চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া প্রতিরোধ
মেজর এ আর আজম চৌধুরী। ২৬-০৩-৭১ আমি তখন চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ৪ নং উইং-এ একজন ক্যাপ্টেন হিসাবে কাজ করছি। ২৩ মার্চ আমাদের সীমান্ত পরিদর্শনের জন্য যাই। ফিরি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। মেজর ওসমান চৌধুরী ২৫ মার্চ কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন, ২৬ মার্চ বেলা ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গাতে আসেন।
যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ইপিআর মেজর চুয়াডাঙ্গা যান আমাদের সকল অফিসারকে আনবার জন্য কনফারেন্সের নাম করে ২৫ তারিখ সকাল ১০টার দিকে। রাত ফিরে শুনলাম যশোরের মেজর চুয়াডাঙ্গার অবাঙালি ক্যাপ্টেন মোঃ সাদেকের বাসায় আছেন। ২৬ মার্চ সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মেজরসহ ক্যাপ্টেন সাদেক ও তাঁর পরিবার আমার বাড়িতে আসে। আমি বাথরুমে ছিলাম। বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেজর বলল ‘এতনা জলদি আগিয়া’? আমি বললাম, হ্যা কাজ শেষ হয়ে গেছে।’ আমি মেজরকে দুপুরের খানা খেয়ে যেতে বললাম। অবাঙালি মেজর রাজী হল না। আমি সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে যাই এবং ইপিআর সুবেদার আমাকে বলল যে, পাঞ্জাবী মেজর এখানে সকল পাঞ্জাবী এবং পাঠানদের ডেকে পাঞ্জাবীতে কি যেন বলে গেছে। আমার তাতে সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। ২৬ মার্চ সকালে আমাদের অফিস অয়ারলেসের মাধ্যমে জানলাম ঢাকা পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে পাকআর্মি ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে চলেছে। খবর এল ৮/৯ টার দিকে।
সকাল ৯টার দিকে হাবিলদার মুজিবর রহমান আমাকে এসে বলে যে, আমরা বিদ্রোহ করব। আমি মুজিবরকে নিষেধ করি এবং বলি যে কোতের চাবি তুমি রেখে দাও, (কোতের চাবি আমি যখন সীমান্তে যাই তখন ওর কাছে দিয়ে গিয়েছিলাম) কোয়ার্টার গার্ডে যে পাঞ্জাবী আছে তাঁকে ছুটি দিয়ে দাও এবং সকল পাঠানদের ওপর নজর রাখ। শহীদ মুজিবর আমার আরও খবর দেয় অবাঙালিদের কার কার কাছে গুলি এবং অস্ত্র আছে। আমি বললাম আমার উর্ধতন অফিসার মেজর ওসমান যখন বাঙালি তখন তাঁর আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।
আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি যাই। ১১/১২টার দিকে মেজর ওসমান আসার সাথে সাথে আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলি এবং রাজকীয় মর্যাদা দিই। অবাঙালি যত ছিল তাদের অস্ত্রহীন করে এক ঘরে বন্দি করে রাখি। ২৬ মার্চ বেলা ১১ টার দিকে যশোর হেডকোয়ার্টার লেঃ কঃ মোঃ আসলাম (অবাঙালি) যাত্রা করে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে কিছু সৈন্য, দুটো গাড়ি এবং অয়ারলেসসহ। মেজর ওসমান আমাদের এক প্ল্যাটুন সৈন্য নিয়ে পজিশন নিতে বলেন। যশোর হেডকোয়ার্টার হয়ত খবর পেয়েছে যে, আমরা বিদ্রোহ করেছি। লেঃ কঃ আসলাম বারবাজার পর্যন্ত এসে এই সংবাদ শুনে ফিরে যায়। ইতিমধ্যে আমরা ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। ৭৬ বিএসএফ কমান্ডার লেঃ কঃ চক্রবর্তী এবং আইজি, ডিজি সবাই গেদেতে রয়েছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। আমাকে মেজর ওসমান বেলা চারটার দিকে গেদেতে যাবার জন্য বলেন। আমরা রওনা হয়ে গেলাম। আমরা ‘সাউথ-ওয়েস্ট কমান্ড’ হিসাবে পরিচয় দিয়ে কাজ করতে থাকি। বেলা পাঁচটার দিকে গেদে পৌঁছলাম। ভারতীয় অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমরা পুরো ইউনিফরম ও আর্মসসহ তিনজন গার্ড ছিল। আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ভারতীয় বিএসএফ ক্যাপ্টেন মহাপাত্র। ক্যামেরাম্যানরা আমার ছবি তুলবে বলে আমি গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে বর্ডার পার হই। আমি মেজর ওসমানকে পত্র দিই। সেখানে একটি আর্টিলারী ব্যাটারী, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক, এক ইনফ্যানটি সৈন্য যশোর আক্রমণের জন্য চাইলাম। ভারতীয় প্রধান বললেন আমরা সরাসরি সাহায্য করতে পারছি না, তবে গোপনে আপনাদের সাহায্য করব এবং আপনাদের এই চাহিদা দিল্লী নিয়ে যাচ্ছি আলোচনার জন্য। আমি দেখা হবে বলে চলে আসি। ২৮ শে মার্চ থেকে ট্রেন চালু হয়ে যায় ভারত সীমান্ত থেকে। ইতিমধ্যে ভারতীয় নাগরীকরা সাবান, পেট্রোল, খাবার, ওষুধপত্র ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস নিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করতে থাকে। ২৬ মার্চ রাতে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহি সাহেব এবং ঝিনাইদহের এসডিপি ও মাহবুবুউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় কুষ্টিয়া সম্পর্কে। কুষ্টিয়াতে ইতিমধ্যে পাকসৈন্য চলে এসেছিল। কীভাবে আক্রমণ করা হবে এ বিষয়ে আমরা মত বিনিময় করি। কুষ্টিয়াতে কত পাকিস্তানী সৈন্য আছে তা জানবার জন্যে ইপিআর ক্লার্ক বাড়ি এবং আরও দু’একজনকে পাঠাই। কুষ্টিয়াতে কত সৈন্য ছিল তার সঠিক সংখ্য পেলাম না। মেজর ওসমান আমাকে ২৯ তারিখে কুষ্টিয়া আক্রমণ করতে বললেন।
তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণের প্ল্যান হয়। একটি দল যায় ভেড়ামারা তারাগঞ্জ হয়ে এবং দ্বিতীয় দল ন্যে আমি নিজে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ হয়ে যাই। তৃতীয় দল যায় ঝিনাইদহ এবং কুষ্টিয়ার মাজেহ তারাগঞ্জ দিয়ে। সার্বিকভাবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম আমি। আমরা প্রাথমিক অবস্থায় ২০০ জনের মতো ছিলাম। পরাগপুর-ভেড়ামারার নেতৃত্ব দিচ্ছিল সুবেদার মজাফফর আহমদ।
২৯ তারিখে আক্রমণের কথা ছিল, কিন্তু নানা কারণে এই তারিখে সম্ভব না হওয়ায় ৩০ মার্চ ভোর পাঁচটার সময় আমরা এক সময়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ চালাই। সারাদিন আক্রমণ চালাই।
৩১ মার্চ কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। ২৫০ জন পাকসৈন্য মারা যায়, কিছু ধরা পড়ে। লেঃ আতাউল্লাহ তাদের মধ্যে একজন। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ২ জন মারা যায়, কিছু আহত হয়।
৩১ মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাকবাহিনীর বিমান এসে বোমাবর্ষণ করে প্রায় এক ঘন্টা ধরে, কেউ মারা যায়নি। ঐদিকে আমি টেলিফোন মারফৎ মেসেজ পেলাম আমাকে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমি ১ এপ্রিল যশোরের দিকে রওনা হই।
৩১ মার্চ সকাল ৯টার দিকে বিশালখালীতে যে দল আমাদের ছিল তাদের সাথে যশোর থেকে আগত পাকবাহিনী সংঘর্ষ বাঁধে। যশোর বাহিনী কুষ্টিয়ার দিকে যাচ্ছিল সাহায্যের জন্য। কিন্তু ব্রীজের ওখানে ব্যারিকেড থাকায় তারা যেতে পারেনি। ওখানে মুক্তিবাহিনী ২ জন মারা যায় এবং ৩/৪ জনকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। যশোর সেনানিবাস থেকে ৭ মাইল দূরে আমরা পজিশন নিই। মেজর ওসমানের নির্দেশক্রমে আমরা দূরেই ঘাঁটি গাড়ি। কেননা ভারত থেকে ভারী অস্ত্রের অপেক্ষা করছিলাম আমার হেডকোয়ার্টার ছিল ঝিনাইদহ। আমার একটি পেট্রোল ছিল মাগুরার এসডিওর সহযোগিতায় লেবুতলায়। সুবেদার আব্দুল মুকিদ ছিক কমান্ডিং অফিসার। ৫/৬ এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি সাটিং পার্টি লেবুতলার দিকে আসে রেকি করতে। আমাদের দল তৈরি ছিল, কারণ আগে থেকেই আমরা জানতাম যেহেতু যশোর-কুষ্টিয়া রোডে আমরা আছি তাই অন্য দিকে নিশ্চয় গ্যাপ খুঁজতে আসবে। এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ১৫/১৬ জন মারা যায়; একজন লেফটেন্যান্টসহ। আমরা বহু ম্যাপ, নোটবুক উদ্ধার করি। মর্টার ফায়ার করে পাকবাহিনী তাদের মৃতদেহ নিয়ে যায়।
ইতিপূর্বে ২৭/২৮ তারিখের দিকে লেঃ কঃ জলিলের (১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট) কাছে আমরা দু’বার মেসেজ পাঠাই আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তখন কর্নেল জলিল সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাসলিয়াতে ছিলেন।
৫নং খুলনা উইং-এ আমরা ২৭/২৮ তারিখেই খবর পাঠিয়েছিলাম বেনাপোলে জমায়েত হবার জন্য। নির্দেশ ছিল, ইতোমধ্যে যদি কোন অবাঙালি অফিসার তোমাদেরকে নিরস্ত্র করতে যায় তাহলে তাঁকে বন্দি অথবা হত্যা করবে।
ক্যাপ্টেন মোঃ সাদেক ২৭ মার্চ খুলনা বিওপিতে যায় নিরস্ত্র করবার জন্য। কিন্তু তাঁকে চ্যালেঞ্জ করলে ক্যাপ্টেন পিস্তল দিয়ে রক্ষীকে হত্যা করে। পরে বিওপি-র ভেতর থেকে গুলি করে ক্যাপ্টেনকে হত্যা করা হয়। ক্যাপ্টেন্নের সঙ্গীরা প্রাণ হারায়। সমগ্র যশোর ক্যান্টমেন্ট এলাকা আমাকে দেখতে হত, ফলে কোথাও ২/৪ ঘন্টার বেশি অবস্থান করতে পারতাম না।
১০ এপ্রিল ঝিকরগাছা যাই ৫ নং উইং দেখবার জন্যে। কিন্তু পাকবাহিনী তখন অগ্রসর হয়ে পথ বন্ধ করে ফেলে এবং সংঘর্ষ হয়। আমি ভারত সীমান্ত ঘুরে ১১ই এপ্রিল বেনাপোল আসি।
১১ তারিখে ৭২ ন্নং বিএসএফ-এর কর্নেল কেবি সিংহ, বিএসএফ আইজি, ৫নং গার্ডন এঁদের সাথে আলাপ আলোচনা করি এবং গতকালের যুদ্ধের ঘটনা বলি। আমি দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা আসি এবং মেজর ওস্মাঙ্কে যুদ্ধের কথা বলি। ঝিকরগাছা থেকে ওইদিনই ঝিনাইদহে রাত ১০টায় পৌঁছাই।
১২ এপ্রিল বারবাজার থেকে ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহর মেসেজ পেলাম যে, ওখানে ভীষণভাবে আর্টিলারী এবং ভারী অস্ত্রের আক্রমণে চালাচ্ছে পাকবাহিনী। সে আমার কাছে মতামত চাইল। আমি তাঁকে কালিগঞ্জ চরে আস্তে বলি এবং আমাদের বাহিনীকে কালিগঞ্জ এবং বারবাজারের মধ্যখানে থাকতে বলি। ওখানেও আমাদের বাহিনী বেশ কিছু অস্ত্র এবং সেনা হারিয়ে ফিরে আসে।
১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী কালিগঞ্জ দখল করে নেয়। ১৪ এপ্রিল আমরা মেহেরপুর ঘাঁটি সরিয়ে নিই।
১৬ এপ্রিল মেহেরপুর থাকলাম। ঐদিন রাতে ইছাখালি বিওপিতে থাকি। ১৭ এপ্রিল খুব ভোরে মুজিবনগরে বৈদ্যনাথতলা যাই মন্ত্রীপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। ইপিআর এর একটি কোম্পানি নিয়ে গিয়েছিলাম। বিচ্ছিন্ন ইপিআর বাহিনী সব বেতাইয়ে একত্র হয়। সমস্ত এপ্রিল মাসটা সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। মে মাস থেকে৪ কোম্পানি ভাগ করে দেওয়া হয়।
[১৫৬] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত