চাপড়া অভিযান, সাতক্ষীরা
আশাশুনি থানার আড়পার মরিচ্চাপ নদী দক্ষিণ দিকে চাপড়া গ্রাম। উত্তর দিকে বেতনা নদী এবং পূর্ব দিকেও মরিচ্চাপ নদী। পশ্চিমে সাতক্ষীরা। আশাশুনির জেলা বোর্ডের মেইন রোড। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু থেকে চাপড়ায় ছিল স্বাধীনতার বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি। এখানকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বে দুই-একজন ছাড়া গ্রামের লোকজন সবাই শরণার্থীদের সর্বস্ব লুটপাট করে এবং রাজাকার বাহিনীর সাথে পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা করে। তাই চাপড়া গ্রামটা ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের বড় আস্তানা। এই গ্রামের প্রতি বাড়ি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে রাজাকার বাহিনীতে একজন না একজন যোগ দেয়। সাতক্ষীরা মহকুমা সদর থেকে তারা নিয়মিত অস্ত্রশস্ত্র আনুষাঙ্গিক সাহায্য সহযোগিতা লাভ করত এবং যে কোন বিপদে সাতক্ষীরা শহর থেকে পূর্ণ সাহায্য পেত। আর দক্ষিণ পাড়া তো থানা পুলিশ ছিলই। সবচেয়ে রাজাকারদের অসুবিধা ছিল চাপড়া গ্রামের পূর্বদিকে মরিচ্চাপ নদীর অপর পাড়ে কেয়ারগতি গ্রামে মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। প্রায় রাতেই উভয় পক্ষ গোলাগুলি করত এবং মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাতারু দল মরিচ্চাপ নদী সাতরিয়ে পার হয়ে রাজাকারদের ক্যাম্প বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করত। বহু পরিকল্পপনা ও চেষ্টা করা সত্ত্বেও রাজাকাররা কোনদিন মুক্তিবাহিনীর গ্রেনেড অভিযান বন্ধ করতে পারেনি। চাপড়ার রাজাকার বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর বহু খণ্ড যুদ্ধ হয়। তবে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল ১৩৭৮ সালের ১৬ই কার্তিক, শনিবারের যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে পরিকল্পনা তৈরি কালে দেখা গেল সবচেয়ে মস্ত বড় অসুবিধা হলো রাজাকাররা রাতের বেলায় একটা ভবনে বা এক বাড়িতে থাকে না। পুরো গ্রামে ৫ জন ৭ জন করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মূল পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের মোট ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। গাজি রফিকুল ইসলাম এক দল নিয়ে চাপড়া গ্রামের পশ্চিমে জেলা বোর্ডের পাকা রাস্তার উপর একটা কালভার্ট উড়িয়ে দেবে ও পশ্চিম দিকে থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবে এবং সাতক্ষীরা শহর থেকে যদি মিলিটারি আসে তাঁদের প্রতিহত ও ধ্বংস করবে। বাস্তবিকপক্ষে রফিকের দায়িত্ব ছিল কঠিন ও সবচেয়ে বিপদজনক। দ্বিতীয় দল সাঁতার কেটে মরিচ্চাপ নদী পার হয়ে রাজাকারদের বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চের মধ্যে গ্রেনেড ফেলবে। এই দলের নেতৃত্ব দেবেন আলম সাহেব। তৃতীয় দলের নেতৃত্ব থাকবেন খিজির আলী, তার দল চাপড়া গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে উভয় দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। চতুর্থ দলে রহমতুল্লাহ দাদু ও অণ্যান্যরা বেতনা নদী পার হয়ে উত্তর দিক থেকে চাপড়ায় আক্রমণ চালাবে এবং এক পর্যায়ে খিজির আলীর দলের সাথে মিশে যাবে। চাপড়া গ্রাম আক্রমণের প্ল্যানটা সবারই মনঃপুত হল।ঠিক হল রফিক সাহেব সবার আগে চলে যাবে, যেহেতু তার পথের দূরত্ব সবচেয়ে বেশি, তারপর অন্যান্য দল সুবিধা মত যার যার স্থান পৌঁছবে। গাজী রফিক কালভার্টে স্লাব ও বিস্ফোরক লাগিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেবে এবং এই সংকেত পাওয়ার পরই সবাই যুদ্ধ শুরু করবে। সবাই রাতে হাল্কা খাবার খেয়ে যে যার দলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি দিয়ে পরস্পর থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হল। প্রতিদিন একটা ‘কোড ওয়ার্ড’ বা সাংকেতিক শব্দ থাকত। ঐদিনের সাংকেতিক শব্দ ছিল ‘ফুল’। সবাই গভীর আগ্রহে জেলা বোর্ডের রাস্তা অর্থাৎ আশাশুনি-সাতক্ষীরা রাস্তার দিকে চেয়ে আছে কোন সময়য় রফিক আগুন জ্বালিয়ে যুদ্ধের সবুজ সঙ্কেত দেবে, একসময় প্রতিরক্ষার অবসান ঘটিয়ে দূরে আগুনের শিখাঁ দেখে গুলি ছুঁড়ে চাপড়া যুদ্ধের শুভ উদ্ভোধন করা হল। আমরা আলম সাহেবের দলের গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। রফিক ও তার দল আশাশুনি সাতক্ষীরা পাকা রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। খিজির আলী ও তার দল দক্ষিণ দিক থেকে যুদ্ধ করতে করতে উভয় দিকে আসছে এবং দাদু গুলি করতে করতে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। এ আক্রমণে রাজাকাররা ভীত সস্ত্রস্ত হয়ে তাঁদের আস্তানা ছেড়ে দিয়ে নিকটস্থ খালে-বিলে ও ধান ক্ষেতে আশ্রয় নে অর্থাৎ যে সব বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় ছিল তারা সেসব স্থান ত্যাগ করে গেছে।
রাজাকারদের আস্তানা ও শান্তি কমিটির নেতাদের বাড়িঘর একের পর পুড়িয়ে দেয়া হয়। আগুনের লেলিহান শিখা তখন অনেক দূর থেকে সবাই দেখতে পাচ্ছে। চাপড়া গ্রাম একরকম তছনছ করে দেয়া হল কিন্তু রাজাকারদের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। সারারাত ধরে চাপড়া গ্রাম তল্লাশী করা হল কিন্তু সব পরিশ্রম পন্ড হল। তবে রাজাকারদের আস্তানা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আশ্রয়দানকারীদের হুশিয়ার করে দিলাম যদি তারা পুনরায় রাজাকারদের আশ্রয় দেয় তবে এর চেয়েও ভয়াবহ অভিযান চালান হবে। ভোর হলে একে একে নদী পার হয়ে কেয়ারগতি ফিরে আসার জন্য সবাইকে ক্লোজ করার নির্দেশ দেয়া হল। মাদিয়া স্কুলে মিলিত হয়ে চিড়ামুড়ি ও গুড় দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই বিশ্রাম করতে গেল। চাপড়ার রাজাকারদের উৎখাত করা একান্ত দরকার। তা না হলে ওরাই পুনঃ সাতক্ষীরা থেকে মিলিটারী এনে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালাব। কারণ আজ হয়ত ওরা একত্রে থাকবে। যেহেতু গত রাতে একবার আক্রমণ হয়েছে, আবার আজ রাতে আক্রমণ হতে পারে এমন ধারণা তারা করবে না।
আলম সাহেবের ন্যাভাল গ্রুপ ঠিকই তাঁদের বাঙ্কারে গ্রেনেড চার্জ করল, ব্যাপক গোলাগুলির মাধ্যমে চাপড়া রাজাকারদের আস্তনায় আবার হানা দেয়া হল। ওদের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলি আসছে-তবে নির্ভুল গ্রেনেড চার্জের ফলে কয়েকজন মারা যায়; কয়েকজন আহত হয়। গ্রাম তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করে ৪/৫ জন রাজাকারকে সেদিন অস্ত্রসহ ধরা হয়। শান্তি কমিটির হোতাদের ধরার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চলে। কিন্তু তারা যেন সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বাড়ির মেয়েলোক ও বাচ্চাদের কাছে শত জিজ্ঞাসাবাদ করেন কোন ফল হল না। তারা কেবল কেঁদে কেটে তাঁদের জীবন রক্ষার জন্য হাত-পা ধরাধরি করতে থাকে। আমাদের আক্রমণে চাপড়ার রাজাকার শিবিরগুলো বার বার বিধ্বস্ত ও ক্ষতবিক্ষত হলেও তাদেরকে পুরোপুরি নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়।
চাপড়া গ্রামের দ্বিতীয় দিনের অভিযানও আশানুরূপ সফল হয়নি, তবে এই আক্রমণের ফলে বহু রাজাকার সাতক্ষীরায় গিয়ে অস্ত্র ফের দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। অনেকে তাঁদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়- স্বজনের পরামর্শ ও চাপে রাজাকারগিরি ছেড়ে দেয়।
সারারাত ব্যস্ত সময়য় অতিবাহিত হয়। ওদের খোঁজ করা বৃথা জেনে আমরা সকলকে প্রত্যাহারের এবং ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়।
বেলা উঠে গেছে অথচ রফিক ও তার দল তখন ফেরেনি। রফিকরা রাস্তা দিয়ে প্রত্যার্তন কালে ধানবনের ভিতর থেকে আসতে থাকলে রাজাকাররা রফিক ও তার দলকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং রফিক ও তার বাহিনীর ওয়াপদা রাস্তার আড়ালে থেকে রাজাকারদের উদ্দেশ্যে ব্যাপক গোলাগুলিবর্ষণ করে। তারপর এক সময় নৌকায় পার হয়ে চলে আসে।
চাপড়া যুদ্ধে অন্যান্যদের মধ্যে যারা অংশ্রগ্রহন করেন তারা হল-রেজাউল করিম, মতিউর রহমান মতিভাই, আরশাদ, মোকতার আলী, আজিজ সানা, আবদুল মান্নান, আনম মনিরুজ্জামান, রজত আলী, সাঈদ, আবদুস সাত্তার, আবদুল কুদ্দুস, মশু, মুজিবুর, আকতারশ আরো অনেকে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত