You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছাতক অভিযান, সুনামগঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী হাই কমান্ড হিসেব করছিলেন যে, [সুনামগন] ছাতকে একটা সফল অভিযান চালাতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এখানে পাক বাহিনীকে একটা প্রচণ্ড রকমের ধাক্কা দিতে পারলে ফল হবে তিনটাঃ (১) পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আর তাচ্ছিল্য না করে সস্ত্রস্ত্র হবে, (২) আত্নর্জাতিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের একটা অগ্রগতির ইমেজ হবে এবং (৩) মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল সাংঘাতিকভাবে বেড়ে যাবে। হিসেবের দিক থেকে এটা ছিল অতি চমৎকার। কিন্তু মাঠের বাস্তব অবস্থার খবর না নিয়ে প্রয়োজনীয় বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া এভাবে হুট করে অভিযানের আদেশ দিয়ে হাই কমাণ্ড উপযুক্ত যুদ্ধ পরিচালকের পরিচয় দেয়নি। ছাতক, দোয়ারবাজার, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি তখনও প্রচুর পানিবেষ্টিত। অথচ অভিযানকারীদের তেমন কোনো নৌ-যান ছিল না। খবরা-খবর দেয়া নেয়ার জন্য তাদের কোনো ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়ারলেস ছিল না। ফলে অগ্রসর হওয়ার বা পিছু হটার কোনো খবর এক কোম্পানি ওপর কোম্পানিকে বা ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারকে দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই এই অভিযানে দারুণ কষ্ট ও অসীম সাহসিকতা দিয়ে যেটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী, মেজর শাফায়েত জামিলকে নির্দেশ দেন দ্রুত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর শাফায়েত জামিল তাঁর অধিনস্ত আলফা কোম্পানিকে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে, ব্রাভো কোম্পানিকে ক্যাপ্টেন আকবর হোসেনের নেতৃত্বে এবং ছাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন মহসিন উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন চার্লি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেন দোয়ারবাজারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যেন সুনামগঞ্জ থেকে নদী পথে পাক বাহিনী ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে না পারে। লেফটেন্যনেন্ট নূর-উন-নবীর অধীনে ডেল্টা কোম্পানী নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে যাত্রা করে। চার্লি বা সি কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহসিন যাত্রার প্রাক্কালে খবর নিয়ে জেনেছিলেন যে, দোয়ারাবাজারের নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে পাকসেনারা অতর্কিত আক্রমণ করে ক্যাপ্টেন মহসিনের চারটা নৌকাই ডুবিয়ে দেয়। এতে সি কোম্পানির কিছু সৈনিক শহীদ হয়। অন্যেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সমস্ত সরঞ্জাম পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং ক্যাপ্টেন নিজে সুরমা নদী সাঁতরিয়ে দোয়ারাবাজারের দক্ষিণে দোহালিয়া গ্রামে গিয়ে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি গ্রামবাসীর সাহায্যে চারদিন পর কোনো মতে সেনা সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফেরৎ যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তখন ছাতকের যুদ্ধ শেষ অপরদিকে ডেল্টা বা ডি কোম্পানি নিয়ে লেঃ নূর-উন-নবী গোবিন্দগঞ্জ অগ্রসর হওয়ার পথে জাউয়া বাজারের ব্রীজের নিকট পাকসেনা কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে বাধ্য হন। ফলে তাঁর পক্ষে গোবিন্দগঞ্জে ঈন্সিত প্রতিরোধ সৃষ্টি আর সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সকল প্রকার অসুবিধা অতিক্রম করে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের আলফা কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আকবরের ব্রাভো কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন হেলালের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী যুদ্ধ করতে করতে ছাতকের সিমেন্ট ফ্যাক্টরী পর্যন্ত দখল করে। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের আলফা কোম্পানি সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে অবস্থান নিয়ে ছাতক বাজারের দিকে গোলা বর্ষণ করছিল। আর পাকসেনারা সুরমা নদীর উত্তর পূর্ব পাড় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট সমর্পণ করে পিছু হটে এসে সুরমার দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ে ছাতক বাজারের বরাবরে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। অর্থাৎ সুরমা নদীকে সামনে রেখে উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছিল। এ সময় পাকবাহিনী যথেষ্ট অফিসার, সিপাহী ও গোলাবারুদ হারিয়ে দুর্বল হয়ে তাদের সদর দপ্তরে খবর দিলে তাদের সাহায্যার্থে সিলেট থেকে ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটা কোম্পানী, নিয়মিত আর্টিলারী বাহিনীর একটা কোম্পানী এবং একাধিক ফিল্ডগান ও যথেষ্ট গোলাবারুদ পাঠানো হয়। এতে ছাতক বাজার এলাকায় অবস্থানরত পাকবাহিনী শক্তি বৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু তারা সুরমা নদীর অপর পাড়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করার সাহস পায়নি। তবে তারা তাদের অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গোলাবর্ষণ করছিল যাতে মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদী পেরিয়ে এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা (আলফা কোম্পানী) ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী এলাকায় নিজেদের অবস্থান থেকে সুরমার অপর পাড়ের পাকবাহিনীর প্রতি গোলা বর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল। এসময় সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর স্বল্প পেছনে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আকবরের ব্রাভো কোম্পানী লক্ষ্য করে যে তাদের পেছন দিকে থেকে গুলি আসছে। এতে ক্যাপ্টেন আকবর বুঝতে পারেন যে, শত্রুপক্ষ নিশ্চয়ই দোয়ারবাজার হতে এগিয়ে এসে পেছন দিকে ঘেরাও করেছে। তিনি তাঁর কোম্পানিকে নিয়ে এই আক্রমণের পাল্টা জবাবদান শুরু করেন এবং সারাদিন যুদ্ধ করে কোনোমতে নিজেদের টিকিয়ে রাখেন। তাদের কাছে দু’ইঞ্চি মর্টার, এল, এম, জি এবং রাইফেল ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার ছিল না। তাঁদের অবস্থানের মাটি এত নরম ছিল যে, মর্টার ব্যবহার করা দুস্কর ছিল। মর্টারম্যান একটা জায়গা বেছে মর্টার বসিয়ে প্রথমে গোলাটা মারার পর যখন দ্বিতীয় গোলাটা মারছিল তখন মর্টারটা মাটিতে ডোবে গিয়ে গোলাটা সামনের গাছে লেগে ফিরে এসে মর্টারম্যানের ওপর পড়ে এবং সাথে সাথে তিনি শহীদ হন। ঐ দিন সন্ধ্যায় আকবর হোসেন তাঁর কোম্পানির লোকজনকে একটা টিলায় একত্রিত করেন। পাকবাহিনী তখনও এদের পেছন থেকে ঘিরে রেখেছিল, কিন্তু সন্ধ্যায় পর এগুতে সাহস পায়নি। ঐ রাতে পাকবাহিনী আক্রমণ চালালে আকবর হোসেন ও তাঁর কোম্পানী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কারণ এই টিলার চারদিকে ছিল বিস্তর পানি। অপরদিকে সম্মুখ যুদ্ধরত আলফা কোম্পানি তখনও জানতনা যে, পেছনে শত্রু বেষ্টন করেছে। এসময় ক্যাপ্টেন আক্রব ভাবলেন যে, এভাবে সীমিত শক্তি নিয়ে সামনে পেছনে শত্রু বেষ্টিত অবস্থায় যুদ্ধ করে পেরে ওঠা কিছুতেই সম্ভব নয়। বরং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই নিশ্চিহ্ন হতে হবে। গেরিলা যুদ্ধের শিক্ষা হচ্ছে যে নিজেদের লোকজন বাঁচিয়ে যতটুকু পারা যায় শত্রুপক্ষের ঘায়েল করা। তাই ক্যাপ্টেন আকবর একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নিকট খবর দিয়ে লোক পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু ঘন অন্ধকারে অথই পানি পেরিয়ে কেউ যেতে সাহস পাচ্ছিল না। তখন ক্যাপ্টেন আকবর নিজে তাঁর রানারকে সাথে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবনগণ সাঁতার কেটে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের সাথে দেখা করে সামগ্রিক অবস্থা বুঝিয়ে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানিকে একত্রিত করে পাক বাহিনীর নজর এড়িয়ে ভারতের পাহাড় লক্ষ্য করে রওয়ানা দেন। এভাবে উপস্থিত বুদ্ধি ও অসীম সাহসের সাথে দু’টো কোম্পানির প্রায় চারশ মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে পাক বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য পরে বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন আকবর হোসেনকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিয় করে। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানী ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী এলাকার অবস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর না পেলেও ক্যাপ্টেন হেলাল যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান অনুধাবন করে তাঁর ছাত্রমুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি নিয়ে পাকবাহিনীর অলক্ষ্যে সেনা সাব-সেক্টর সদর দপত্রে কোনো মতে ফেরত যান। এভাবে ছাতকের যুদ্ধ ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবরে শুরু হয় ১৭ অক্টোবর শেষ হয়। এ যুদ্ধে প্রায় সত্তর/আশি জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনীরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাঁদের একজন কর্নেল মারা যায় এবং তারা সাংঘাতিক বেকায়দায় পড়ে যথেষ্ট নাকানি চুবানি খেয়েছিল বলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের পাবলিক রিলেশন্স অফিসার (পরে ব্রিগেডিয়ার) সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামক গ্রন্থে দেখা যায়।
[৭৬] মোহাম্মদ আলী ইউনুছ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!