You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10 | চিথলিয়া যুদ্ধ, ফেনী - সংগ্রামের নোটবুক

চিথলিয়া যুদ্ধ, ফেনী

ফেনী জেলার অন্তর্গত পরশুরাম থানার ৩ নং ইউনিয়ন হচ্ছে চিথলিয়া। এই ইউনিয়িনের ওপর দিয়ে সিলেনিয়া নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে। সীমান্ত পরিবেষ্টিত পরশুরাম থানার একটি অন্যতম প্রধান ইউনিয়ন হচ্ছে চিথলিয়া। ফেনী পরশুরাম রোডের পশ্চিম পার্শ্বে এই ইউনিয়নের অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধে পরশুরাম থানার একটি দুর্ভেদ্য অঞ্চল হিসেবে চিথলিয়া পরিচিত ছিল। পাকিস্তানী বাহিনী পরশুরাম চিলুবাগান ও ঘুটুমা নামক স্থানে তাঁদের ক্যাম্প স্থাপন করে এবং উক্ত ক্যাম্পগুলো হতে তাঁদের আঞ্চলিক যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করে আসছিল। তাই পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পসমূহ দখল ও সেনাদের পরশুরাম থানা হতে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে অক্টোবর মাসের এক রাত্রে ক্যাম্প দুটি ঘেরাও করে। ১০ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি পরশুরাম থানা হতে পাকিস্তানী বাহিনীকে বিতাড়িত করার সার্বিক সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা তাদের পেছনে গোলন্দাজ বাহিনীর একটি ট্রলি ঐদিন ভোরে ফুলগাজী হতে রওয়ানা হয়।চিথলিয়া রেল স্টেশন পার হওয়ার সাথে সাথে স্টেশনের উত্তর দিক রেল লাইনের পূর্ব দিক ও ডিবি বোর্ডের পশ্চিম দিকের পুকুর হতে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। হাবিলদার এয়ার আহমেদ প্রথম ট্রলি লক্ষ্য করে ২ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার করে এবং সেই সাথে এলএমজি বাস্ট ফায়ারের মাধ্যমে ট্রলিটি ধ্বংস করে ও ১১ জন পাকিস্তানী হত্যা করে। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনী ফাঁদের আলামত লক্ষ্য করে ফায়ার করতে করতে চিথলিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে এবং গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে হাবিলদার এয়ার আহমেদ শাহাদাৎ বরণ করেন। তিনদিন পর মুক্তিবাহিনী অপর ৪টি জঙ্গিবিমান আক্রমণ করে। তবে বেশকয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎবরণ করলেও প্রতিরক্ষা অবস্থান হতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়িত করতে পারেনি। কয়েকদিন মুখোমুখি যুদ্ধ চলার পর মুক্তিযোদ্ধা ৯০ জন পাকসেনা ধরে ফেলে। ৫ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনীর একটি পার্টি চিথলিয়ার দক্ষিণে রেললাইনের ওপরে অ্যাম্বুশ পাতে। ৬ নভেম্বর সকাল সাতটায় পাকিস্তানীদের ট্রলি অ্যাম্বুশের আওতায় এলে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। এতে পাকিস্তানী সেনাদের এক অফিসারসহ চারজন সৈনিক নিহত হন। বেশকিছু অস্ত্র মুক্তিবাহিনী হস্তগত হয়। ১০ ইস্ট বেঙ্গলকে পাকিস্তানীদের আক্রমণ সমূলে ব্যর্থ করার পর বেলোনিয়া হতে তাদের সমূলে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে চিথলিয়া পরশুরাম-এর মাঝে পাকিস্তানী সেনাদের সরবরাহ লাইন সড়কটি বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নেয়। ৬ নভেম্বর ১০ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি চিথলিয়ার উত্তরাঞ্চলে দখল করে এবং সলিয়া ও ধনীকুন্ডার মাঝখানের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরশুরাম ও ফেনীর মধ্যে জগজগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে পাকিস্তানী সেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে যায় এবং তারা চিথলিয়ার পাকিস্তানিরা ২ কোম্পানি শক্তি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। গোলান্দাজ সহায়তার আড়ালে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানি অসীম সাহসীকতার সাথে পাকিস্তানী সেনাদের এই আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার উপরে পাক বিমান আক্রমণকালে গোলার আঘাতে একটি বিমানকে ভূপাতিত করা হয়। অক্লান্ত পরিশ্রম অসীম সাহস ও দুর্নিবার জয়ের নেশাই মুক্তিবাহিনীর জয়ের প্রধান কারন ছিল। উক্ত যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ রসদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয় এবং পাকিস্তানী বাহিনী চিরতরে পরশুরাম থানা হতে পিছু হতে যায়। চিরকুটটি লতিফ মির্জার হাতে পৌঁছার পরপরই তিন্দিক থেকে সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করে পাকবাহিনী। তখন সময় ভোর ৫টা/ প্রতিদিনের মতো মুক্তিযোদ্ধারা পি.টি প্যারেডে ব্যস্ত ছিল। পাকবাহিনী আগের রাতে সড়ক ও জলপথে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে যুবশিবিরের ক্যাম্পের অনতিদূরে রহিম্পুর, রকতকান্দি, নিমাই চড়ায় অবস্থান নেয়। পাকবাহিনী এগিয়ে আস্তে শরুর করলে প্রহরীরা প্রথমে বাদাহ দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারা পিছু হটে এবং এ সময়য় পার্শ্ববর্তী চিমনাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে সেন্ট্রিদের ৪/৫টি রাইফেল হারিয়ে যায়। তারা পাকাবাহিনির অগ্রসর হওয়ার খবর ক্যাম্প পৌঁছুলে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। শুরু হয় যুদ্ধও। উভয়পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো গুলি চলে। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ভারি অশ্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ব্যবহৃত হয় ২ ইঞ্চি মর্টার ২টি, ব্রিটিশ এল.এম.জি. ১টি ৩০৩ রাইফেল। চাইনিজ রাইফেল ও শতাধিক এস.এল.আর.। অস্ত্র ও গোলাবারুদ কম থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অসীম সাহস ও কৌশলগত কারণে দু’দিক থেকে পাকবাহিনীর নেয়া অবস্থানগুলো ঘেরাও করে ফেলেন। প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর পিছু হটতে শুরু করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাক বিমান বাহিনী তাদের সৈনিকদের সহযোগিতা প্রদানের জন্য শত্রুপক্ষের অবস্থানের ওপর বোমা ফেলার কথা ছিল; কিন্ত পাক বোমারু বিমানগুলো ঐদিন সকালে ভুল্ক্রমে নগা জেলা সদরে কয়েক দফা বোমা ফেলে। পাকাবাহিনির এই ভুল মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের পথ সুনিশ্চিত করে। এদিকে ঐ সময়য় বন্যা থাকায় পাকবাহিনী তাদের নেয়া ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মধ্যে দ্রুত ও প্রয়োজনীয় যোগাযোগে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে গুলি ফুরিয়ে জাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তারা ব্যাপকভাবে হতাহত হতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে দেখে তারা পার্শ্ববর্তী নিমাইচড়া গ্রামের পাশ দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে রাজাকারসহ দুই শতাদিক পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে ৭ জন। এঁদের মধ্যে সেলিম আহমেদ নামে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনও ছিল। ধৃত পাকসেনাদের কাছ থেকে ১টি এইচ.এম.জি., ২ ইঞ্চি মর্টার ২টি, চাইনিজ গান ১২টি, ৩০৩ রাইফেল ৩০টি ও সাবমেশিন কার্বাইন (এম.এম.সি) সহ বিভিন্ন ধরনের মোট ৬০টি অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত। নওগাঁ যুদ্ধের এই খবরটি তখন বি.বি.সি. ও ভয়েজ অব আমেরিকা থেকেও প্রচার করা হয়। খবরে লতিফ মির্জার নেতৃত্বে কথাও উল্লেখ করা হয়। ভোর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে গোলাগুলি চালায় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর লোকজন ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। যুদ্ধের দিন পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের পরিচালক আবদুল লতিফ মির্জা ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। এই অসুস্থতার মধ্যেই তিনি এই দীর্ঘ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের উল্লিখিত কর্মকর্তা ছাড়াও যুদ্ধে আরও যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে খোরশেদ আলম, আবদুস সামাদ, মোজাম্মেল হক, গোলাপ হোসেন, বিনয় কৃষ্ণ ও শামসুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গুরুত্বরভাবে আহত হন সহ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম, প্লাটুন কমান্ডার আবদুস সালাম, আবদুস শুকুর, কানসু মিয়া, জিল্লুর রহমান ও শামসুল ইসলাম।
নওগাঁয় এই যুদ্ধে রাজাকারসহ ৫ শতাধিক পাকসেনা অংশ নেয়। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের বিজয়োল্লাস। নওগাঁ অঞ্চলের পালিয়ে যাওয়া লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর পেয়ে বিকেল ৩ টার দিকে তারা আবার ফিরে আসে নিজ ঘরবাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিজোয়ল্লাসে যোগ দেয় কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ। পাকবাহিনীর ধৃত ৭ জন সেনাকে উপস্থিত করা হয় নওগাঁ বাজারে। ধৃত ক্যাপ্টেন সেলিম আহমেদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে লতিফ মির্জাকে দেখতে চান। তিনি বারবার উচ্চারণ করেন, ‘লতিফ মির্জা কোন হায়? মুক্তিকামী মানুষের যেন ঢল নামে সেখানে। সবাই দেখতে চায়, মারতে চায় সেই নরপশুদের। সেলিম আহমেদ উর্দুতে কয়েক দফা ক্ষমা চাইলেও শেষ পর্যন্ত হাজারো জনতার ইচ্ছা পূরণে পলাশডাঙ্গা যুবশিবির পরিচালক আবদুল লতিফ মির্জা একসঙ্গে সব বন্দি সেনাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন। যুদ্ধের পরদিন ক্ষুব্ধ পাকবাহিনী নওগাঁর পার্শ্ববর্তী ৪/৫টি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময়য় তারা প্রায় ৪০ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয় দফা প্রতিরোধের মুখে তারা পিছিয়ে যায়। বস্তুত এই যুদ্ধের পর থেকেই উল্লাপাড়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং তাড়াশ ও চাটমোহন থানার বিরাট এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। পরবর্তী বিচ্ছিন্নভাবে আরও কয়েকটি প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে এ অঞ্চলে। এর মধ্যে সলঙ্গা বাজারের যুদ্ধ অন্যতম। এখানেও পাকবাহিনী হেরে যায় মুক্তিবাহিনীর কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু গোলাবারুদও দখল করে নেন।
[৫৯৪] কল্যাণ ভৌমিক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত