You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.16 | চিলমারি যুদ্ধ, কুড়িগ্রামঃ বর্ণনা-২ - সংগ্রামের নোটবুক

চিলমারি যুদ্ধ, কুড়িগ্রামঃ বর্ণনা-২
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

চিলমারী যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একটি বিপদসংকুল ও অসমসাহসিকতা সম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। অনেকে একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের নর্মান্ডি উপকূলে ঐতিহাসিক ডি-ডে অভিযানের সাথে তুলনা করে থাকেন। এই অভিযানের প্রস্তুতি চলে বেশ আগে থেকে কিন্তু মূল আক্রমণ পরিচালিত হয় ১৬ অক্টোবর শেষ রাতে। ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের এই ঐতিহাসিক অভিযানের নেতৃত্ব দান করেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন মানকারচর সাব-সেক্টরের কমান্ডার বিমান বাহিনীর অফিসার সেদিনকার ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহ খান (পরে স্কোয়াড্রান লিডার এবং কামালপুর যুদ্ধে তাহের গুরুত্বর আহত হবার পর কিছুদিনের জন্যে সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত)। তাহেরের নেতৃত্বে চিলমারী অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যোদ্ধারা। জীবন বাজি রেখে তারা নদী পাড়ি দিয়ে চিলমারীতে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত্রু সৈন্যদের কবল থেকে চিলমারী বন্দর সাময়িকভাবে মুক্ত করেন। চিলমারী অভিযানটিকে যুদ্ধের সামরিক পরিভাষায় পরিচিত করা হয় “চিলমারী রেইড” নামে। ১১ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ-সংবাদদাতা হিসেবে আমি আবু তাহেরের সাথে এই যুদ্ধের দিন (১৬ ডিসেম্বর শেষ রাতে) চালিয়াপাড়া নামে একটি চরে অবস্থান করি। চালিয়াপাড়া ছিল চিলমারী অভিযানের অস্থায়ী সদর দফতর। এ অভিযানের সামরিক কর্মকান্ডে আমার নিজের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। ছিল পারিপার্শ্বিক কিছু কাজ। মেজর তাহেরের সাথে ঘনিষ্ঠতর কারণে তিনি সেক্টর হেড কোয়ার্টারে থেকে আমাকে সাথে নেন। অবশ্য পরে তিনি অন্যত্র চলে যান। বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার ও মানকারচরের প্রথম সাব-সেক্টর কমান্ডার সফিকউল্লাহ চিলমারী অভিযানের পরিকল্পনা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি লেখেনঃ “চিলমারীতে শত্রু সৈন্যের ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধির ফলে তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র ও সোনাভারী মধ্য দিয়ে নৌ চলাচলে বাধা বৃদ্ধি পায়। মুক্ত রৌমারীর নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হয়। সেক্টর কমান্ডার তাহের চিলমারী আক্রমণের জন্য আমাকে একটি পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। আমি কোম্পানি কমান্ডার চাঁদ ও খাঁয়রুল আলমের সহযোগিতায় চিলমারীতে শত্রুসেনা অবস্থানের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে একটি অপারেশন প্ল্যান সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহেরকে প্রদান করি। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে এবং অত্যন্ত গোপনে ১৭ অক্টোবর ভোরবেলা চিলমারী আক্রমণের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন।“ নিচে লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের বীর উত্তমের লেখা ‘চিলমারী রেইডঃ যুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিস্ময়’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো। “বিশাল ব্রক্ষপুত্রের অপর তীরে অবস্থিত চিলমারীর দুর্ভেদ্য শত্রুব্যুহ এক প্রচণ্ড হানা দিয়ে আমরা শত্রুর বিপুল ক্ষতিসাধন করি। এই আক্রমণকে মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ ভেবে সে এলাকায় বৃহৎ আকারের শত্রু সমাবেশ ঘটে। এ ধরনের আক্রমণ শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়। খুব অল্পসংখ্যক শত্রুসৈন্যই অপেক্ষমাণ। গানবোটে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কোদালকাটি আমাদের হস্তগত হলো। গ্রামবাসীদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব এবং দক্ষতার উপর তাদের আস্থা বহুলাংশে বেড়ে যায়। যদিও তাদের সামর্থ ছিল সামান্য, তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তারা রান্না করা খাবার এবং মিষ্টান্ন নিয়ে আসেন।
সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি মেজর জিয়া তাঁর ব্রিগেড নিয়ে সিলেটের পথে ১১ নং সেক্টর ত্যাগ করে। সেদিং আমরা সবাই বিষণ্ণ বোধ করছিলাম। সে সময় আমরা জামালপুর এবং টাঙ্গাইল হতে ঢাকার পথে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুধু যে আমাদের রণনীতি পাল্টাতে হলো তা নয়, রৌমারীর বিরাট মুক্তাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব আমাকে বিচলিত করে তুললো। আমার সেক্টরে কোনো নিয়মিত বাহিনী রইল না। আমাকে রৌমারীতে ১৫ দিনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হলো। এদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ জন অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে ভারতীয় বাহিনী পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন ভারতীয় কমান্ডার। তাঁর সে প্রস্তাব আমি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করি। বাংলার মাটি রক্ষা করবে বাংলার বীর ছেলেরাই-রৌমারীর প্রতিরক্ষাব্যুহ আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নেতৃত্বের পুরো ভার পড়ল সুবেদার আফতাবের (আলতাপের) উপর। চওরা কাঁধ আর লম্বা কোকড়ানো চুলের অধিকারী এই নির্ভী জে.সি.ও সব সময়ই বীরত্ব দৃঢ়তার প্রতীক ছিল। আমি যখন পুরো পরিস্থিতি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো এবং বললো, স্যার পাকিস্তানীরা শুধুমাত্র সুবেদার আফতাবের (আলতাপের) মৃতধের উপর দিয়েই রৌমারীতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু জেনে রাখবে সুবেদার আফতাব (আলতাপ) মরবে না।’ এই বিপ্লবী নেতার মনোবল যে কত উপরে ছিল তা এই উক্তি থেকে বোঝা যায়।… ইতিমধ্যে পাকিস্তানীরা চিলমারী বন্দর থেকে গান বোটের সাহায্যে রৌমারীর মুক্ত অঞ্চলে প্রায়ই থাবা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু শত্রুরা কোনো সময়ই সদাজাগ্রত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। রৌমারির মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রে সজ্জিত করাটা আমাদের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো এবং আমি সব সময় চাইতাম তারা শত্রু অস্ত্রে সজ্জিত হোক এবং অস্ত্র দখলের জন্য আমরা চিলমারী বন্দরকে বেছে নিলাম। চিলমারী আক্রমণের পেছনে আরও কারণ ছিল। কুখ্যাত মুসলীম লীগ নেতা আবুল কাশেম এবং তাঁর সহযোগীদের নেতৃত্বে সেখানে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। চিলমারীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর আঘাত হানাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালো, তা যতই বিপদজ্জনক হোক না কেন। এভাবেই চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা রূপ পেলো।
ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত চিলমারী একটি নদীবন্দর। চিলমারীর কয়েক মাইল দক্ষিণে তিস্তা নদী ব্রম্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। নদীপথ ছাড়াও চিলমারী রেল ও সড়ক দ্বারা যুক্ত। চিলমারিতে পাকবাহিনীর জাতায়াতের জন্য রেল সড়ক এওং নদীপথ উন্মুক্ত ছিল। আমার অক্লান্ত গোয়েন্দা অফিসার অয়ারেন্ট অফিসার সফিউল্লা শত্রু সম্পর্কীয় খবরাখবর সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি শত্রুসৈন্যরা সঠিক অবস্থানসহ চিল্মারির বিস্তারিত এবং হবুহু মাটির নকশা তৈরি করে ফেললেন। চিল্মারিতে তখন পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য এবং দুই কোম্পানি মিলিশিয়া অবস্থান করছিল। তারা চিল্মারির ওয়াপদা ভবন, জোরগাছ, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন, বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন এবং পুলিশ স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে ব্রিজে মোতায়েন ছিল। তাদের সাথে ছিল কুখ্যাত ওয়ালী মাহমুদ অ পাচু মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বড় আকারের এক রাজাকার বাহিনী। শত্রুকে প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য আমাদের দরকার ছিল একই সময়ে বিভিন্ন শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ করা এবং স স অবস্থানে তাদের আটকে রাখা যাতে করে তারা একে অপরের সাহায্যে বিশেষ করে চিলমারীতে সাহায্যকারী শত্রুসেনা এগিয়ে আসতে না পারে। সেজন্ন একটি দল পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। ই অভিযানের সাফল্লের চাবিকাঠি নিহিত ছিল শত্রুর অজ্ঞাতে অতর্কিত আক্রমণের উপর। এক বিরাট বাহিনীর পক্ষে সকলের অগোচরে প্রায় ৩ মাইল প্রশস্ত ব্রম্মপুত্র পাড়ি দেয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এছাড়া মূল আক্রমঙ্কে সমর্থন দেয়ার জন্য যে চারটি দুরপাল্লার কামান আমাদের কাছে ছিল সেগুলো নিকতবর্তী এক চরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে ছিল।
শত্রু সম্পর্কে বিভিন্ন খবর সংগৃহিত হলো। প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন হলো। বিভিন্ন অবস্থানের শত্রুদের উপর একই আঘাত হানার জন্য বিভিন্ন সময়সূচি আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। এই অভিযান বিফল হয়ে যাওয়ার একটিমাত্র সম্ভাবনা ছিল, সেটি হচ্ছে যদি কোনো অতি উৎসাহী মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ মূহূর্তের পূর্বেই উত্তেজনাবশত কিছু করে বসে। …সড়ক এবঙ রেল যোগাযোগ বিচ্ছিনকারী দলটি প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ নিয়ে সন্ধ্যার পর রওনা হলো। গোপনে অ অতি সন্তপর্ন এই দলটিকে উলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে মূল আক্রমণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আত্নগোপন করে থাকতে হবে। ..মূল বাহিনী চিলমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকগুলো দেশী নৌকা তাদের বহর করে এগিয়ে চললো। এক্সতাহে এতগুলো দেশি নৌকার বাবস্থা করা অ তাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে গোপনে একই সময়ে শত্রু ঘাঁটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সে সময়ে বর কঠিন ব্যাপার ছিল। কমান্ডার আবুল ক্সেম চাঁদ, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এ ব্যাপারে এগিয়ে এল আর সমস্ত ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করলো। রাতের অন্ধকারে দূরপাল্লার কামানগুলো চালিয়াপাড়ায় স্থাপন করা হলো।
এই ভারি অস্ত্রগুলো নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা যে কি বিপদজ্জনক এবং কঠিন ছিল তা লিখে বুঝানো যাবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক অসম সাহসী সৈনিক নায়েক সুবেদার মান্না। তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল ওয়াপদা ভবন ধ্বংস করার দায়িত্ব। ওখানে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রমোদ বিলাসে মত্ত থাকতো। আমরা মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চার তাঁর দলকে দিতে পেরেছিলাম। কমান্ডার চাঁদের নেতৃত্ব বিভিন্ন দল গোরগাছা, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ ষ্টেশন এবং ব্রীজ অবস্থান আক্রমণের জন্য নির্দিষ্ট হলো। এদের অর্ধেকের সাথে ছিল ৩০৩ রাইফেল, কিছু পুরোনো স্টেনগান আর বাকিদের কাছে শুধুমাত্র গ্রেনেড। মূল বাহিনীর এই ছোট ছোট দলগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিল খালেদ, দুলু, সুলায়মান, নূর আহমেদ আলো আর নজরুল।….. আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়াপাড়ায় আমি আমার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম। চিলমারী দুই মাইল দক্ষিণে গাজীর চরকে আক্রমণকারী বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে ঘাঁটি হিসেবে নেয়া হলো। গভীর রাত। ১টার সময় খবর এল আমাদের সম্পূর্ণ বাহিনী আক্রমণস্থলে নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে এবং যার যার নির্দিষ্ট আক্রমণস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রাউন্ড সিট বিছিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত সাড়ে তিনটায় আমাকে জানানো হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাহিনী শত্রুসেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নানা ভাবনা সেই স্বল্প সময়টুকুতে আমার মনে ভীড় জমালো। হাতিয়ারের অভাব, অল্পবয়সী ছেলেরা-এরা কি পারবে এই বিরাট আক্রমণে সাফাল্য লাভ করতে? কি হবে ওখানকার জনসাধারণের, যখন আমরা চিলমারী ছেড়ে চলে আসবো? রাত চারটা, খুব কাছে থেকে রকেট লাঞ্চার দিয়ে ওয়াপদা ভবনের উপর আঘাত হানার সাথে সাথে সর্বত্মক আক্রমণ শুরু হলো। সমস্ত শত্রুঘাটিতে ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এল। দূরপাল্লার কামানগুলো শত্রুসেনাদের গানবোটগুলোর সম্ভাব্য অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করে চলেছে। কামানের গলা, গ্রেনেড মেশিনগান আর ছোট অস্ত্রের আওয়াজে রাতের নিস্তবদ্ধা ভেঙে যেতে লাগলো। সকাল ৬টার মধ্যেই গোরগাছা, রাজভিটা, পুলিশ ষ্টেশন ও ব্রীজের অবস্থানগুলো আমাদের আয়ত্তে আসলো, কিন্তু ওয়াপদা ভবনের আশেপাশের কংক্রীট বাঙ্কারে শত্রুসেনারা তাদের অবস্থান আঁকড়ে থাকলো এবং বলবাড়ি ষ্টেশনে কিছু শত্রুসেনার চলাচল আমাদের নজরে পড়লো। আমাদের একমাত্র নির্ভর রকেট- লাঞ্চার দু’টি শত্রু বাঙ্কারগুলি নির্মূল করতে পারে না বটে, তবে ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত প্রচুর শত্রুসেনা খতম করতে সক্ষম হলো। শুধুমাত্র এ দু’টি অস্ত্রের উপর নির্ভর করায় আমরা শত্রুর খতম করতে সক্ষম হলো। শুধুমাত্র এ দু’টি অস্ত্রের উপর নির্ভর করার আমরা শত্রুর এই অবস্থানটি দখল করতে সক্ষম হলাম না। যেহেতু সম্পূর্ণভাবে শত্রুকে ধ্বংস করা গেল না, তাই শত্রুকে তাদের ঘাঁটিতে আটক রাখার জন্য আমাদের দলটিকে তাদের অবস্থান আঁকড়ে থাকতে হলো। … সকাল ৮টা। আমার কাছে খবর এল চাঁদ আরও সাহায্য চাচ্ছে। মনে হলো অবস্থা সংকটজনক।
সে লক্ষ্য করেছে বলবাড়ি রেল স্টেশন থেকে শত্রুসেনারা নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার ছোট্ট স্পীডবোটটি নিয়ে নদী পার হয়ে চালিয়াপাড়া থেকে গাজীর চরে গিয়ে পৌছুলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম স্কোয়াড্রন লিডার হানিদুল্লাহ বন্দিদের কাছে থেকে খবর বের করার চেষ্টা করছেন। তাঁর বাবস্থাপনা মন্দ ছিল না। যাওয়ার সাথে সাথে এক মগ গরম চা পেলাম। আরও জানালাম চাদকে সাহায্য করার মতো কোনো বাড়তি দল রাখা হয়নি। তৎক্ষণাৎ আমি আমার ছোট্ট রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে থানা অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। ভাগ্যক্রমে আমাদের একটি এল.এম.জি ছিল। এই অস্ত্রটি সেদিন আমাদের ভীষণ উপকারে আসে। নান্দিক থেকে মাঝে-মদ্ধেই গোলাগুলি চলছিল। গ্রামবাসীরা যে জেদিকে পাছিল দৌড়াচ্ছিল । কেউ কেউ ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করলো। থানার এক মাইলের মধ্যে চলে এসেছি, এমন সময়ে একটি ফেলে যাওয়া গরুর গাড়ি রাস্তার মাঝখানে পেলাম। গাড়িতে শুয়ে ছিল একজন মেয়েলোক। একটি হাত ভাঙ্গা, বুকের স্তন নেই। পাকিস্তানী মর্টার শেলের শিকার। তাঁর বাচ্চা ছেলেটি মায়ের রক্তে মাখা, বসে বসে কাদছে। এই নিশপাপ শিশুটি তাঁর মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জানলাম মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল। থানার পাশেই হাস্পাতাল। আর ঐ দিক থেকেই গুলি আসছে। তাই তাঁকে ছেড়ে সবাই পালিয়েছে। আমি ঐ লোকটিকে গাড়ি চালিয়ে আমাদের সাথে আসতে বললাম। আমরা সাথে থাকায় সে সাহস ফিরে পেলো। হাসপাতালে যখন পৌছালাম গুলি বর্ষণ তখন আরও তীব্রতর হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি হাস্পাতালের দেয়ালে আঘাত হাঞ্ছে। ভাগ্যক্রমে হাসাপ্তালের ভেতর ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ডাক্তারকে পেলাম। ……. হাসপাতাল থেকে বের হয়েই দেখি চাঁদ দৌড়ে আসছে আমার দিকে। সে কাদছিল। আমাকে জানালো, তাঁর দলের ছেলেরা ৭৬টি দখল করা অস্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ ফেলে থানার অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। তাঁকে উৎসাহ দিয়ে আমারা এগিয়ে গেলাম পূর্ব অবস্থান পুনর্দখলের জন্য। মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি আমাদের উপর দিয়ে চলে গেলো। আমি দে৩খতে পাচ্ছিলাম পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ১০০ গজ দূরে রেললাইনের উপর অবস্থান নিয়েছে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আমরা এগিয়ে গেলাম এবং বাহিনীর এক পাশে আমার রক্ষাকারী বাহিনীর এল.এম.জি টি স্থাপন করলাম। এক নাগাড়ে গুলি করার পর কিছু পাকিস্তানী সেনা পরে গেলো। বাকিরা তাদের অবস্থান ছেড়ে রেললাইনের উপরে চলে গেল। তড়িৎগতিতে আমরা রেললাইন দখল করলাম। গুলি চালিয়ে আরও কিছু পলায়নপর পাকিস্তানী সৈন্য খতম করা হলো/ কিছুক্ষণ পরই বল্বাড়ি ষ্টেশনের অবস্থান থেকে শত্রুসৈন্যরা আমাদের উপর গুলি চালালো। আমারা পিছু হটে পুলিশ স্টেশনে অবস্থান নিলাম। সেখানে পাকিস্তানীদের তৈরি পরিখার অভাব ছিল না। দখল করা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ গাজিচরে পাঠানো হলো। একটি ঘরে আমি দশ বস্তা চাল অ দুই বস্তা গম পেলাম। চেয়েছিলাম এগুলো গ্রামবাসিরা নিয়ে যাক, কিন্তু নেয়ার মতো কেউ সেখানে ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি একজন বুড়ো লোককে পেলাম। আমি তাঁকে দরকার থাকলে কিছু চাল নিতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক থেকে লোকজন আসতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো তারা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে। হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ মেয়েলোক সবাই কাড়াকাড়ি করছে যা পাচ্ছে তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের বাসাগুলো খালি হয়ে গেল। সে দৃশ্য ভোলার নয়। রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে আমি কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে প্রধানদলটি নিয়ে গাজীচরে চলে এলাম। যদিও আমার ওয়াপদা ভবনের বাঙ্কারগুলো এবং বলবাড়ি রেলওয়ে ষ্টেশনের অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারিনি, তবুও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। আমরা জানতাম জানতাম আমাদের চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে। কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। পেছনে ব্রক্ষপুত্র নদীর বিরাট বাধা নিয়ে আমাদের পক্ষে দখল করে অবস্থান আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিল না। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যই ছিল শত্রুকে আকাস্মাৎ আঘাত হানা, যত বেশি সম্ভব শত্রুসেনা খতম করা, তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া, অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করা। আমরা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলাম।।… ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক এবং রেলপথের ব্রীজগুলো ভেঙে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকিস্তানীরা ব্যবহার করতে পারেনি। বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্ধি এবং প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে আমরা রৌমারী ফিরে এলাম। জনগণের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হলো। দেশপ্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনী সংগঠন এবং লুণ্ঠনের অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। বহু সংখ্যক বাঙালি রাজাকার এরপর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লাহ, নায়েক সুবেদার মান্নান, চাঁদ, দুলু, আলো, স্লেমান, নজরুল এবং আরও অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনোদিনই ভোলা যাবে না। এরাই বাংলার সোনার ছেলে।
হারুন হাবীব

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত