জগজিৎ সিং অরোরা (ফেব্রুয়ারি ১৩, ১৯১৬-মে ৩, ২০০৫)
লেফটেন্যন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন প্রাক্তন সেনাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহা মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে ১৬ ডিসেম্বর তিনি মিত্রবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কীয় দলিল গ্রহণ করেন।
জগজিৎ সিং অরোরা ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পাকিস্তানে ঝিলমে সম্ভ্রান্ত শিখ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তারা বাবা পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং এক ছেলে ও কন্যা সন্তানের জনক।
জে. অরোরা ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী থেকে স্তাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২য় পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশনড পান। ১৯৬১ সালে চীনা সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করতে সীমান্ত এলাকায় সফলতার সাথে নেতৃত্ব দেন এবং ওই সময়েই তিনি বিগ্রেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান।
২১ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে লে. যে. আরোরা ভারতীয় পুর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের মিত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও মননীত হন। ভারত-বাংলাদেশের সরকার প্রধানের রাজনৈতিক সামরিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় তিনি প্রধান হন। বাংলাদেশ পরীক্ষা দলের প্রধান ছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবতীয় আলাপ- আলোচনায় দায়বদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দু’সপ্তাহ পূর্বে ভারতীয় সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হয় ও ঢাকা করায়ত্ত করেন। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হয় ও ঢাকা করায়ত্ত করেন। এর ফলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকবাহিনীর প্রধান লে. যে. এ. এ. কে. নিয়াজি ও তাঁর সৈন্যবাহিনীকে আত্নসমর্পণের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান ও আক্রমণ থাকা সত্ত্বেও আরোরা তাঁর বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে যেতে নির্দেশ দেন এবং যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে ঢাকাগামী হবার আদেশ দেন। ফলে, এক পর্যায়ে উনিয়াজী ও তাঁর দল্বল আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরে নিয়াজির কোন শর্ত ছিল না এবং ঢাকা দখল হয় যাওয়ার রসদভাণ্ডারও করায়ত্তত করতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ঘটনা পরম্পরায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও জড়িয়ে পড়ার গলে পাকিস্তান সামরিক জান্তা তাঁর পূর্ব পাকিস্তান অংশের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পাশাপাশি সামরিক আক্রমণে ভারতের মাসব্যাপি রণ পরিকল্পনা সফল হয়। আরোরা তাঁর নৈতিক সহায়তা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধ জয় করেন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন ঘটান।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ইতিহাস তথা বাংলাদেশির জন্য একটি চিরস্মরণীয় দিন। জে. আরোরা ভারত-বাংলাদেশের সমন্বয়ে গড়া সাক্ষরের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও শেষ হয় এবং বাংলাদেশ নামক একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটে।
আত্নসমর্পণের দলিলে উল্লেখ ছিল; ‘পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড বাংলাদেশ অবস্থানরত সকল সৈন্য মিত্রবাহিনীর প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং আরোরা’র কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে লে. জে. আরোরা’র কৃতিত্বপূর্ণ ও বীরত্বপূর্ণ ফয়ালফলের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতিক পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করেন। মিত্রবাহিনীর প্রধান হেসেবে লে. জে. নিয়াজী’র আত্নসমর্পণের দলিল গ্রহণ করেন। দলিলে যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে নব্বই হাজারেও বেশী পাকিস্তানিকে বন্দী করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। তন্মদ্ধে প্রায় ৪৬,৮০০ জন (সেনা-৩৫ হাজার, প্যারামিলিটারি-৫ হাজার, পুলিশ-৫হাজার, মিত্রবাহিনী ৮শ এবং নৌবাহিনি-১হাজার) ছিলেন সামরিক পোশাকধারী
সামরিক জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে জগজিৎ সিং আরোরা বেশ কয়েক বছর ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শিখ জনগোষ্ঠীর আকালী দলের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন তিনি।
৩ মে, ২০০৫ সালে ৮৯ বছর বয়সে ভারতের দিল্লীতে আরোরা’র মহাপ্রয়ান ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে জড়িয়ে পড়া চিরস্মরণীয় ব্যক্তিক্ত হিসেবে। ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সাধিনতায় অংশগ্রহন ও মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ ভূমিকায় তাঁর নেতৃত্ব ছিল অবসরনিয় ও অসাধারণ।
রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত