঝিকুরার উদ্দেশ্যে মঈনপুর গ্রামের অবস্থান ত্যাগ করেন। সকাল ১১ টার দিকে পাঁচটি ছোট নৌকায় করে সুবেদার ওহাব তাঁর অ্যাম্বুশ পার্টি নিয়ে ঝিকুরা এলাকায় পৌঁছে গেলেন। নৌকাগুলোকে পাটক্ষেতের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হলো। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার নেতৃত্বে তিনটি এলএমজিসহ একটি দল নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থান গ্রহণ করল। সুবেদার ওহাব নদীর পূর্ব তীরে একটি বটগাছের নিচে তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী এলএমজিটিসহ অবস্থান নিলেন। সুবেদার ওহাবের অবস্থানের একটু দক্ষিণে খুব কাছাকাছি একটি স্থানে নদীর তীর ঘেঁষে পাটক্ষেতের ভেতরে দুইটি এলএমজিসহ চারজনের একটি দল অবস্থান নিল। ল্যান্স নায়েক সামসুল হকের নেতৃত্বে একটি এলএমজি এবং একটি এসএমজিসহ তিনজনের আরেকটি দল কিছু দক্ষিণে নদীর তীরের ধানক্ষেতে অবস্থান নিল। শত্রু যখন অ্যাম্বুশ এলাকার পাশাপাশি পৌঁছে যাবে তখনই সকলকে পানির ওপরে মাথা ও ঘাড় রেখে নদীর তীরে এসে সুবেদার ওহাবের ভেরি লাইট পিস্তল থেকে একটি গুলি নিক্ষেপের পরই একযোগে সকল অস্ত্র থেকে গুলি নিক্ষেপ শুরু হবে বলে জানানো হলো। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দল সময় ও সুযোগ বুঝে সুবেদার ওহাবের সাথে বিল এলাকয় একত্রত হয়ে মঈনপুরে ফিরে যাবার পরিকল্পনা করা হয়। আর এরই মধ্যে মঈনপুরে পাকিস্তানী বাহিনী অবস্থান নিয়ে নিলে মঈনপুরকে বাদ দিয়ে পুরো দলের সদস্যরা কোণাবরের উদ্দেশ্যে চলে যাবে। অ্যাম্বুশ পার্টির সদস্যদের অপারেশনটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে ব্রিফিং দেবার পর পরই পাকিস্তানী বাহিনীর ৬০/৭০ জনের একটি দলকে কালামুড়িয়া ব্রিজ এলাকা থেকে নদীর উত্তর-পূর্ব তীর ধরে অ্যাম্বুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে দেখা যায়। এদের দেখার পর অ্যাম্বুশ পার্টির সদস্যরা ঘাবড়িয়ে যান। সুবেদার ওহাব প্রতিটি দলের কমান্ডারকে ডেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রকার চিন্তা না করে নিজ নিজ অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেন। কেননা এরই মধ্যে দুপুর ১২টা বেজে গেছে। ২টা থেকে ৩টার মধ্যে শত্রু অবশ্যই কালামুড়িয়া ব্রিজ অবস্থানে পৌঁছার জন্য শালদা নদীর প্রতিরক্ষা অবস্থান হতে ফেরত আসবে। তাই দুপুর ১টা মধ্যেই সকলকে নিজ নিজ অবস্থানে পৌঁছে প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিরক্ষায় থাকতে হবে। শত্রু মঈনপুর পৌঁছে গেলেও অ্যাম্বুশ অপারেশন পরিচালনা কোনো পরিবর্তন ঘটবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। দুপুর আনুমানিক ১২টা ৪৫ মিনিটে দিকে পাকিস্তানী বাহিনীর ঐ দলটিকে মঈনপুর গ্রামের দিকে নদীর তীরের পায়ে হাঁটা পথ ধরে অগ্রসর হতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর মঈনপুর গ্রাম থেকে গাইড এসে জানায় সে কসবা থেকেও পাকিস্তানী বাহিনীর একটি দল ডিবি রোড ধরে কামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কামাল্পুর ব্রিজ এলাকায় অবস্থানকারী হাবিলদার মোসলেমের প্রটেকশন পার্টির সৈনিকরা অগ্রসরমান পাকিস্তানী দলের ওপর কিছুক্ষণ গুলি নিক্ষেপ করেওবস্থান ছেড়ে নাপতারবাজারের পেছনে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। কামালপুর এলাকায় গোলাগুলির আওয়াজ শুনে সি কোম্পানির ৯ প্লাটুনের প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার শহীদ তার প্লাটুনটি নিয়ে কামালপুরের দিকে অগ্রসর হন। সুবেদার শহীদ নাপাতারবাজারে পৌঁছালে হাবিলদার মোসলেমের সাথে দেখা হয়। সুবেদার শহীদ নাপতারবাজারে পৌঁছালে হাবিলদার মোসলেমের সাথে দেখা হয়। সুবেদার শহীদ ওহাবের অবস্থান জানতে চাইলে হাবিলদার মোসলেম মঈনপুর এলাকার কথা বলেন। এই সংবাদে সুবেদার শহীদ সুবেদার ওহাবের মঈনপুর অবস্থান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কেননা হাবিলদার মোসলেম তার কামালপুরের ব্রিজ অবস্থান ছেড়ে আসার ফলে মঈনপুরে পাকসেনারা পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করে বসতে পারে। সুবেদার শহীদ তাৎক্ষণিকভাবে হাবিলদার মোসলেমকে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। হাবিলদার মোসলেম কামালপুর ব্রিজ এলাকায় পুনরায় অবস্থান নেন। ততক্ষণে পাকিস্তানী পেট্রোল পার্টি কসবার দিকে পিছু হতে গিয়েছিল। হাবিলদার মোসলেমকে পাঠিয়ে দিয়ে সুবেদার শহিদ তার প্লাটুন নিয়ে সুবেদার ওহাবকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য মইনপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। সুবেদার শহীদ এসে জানতে পারেন যে সুবেদার ওহাব শালদানদী অপারেশন পরিচালনার জন্য সকলেই ঐ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। সুবেদার শহীদ মইনপুর অবস্থান করে সেখানে অবস্থানরত সুবেদার ওহাবের রিয়ার প্রটেকশন পার্টি দুটি শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নেন। শত্রুর পেট্রোল পার্টি মইনপুরের দিকে অগ্রসর হলে অ্যাম্বুশ এলাকায় অবস্থানকারী দলগুলো আপাতত শত্রুর মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পেল। অবশেষে আসে প্রতীক্ষিত সময়টি/ তখন দুপুর ২টার মত হবে। পাকসেনারা শালদানদী এবং মন্দভাগ কাম্পে নৌকায় করে বহন করা সমরাস্ত্র, গোলাবারুদ অ রেশনসামগ্রী নামিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র স্পীডবোট নিয়ে ফিরে আসছিল। নৌকাগুলো তাঁরা মন্দভাগ কাম্প এলাকায় রেখে এসেছিল। স্পীডবোট আরোহীদের মাথার ওপরে চাট ছাতা দেখা গেল। সম্ভবত দুপুরের করা রোদের তাপ থেকে বাঁচার জন্য এগুলো ব্যবহার করেছিল। স্পীডবোটের আরোহীদের সংখ্যা ছিল ১২ জন। স্পিডবোটের পেছনে কোনো নৌকা দেখা গেল না। তাছাড়া নদীর দুই তীরে ধরেও পাকিস্তানীদের কাউকে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হতে দেখা গেল না। তাছাড়া নদীর দুই তীর ধরেও পাকিস্তানীদের কাউকে পয়ায়ে হেঁটে অগ্রসর হতে দেখা গেল না। বাতাসে ছাতা উড়ে জেতে পারে সেজন্য স্পিডবোটের গতিও তেমন ছিল না। বাতাসে ছাতা উড়ে যেতে পারে সেজন্য স্পীডবোটের গতিও তেমন ছিল না। দুই-তিনজনকে বাইনোকুলার হাতে নদীড় তীর পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেল। সুবেদার ওহাবের নির্দেশ মতো আম্বুশ পার্তির সৈন্যরা ধান অ পাটক্ষেতে শুধুমাত্র মাথা ওপরে রেখে অবস্থান নিয়েছিল। কাজেই শরুর বাইনোকুলার সম্ভবত অ্যাম্বুশ পার্টির কাউকে দেখা যায়নি। শত্রুর স্পীডবোটটি যখন সুবেদার ওহাবের অবস্থানের ২৫ গজের মধ্যে এসে পৌছাল তখনই সুবেদার ওহাব শরীরটা পানির ভেতর থেকে কিছুটা উঁচু করে তাঁরা এলএমজি থেকে ফায়ার করলেন। সাথে সাথে সবকটি অস্ত্র শত্রুর স্পীডবোটকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করল/ স্পীডবোটের কয়েকজন আরোহী ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেডিক্যাল কোরের একজন বাঙালি কাপ্তেন ছাড়া অন্য কাউকে ভেসে উঠতে দেখা গেল না। বাঙালি ক্যাপ্টেন পানির ওপরে ভেসে দুইহাত ওপরে তুলে আত্নসমর্পণের ইঙ্গিত দেন এবং তাঁকে প্রানে বাঁচানোর জন্য বাংলা ভাষায় চিৎকার করতে থাকেন। কিন্ত এরই মাঝে অনেকগুলো গুলি তাঁকে ঝাঁঝরা করে ফেলল তার দেহটি পানির ভেতরে ডুবে যায়। ব্যাপক গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া স্পীডবোটটি ততক্ষণে নদীর দক্ষিণা বাতাসে নদীর পশ্চিম তীরে গিয়ে ভিড়ে। নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থানকারী আয়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে সুব্দার ওহাব চিৎকার করে কিছু লোক দিনে স্পীডবোটটিকে পূর্ব তীরে নিয়ে আস্তে নির্দেশ দেন। নির্দেশ্মতো নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া তার লোকের সাতার দিয়ে স্পীডবোটটিকে নদীর পূর্ব তীরে ভিড়ান। স্পীডবোটটিতে শত্রুর একটি বড় ধরনের অপারেশন ম্যাপ পাওয়া গেল। পলিথিন পেপারে মোড়ানো ঐ ম্যাপটিতে সিলেটের জৈন্তাপুর থেকে কুমিল্লার বিবিরবাজার পর্যন্ত শত্রুর প্রতিটি অবস্থানই সহ সিগনেচার কলমে মারকিং করা ছিল। লাল কালিতে মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি ক্যাম্প ও অবস্থান মার্কিং করা ছিল। ম্যাপটি পাকিস্তানীর আর্টিলারি ইউনিটগুলোর অবস্থান এবং ঐ সকল গান কতদূর পর্যন্ত ফায়ার কভার দিতে সক্ষম তাও মার্কিং করা ছিল। এছাড়া স্পীডবোটে পাওয়া গেল একটি ওয়ারলেস, একটি এলএমজি, কয়েকটি এসএমজি এবং কিছু গোলাবারুদ। সুবেদার ওহাব স্পীডবোটের ইঞ্জিনটি খুলে নিতে নির্দেশ দিলেন। ওয়ারলেসসেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে শত্রুর স্পীডবোটটিকে খুঁজে বের করার জন্য অন্য স্পীডবোট নিয়ে যে কোনো সময় চলে আসার সম্ভাবনা ছিল। তাই অভিজ্ঞ সুবেদার ওহাব অ্যাম্বুশ স্থলে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রু মৃত লাশগুলো ভেসে উঠল। মুক্তিযোদ্ধারা এদেরকে টেনে-হিঁচড়ে তীরে আনলেন। স্পীডবোটের ওপর মৃত অবস্থায় পড়েছিল কুখ্যাত আর্টিলারি অফিসার ক্যাপ্টেন বোখারীর লাশটি। একাত্তরের বৃহত্তর কুমিল্লাবাসীদের মধ্যে এমন কেউ নেই যারা ক্যাপ্টেন বোখারীর নাম জানত না। এই অত্যাচারী পাকিস্তানী অফিসারটি পাখির মত নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করত। সুবেদার ওহাবের এই অ্যাম্বুশ অপারেশনের শত্রু ২ জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ২ জন মেজর, ৩ ক্যাপ্টেন, ১ জন সুবেদার মেজর, ১ জন সৈনিক, ১ জন সিভিল পোশকের ইঞ্জিনিয়ার, ১ জন ব্যবসায়ী ও স্পীডবোটের অপারেটরসহ মোট ১২ জন নিহত হয়। স্পীডবোটের কেউ জীবিত ছিল না। সুবেদার মেজরটি ছিল ৩৩ বেলুচ এর সুবেদার মেজর গজনওয়াব আলী টিকে। ২ জন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মধ্যে একজন ছিলেন ৩৩ বেলুচ-এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মধ্যে একজন ছিলেন ৩৩ বেলুচ-এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাজহারুল কাইয়ুম। ১২ জন নিহত শত্রুসেনার মধ্যে ৭ জন ছিল কমিশন্ড অফিসার এবং ১ জন ছিল জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। এই অভিযানে পাকিস্তানীদের স্পীডবোট থেকে ১টি এলএমজি, ১টি জি-৩, ১টি এসএমজি ও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল ম্যাপ উদ্ধার করা হয়। এই ম্যাপে প্রাপ্ত তথ্যাদি পরবর্তীতে ব্যবহার করা হয়। ঝিকুড়া অপারেশনের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী। এই অপারেশনের ফলে দখলদার বাহিনীর নির্বিঘ্নে একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচল হুমকীর সম্মুখীন হয়। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তাদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তযুদ্ধের নয় মাসে একটি অপারেশনের এত সংখ্যক পাকবাহিনী অফিসারের নিহত হবার আর কোনো নজির নেই।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত