চাপিতলার যুদ্ধ, কোম্পানিগঞ্জ
কুমিল্লা-ব্রাক্ষণবাড়িয়া সড়ক থেকে ১৮ মাইল দূরে কোম্পানিগঞ্জ। কোম্পানিগঞ্জ থেকে কাঁচা রাস্তায় প্রায় ১৩ মাইল দূরে নবীনগর। কোম্পানিগঞ্জ থেকে নবীনগর যেতে মাইল তিনেক পরে রাজা চাপিতলা গ্রাম। নবীনগর যেতে নৌপথ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। নবীনগর তাই তখনো ছিল শত্রুমুক্ত। পরবর্তীতে নবীনগর দখলের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানীরা কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়কটি পাকা করার পরিকল্পনা নিয়ে ইট বিছাচ্ছিল। সড়কটি পাকা করার কাজ বন্ধ করতে ক্যাপ্টেন হায়দারের পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হাসান ভূঁইয়া এক কোম্পানির অধিক জনবল নিয়ে চাপিতলায় আরশী নদীর উত্তর পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ১৩ এপ্রিল বিকেলে তেলিয়াপাড়া হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা দল ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় পৌঁছায়। মেজর সফিউল্লাহ তাদেরকে তখনি ভৈরববাজারে ক্যাপ্টেন মতিউরের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পাঠিয়ে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রার শুরুতেই প্রচণ্ড বিমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এর ফলে ব্রাক্ষণবাড়িয়া রেলস্টেশনে ২ ইস্ট বেঙ্গলের সিপাহি মহসিন এবং একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। ১৪ এপ্রিল সকালে নৌযানের একটি বহর লালপুরের কাছে মেঘনা নদীতে আসে। নৌযান বহরটি অবতরণের স্থান নির্নয় করার জন্য এসেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা বিন্যাস সম্পর্কে ওরা নিশ্চিত নান হওয়ার কারণে অবতরন পরিকল্পনা তখনো সম্পন্ন করতে পারেনি। শত্রুরা আকস্মিকভাবে লাল্পুর থেকে গোলাবর্ষণে আক্রান্ত হয়। প্রায় এক ঘন্টা ধরে গুলি বিনিময় হয়। শত্রুরা শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে ভাটির স্রোতে চলে যায়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লাল্পুরে আক্রমণের সম্ভাবনায় সরাইলে অবস্থিত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে সেখানে অবস্থান নেওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ দেন। রাতের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মতিন সেখানে পৌঁছে। কিন্ত রাতেরবেলা সৈন্যদের লালপুরে বিন্যাস্ত করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তার রিকয়েললেস রাইফেল (আর আর) আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের কাছে পরিবহন অসুবিধার কারপ্নে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির ডানদিকে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানি অবস্থান করছিল। শত্রুপক্ষের আসন্ন অবতরণের খবর পেয়ে মেজর সফিউল্লাহ রাত ২টায় মোউলঈবাজার ছেড়ে ১৫ এপ্রিল ভোরবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। ১৫ এপ্রিল ভোর সারে পাঁচটা আশুগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের অপর শত্রুদের গোলাবর্ষণ শুরু হয়। একই অবস্থা চলে লালপুর ও ভৈরবে। অনুমতি হয় খাসাবাড়ি রেলস্টেশনের কাছাকাছি এলাকা থেকে কামানের গোলা নিক্ষপ্ত হচ্ছে। লালপুরের সামনে আবারও শত্রুর নৌযানের বহর উপস্থিত হয়। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা মাথা উঁচু করে দারাতে পারছিল না। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানী সৈন্যরা সতর্কতার সাথে মেঘ্নার অপর দিয়ে এগিয়ে আসছিল। গোলান্দাজ গলাবর্ষনের ছত্রছায়ায় অবতরনের জন্য লালপুরের দিকে এগিয়ে চলছিল। নৌবহরের মধ্যে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং দুটি ল্যান্ডিং ক্রাফাট ট্যাংক এবং চারটি লঞ্চ ছিল। এ সময় ভৈরব বাজার রেললাইন দিয়ে আরেকটি শত্রু ব্যাটালিয়ন অগ্রসর হয়। নদীর অপর পারে যুদ্ধের অপর প্রভাব বিস্তার করার মতো কোনো উপায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল না। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমাঙ্কে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল শত্রুকে প্রতিহত করে তাঁদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার জন্য এবং শেষ পর্যায়ে দেয়া হয়েছিল শত্রুকে প্রতিহত করে তাঁদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার জন্য এবং শেষ পর্যায়ে সেতুর অপর দিয়ে এবং নৌকার সাহায্যে আশুগঞ্জে চলে যাবার জন্যও পরামর্শ দেয়া হয়। যুদ্ধও ভয়ংকর আকার ধারন করে। নৌবহর আরো এগিয়ে আসে এবং আক্রমণের লক্ষ্য বস্ততে পরিণত হয়। লাল্পুরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মতিন বিগত রাতে তার ১০৬ মিলিমিটার আর আর আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির কাছে ফেলে এসেছিল। যাহোক একটি ৭৫ মিলিমিটার আর আর গোকর্ণাট থেকে নিয়ে এসে অবতরণকারী ট্যাংকের অপর ৫টি গোলা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্ত এতে শত্রুর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। নৌবহরটি অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করছিল তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংক থেকে একযোগে গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের রকেট লাঞ্চার এবং মর্টারের ভারী গোলাবর্ষণ শত্রুদের প্রচণ্ড আঘাত করে। পাকিস্তানী বাহিনী হতভম্ব হয়ে তীর থেকে অন্ত্র চলে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণ অব্যাহত থাকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ছয়টি স্যাবর এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান ভৈরব, লালপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। বিমান আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বিশৃঙ্খলা অবস্থায় পড়ে। একনাগাড়ে ৬ ঘন্টা বিমান আক্রমণ চলে। একই সাথে এক ঝাঁক এম আই-৮ হেলিকপ্টার বিমান আক্রমণের ছত্রছায়ায় আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মদ্ধবর্তী সোহাগপুরে ছত্রীসেনা অবতরন করাতে থাকে। ছত্রীসেনা অবতরনে বাধা দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিম দ্রুতবেগ তার কোম্পানিকে পুনরায় একত্র করে বিমান সত্ত্বেও শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে। এমই পোস্টের কমান্ডার লান্স নায়েক আবদুল হাই রেলপথে স্থাপিত উন্মুক্ত পরিখা থেকে শত্রুদের ওপরে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্ত প্রতিপক্ষ থেকে সরাসরি নিক্ষিপ্ত গোলায় আবদুল হাই শহীদ হয়। শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানসমূহ ঘিরে ফেলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অজ্ঞাতেই তাঁদের কাছাকাছি এসে পড়ে। পায় একঘন্টা ধরে হাতাহাতি যুদ্ধও হয়। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। এ সময়ে এক ঝাঁক এমইই-৮ হেলিকপ্টার আশুগঞ্জ এবং আজবপুরের মাঝামাঝি শত্রুর একটি কোম্পানি ,উক্তিজদ্ধাদের পেছনে অবতরন করে। ক্যাপ্টেন নাসিম এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদ যুদ্ধও চলাকালে আহত হলে যুদ্ধক্ষেত্র বিরুপ প্রতিক্রিয়া ঘটে। হেলিকপ্টার সাফল্যের সাথে অবতরন করছে দেখে মেজর সফিউল্লাহ সৈন্যদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন নাসিম সরাইলের দিকে পিছু হটে যায়। শত্রুদের নৌবহর তিতাসের মুখে তাঁদের সৈন্যদের নামিয়ে দেয় এবং বাম দিকের রক্ষাব্যূহ ভেঙে ফেলে। ক্যাপ্টেন মতিন লালপুরে নাজুক অবস্থায় পড়ে। অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সন্ধ্যার দিকে রেলপথে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে। পরে ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলে গিয়ে দেখে মুক্তিবাহিনীর কোনো সদস্য নেই। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণে ক্যাপ্টেন মতিউরের পক্ষেও ভৈরব ধরে রাখা সম্ভবপর ছিল না। উপরন্ত মেঘনা সেতু ও নদী পারাপারের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। তাই তিনি তার অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উত্তর দিকে রেলপথ ধরে কুলিয়ার চরে গমন করেন। আশুগঞ্জে সংঘটিত লড়াই ছিল ইস্ট বেঙ্গলের জন্য প্রথম প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ। প্রথম প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধে পাকিস্তানীদের স্থল, জল ও বিমান হামলার মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ লড়াই টিকতে না পেরে কোউশল্গত কারণে পশ্চাৎপসরন করে এবং তেলিয়াপাড়া সিমান্তবর্তী অঞ্চলে চলে আসে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, লান্স নায়ক আবদুল হাই, সিপাহী কফিল উদ্দিন এবং সিপাহী আব্দুর রহমান সরকারসহ আরও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকাবাহিনি আশুগঞ্জ বাজার দখল করার সময়ও অসংখ্য নিরস্ত্র নিরীহ লোক হত্যা করে। বিমান হামলায়ও মৃত্যুবরণ করেন আরও অনেক লোক। ১৫ এপ্রিল হতে আশুগঞ্জ মুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত পাকবাহিনী আশুগঞ্জে অবস্থান করে। আশুগঞ্জ বন্দরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত ওয়াপদা রেস্ট-হাউজ এবং পশ্চিম-দক্ষিণাংশে অবস্থিত সাইলো গোডাউনে তারা শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। পাকিস্তানী বাহিনীর ১৪ ডিভিশনের অস্থায়ী সদর দপতর আশুগঞ্জে স্থাপিত হয়। পাকহানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে প্রায়ই আক্রমণ চালাতো। গ্রামের নিরীহ, নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন চালাতো। ধৃত বন্দীদের ওপর চালাতো অবর্ণীয়, আমানুষিক অত্যাচার। তারা ভবানীপুর গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ২৪ জনকে এবং বিটঘর গ্রামে ১৬০ জনকে হত্যা করে। আশুগঞ্জে পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ করার মতো শক্তি পার্শ্ববর্তী গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তখনো অর্জন করেনি সত্য, তবে পাকিস্তানী বাহিনীর জন্যও পার্শ্ববর্তী এলাকগুলো মোটেও নিরাপদ ছিল না।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত