You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঝিনাইদহের যুদ্ধ

যশোর জেলার ৩৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ঝিনাইদহ একটি ছোট জেলা শহর। ১৯৭১ সালে এটি ছিল একটি সাধারণ শহর। এর পশ্চিমে চুয়াডাঙ্গা, পূর্বে ফরিদপুর ও উত্তরে কুষ্টিয়া। ভারত সীমান্ত ঝিনাইদহের ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত
ঝিনাইওধ এলাকা উত্তরে রাজাপুর এবং দক্ষিণে দর্শনা থেকে গোয়াললন্দ ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মিত্রবাহিনী প্রায় বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ ছাড়াই খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের মাধ্যমে এলাকাটি শত্রুমুক্ত করে।
৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ৪১ ব্রিগেডের দুটি ব্যাটালিয়ন দর্শনা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী সহায়তায় ২২ রাজপুত দক্ষিন-পশ্চিম দিক থেকে অনুপ্রবেশ করে ব্লকিং পজিশন স্থাপন করে। অপর একটি ব্যাটালিয়ন একই দিন বিকেল ৪টায় লোকমানপুর দখল করে। ৫১ ডোগরা রেজিমেন্ট দিনের প্রথম আলোয় দর্শনা দখল করে। এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ছিল ৯২ জন। ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট দর্শনা থেকে চুয়াডাঙ্গা পশ্চাৎপসরণ করে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়।
৪১ ব্রিগেড চুয়াডাঙ্গার দিকে না গিয়ে ২২ রাজপুত ব্যাটালিয়নকে দর্শনা রেখে কোটচাঁদপুর এবং ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়। ইতিমধ্যে ৬২ ব্রিগেড জীবননগরের শত্রু অবস্থানকে বাইপাস করে খালিশপুর-কোটচাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং ৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় সোয়াদী দখল করে। একই দিনে তাঁরা বিকেল ৪টার মধ্যে কোটচাঁদপুর দখল করে।
মিত্রবাহিনী কর্তৃক সোয়াদী দখলের পর ৪৮ এফএফ জীবননগরে অবস্থান নেয় এবং ৫০ পাঞ্জাব ঝিনাইদএর পশ্চাৎপসরণ করে। সোয়াদী, কোটচাঁদপুর এবং দর্শনার যুদ্ধ শেষে৪১ ব্রিগেড পশ্চিম সোয়াদীতে ৪ ডিসেম্বর সমবেত হয়।
৫ ডিসেম্বর দিনের শেষে ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড কোটচাঁদপুরে সমবেত হয়। এরপর ঝিনাইদহ আক্রমণের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। জেনারেল ব্রার পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪১ ব্রিগেডের ৫ গার্ডস সাধুহাটিতে একটি রোড ব্লক স্থাপনের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গাকে বিচ্ছিন্ন করে। ৪১ ব্রিগেডের বাকি অংশ পশ্চিম দিক থেকে ঝিনাইদহ আক্রমণের জন্য যাত্রা করে। ৬২ ব্রিগেড প্রধান সড়কে ধরে অগ্রসর হয়ে কালীগঞ্জ শত্রুমুক্ত করে এবং ঝিনাইদহ আক্রমণের জন্য রওয়ানা হয়।
৪১ ব্রিগেড ২৮ ঘন্টা অগ্রাভিযানের পর ৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় শত্রুর বাধার সম্মুখীন হয় এবং ১১.৩০ মিনিটে আক্রমণ করে প্রায় যুদ্ধ ছাড়াই ঝিনাইদহ দখল করে। দখলদার বাহিনী (প্যারামিলিটারি সমন্বয়ে গঠিত) নিজেদের অবস্থান ছেড়ে যায়, এমনকি তাঁরা নিজস্ব অ্যামিউনিশন ড্যাম্প ধ্বংস করতেও ব্যর্থ হয়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী খালিশপুর ও দর্শনা দখল করে। খালিশপুর ব্রিজটিও তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৪ মাউন্টেন ডিভিশন মেজর জেনারেল ব্রার নেতৃত্বে দুটি অক্ষ ধরে অগ্রসর হতে থাকে। ৪১ ব্রিগেডিয়ার টনির নেতৃত্ব মিশিগান-উথালি-সোয়াদি-কোটচাদপুর অক্ষে এবং ৬২ বিগ্রেডিয়ার রাজেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে জীবননগর-কালিগপ্নজ-ঝিনাইদহ অক্ষ ধরে অগ্রসর হয়। ৪১ বিগ্রেডকে পরবর্তীতে শত্রুর যোগাযোগ লাইন ধ্বংস করার উদ্দেশ্য দর্শনা দখল করার জন্য আদেশ দেয়া হয়। এ লক্ষ্যে চোউগাছাকে দর্শনা থেকে আলাদা করার জন্য একটা রোড ব্লক তোইরি করা হয়। বিগ্রেডিয়ার মঞ্জুর চুয়াডাঙ্গাকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে হেডকোয়ার্টারকে ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গাকে স্থানন্তর করেন। তিনি ভেবেছিলেন যদি মিত্রবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে ফেলে তাহলে তিনি ঝিনাইদহ বাঁ কুষ্টিয়ার দিকে চলে আসবেন। কিন্ত তার উপস্থিতি সত্তেও মিত্রবাহিনী ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর দর্শনা দখল করে নেয়। বিগ্রেডিয়ার মঞ্জুর তার সৈন্যদের বিওপি থেকে সরিয়ে চুয়াডাঙ্গায় সংঘবদ্ধ করেন। পাকবাহিনী ভেবেছিল মিত্রবাহিনী চুয়াডাঙ্গা অথবা কালিগঞ্জ দিয়ে অগ্রসর হবে। কিন্ত তাঁরা দুই অক্ষের কোনোটাতেই না গিয়ে স্থানিয় মুক্তিবাহিনির সহায়তাউ সোয়াদি হয়ে চলে আসে এবং সাধুহাটিতে রোড ব্লক দিয়ে চুয়াডাঙ্গাকে ঝিনাইদহ থেকে পৃথক করে ফেলে। অগরসর হওয়ায় সময় মিত্রবাহিনী সোয়াদির কাছে পাকিস্তানী বাহিনি দ্বারা অপ্রত্যাশিত বাধার সম্মুখীন হয়। পাকবাহিনী দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পশ্চাদপসরণ করে। পাকাবাহিনীর কিছু যানবাহন ৫ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় মিত্রবাহিনীর ৫ গার্ড রেজিমেন্ট কর্তৃক সাধুহাটিতে তৈরি রোড ব্লকের সম্মুখীন হয়। তাঁরা ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে ছিল অনবহিত। ইতিমধ্যে ৪১ বিগ্রেডের ৫ গার্ড রেজিমেন্ট এবং ৯ ডোগরা রেজিমেন্ট ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল বেলা ১২টার মধ্যে কোটচাঁদপুর দখল করে ফেলে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ ডোগরা রেজিমেন্ট ৭ তারিখ সকাল ৯টায় ঝিনাইদাহ পৌঁছে ঝায়। সসাধুহাটি থেকে আগত দুই ট্রুপ ট্যাঙ্কের সহায়তায় মিত্রবাহিনীর দ্রুত আক্রমণ চালিয়ে দুপুর ১ টার মধ্যে ঝিনাইদাহ দখল করে নেয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!