You dont have javascript enabled! Please enable it!

চাঁদপুর নদীবন্দর অভিযান

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চাঁদপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কোনো ঘাঁটি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আগস্ট মাসে সাব মেরিনার বদিউল আলম বীর উত্তম এর নেতৃর্বে বাংলার ভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আত্নঘাতী নৌকমান্ডোদের অপর দল চাঁদপুর নদী বন্দর অভিযান পরিচালনা করেন। আগস্টের ৩ তারিখ, চাঁদপুর বন্দরের উদ্দেশ্যে দলনেতা এবং আরও ২০জন কমান্ডোর দল সামরিক ট্রাকে প্রথম ব্যারাকপুর এবং সেখান থেকে পরের দিন দিমান যোগে আগরতলা চলে আসে। এখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর অপারেশনের উদ্দেশ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কমান্ডো দল চাদপুরের উদ্দেশ্যে অগ্রযাত্রা শুরু করে। কমান্ডো দল্কে সীমান্তে পৌছে দিতে আসেন লে সমীর কুমার দাস। ৯ তারিখ সন্ধ্যার পূর্বেই দলটি সীমান্তবর্তী এলাকায় পৌঁছে রাতের আহার সম্পন্ন হলে লেঃ দাস-বিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং এর সাথে সকল কমাণ্ডোকে পরিচয় করিয়ে দেন। অতপর প্রত্যেক কমান্ডোকে তাঁর যুদ্ধ সনরঞ্জাম সহ ২টি এক ব্যান্ড রেডিও সাথে নিলেন। দলের সাথে নিরাপত্তা ঐ পথ দেখিয়ে চলার জন্নপ গাইড দেওয়া হয়। দল্টি আগরতলা থেকে সনামুড়ি ও মেলাঘর হয়ে বক্সনগর দিয়ে বাংলাদেশ ভুখণ্ডে প্রবেশ করে। গ্রামবাসীরা সহায়তায় তারা ময়নামতি পর্যন্ত এসে পৌঁছে। ময়নামতি সেনানিবাসের সন্নিকটে সে এন্ড বি সড়ক অতিক্রম করা তাদের জন্য খুবই ঝুকিপূর্ণ হয়ে পরে। সেনানিবাসের কাছাকাছি স্থান বিধায় ঘন ঘন সামরিক যানবাহনগুলি তীব্র আলো জ্বালিয়ে যাতায়াত করছিল। এক সইময় তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক অতিক্রম করে সামনে চলতে থাকে। তখন দেশের সর্বত্র স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচরন, সারা রাত পায়ে হেঁটে দলটি ভোরে বাঘমারা গ্রামের এক ধনীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সারাদিন আত্নগোপনে থেকে সন্ধ্যায় তারা পুনঃ যাত্রা শুরু করে। কখনো নৌকায় কখনো পায়ে হেঁটে চারদিন পর তারা মতলব থানার বাজার এলাকায় পৌঁছে স্থানীয় বাচ্চু মিয়ার সহযোগিতায় দু’টি নৌকা ভাড়া করে ১২ আগস্ট কমান্ডো দলটি রঘুনাথপুর গ্রামে পৌঁছে। সেখানকার থানা ভিলা নামক এক বাড়িতে, চাঁদপুর শহরের করেগো দোকানের কাছে এক বাড়িতে, দক্ষিণ বালিয়া গ্রামে আঘন হাটের সন্নিকট সামছুর রহমান (ছিটু শেখ) এর বাড়ি এখলাস্পুর গ্রামে নসু মিয়ার বাড়ি (ঢালি বাড়ি) ও করিম খানের আশ্রয় গ্রহণ করে। এই দলের প্রায় সকলেই স্থানীয় যুবক। এই দিনে দলের দু’জন সদস্য শাহজাহান কবির বীর প্রতীক ও মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বীর প্রতীক গ্রামের আরও দু’জন সাহসী যুবককে সাথে নিয়ে বন্দর এলাকা রেকি করে বন্দরে জাহাজ এবং শত্রু সৈন্যরা অবস্থান পর্যবেক্ষন করে দলনেতাকে অবহিত করেন। ১৪ আগস্ট অপারেশন পরিকল্পনা থাকলেও রেডিও মাধ্যমে নির্ধারিত সংগীত না বাজানোর জন্য অন্যান্য বন্দরের নায় চাঁদপুরেও এদিন অভিযান স্থগিত রাখা হয়। পরদিন ১৫ আগস্ট সকাল ৭-৩০ মিনিটে নির্বাচিত গান “আমার পুতুল আজকে যাবে শশুর বাড়ি” বেজে উঠে। সাথে সাথে দলনেতা সকল কমান্ডোকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। সবাই প্রস্তুত। তথ্যানুসারে দলনেতা উপ-দলনেতাদের সাথে পরামর্শ করে ফেরী, বার্জ, পল্টোনে, জাহাজ মিলিয়ে ৬টি টার্গেট ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই লক্ষে দলনেতা ১৮ জন কমান্ডোকে ৬টি দলে ভাগ করে প্রতিটি টার্গেটের জন্য ৩জন কমান্ডোকে নির্দিষ্ট করে দেন। বদিউল আলম বীর উত্তম নিজেও অভিযানে সামিল হন। দু’জন কমান্ডো শফিকুর রহমান ও এস এ মজুমদার অপারেশনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁদেরকে বন্দরের দূরবর্তী নিরাপদ স্থানে নৌকা নিয়ে যুদ্ধ শেষে কমান্ডোদের উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। দলনেতা সহ প্রত্যেক একটি মাইন বুকে বেঁধে মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে মেঘনা ও ডাকাতিয়া মোহনায় অথৈ জলরাশির মাঝে নেমে পড়েন। চারদিকে নিঝুম অন্ধকার। কোথাও জনমানুষের রব নেই। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গ্রামের কুকুরগুলিও যেন দানবের ভয়ে নীরব। এর মাঝে কমান্ডোরা এগিয়ে চলেন অদম্য যুদ্ধ জয়ের নেশায়। নদীতে প্রবল ঢেউ এবং স্রোত, কিন্ত অজেয় মুক্তি সেনারা সকল ভয় ভীতি উপেক্ষা করে অভিষ্ট লক্ষের দিকে সাত্রিয়ে চলে যায়। টার্গেট হিসেবে নির্ধারিত ৬টি জাহাজ অবস্থান করছিল লন্ডন ঘাট, কালীবাড়ি ঘাট, আই, ডব্লিউ, টি, এ জেটি, পুরান বাজারের মোড় এবং বড় ষ্টেশনের উত্তরে অবস্থানরত একটি অয়েল ট্যাঙ্ক। বন্দরের গোটা এলাকা আলোয় ঝলমল করছে। প্রতিমূহুর্তে জাহাজ থেকে অনুসন্ধানী আলো ঘুরে যাচ্ছে চারিদিকে। এমন বিপদজনক পরিবেশের মাঝেও কমান্ডোরা নিঃশব্দে পৌঁছে যান প্রত্যেকের নির্দিষ্ট টার্গেটের পাশে। কোমর থেকে ড্যাগার খুলে একই সাথে ডুব দেয় তিন জন কমান্ডো। ৬ফুত পানির নিচে জাহাজের গায়ে বহুদিন জমে থাকা শেওলা চেছে পরিষ্কার করে নেয় মাইন স্থাপনের জন্য। আবার ভেসে উঠে পানির উপর। কমান্ডোকে একই স্থানে অবস্তাহ্নের জন্য সাঁতরাতে হয় স্রোতের প্রতিকূলে। এবার নুকে বাধা মাইন খুলে হাত নিয়ে ডুব দিয়ে পৌঁছে যায় পূর্বের স্থানে। যেখানে পুর্বে ড্যাগার দিয়ে জাহাজের গা পরিষ্কার করে নিয়েছে। জাহাজের গায়ে হাত ঘষে স্থান খুঁজে স্থাপন করে হাতের মাইনটি। মাইনের সাথে রাবারের ক্যাব খুলে পানি প্রবেশের সুযোগ দেয় বিস্ফোরণে জন্য। ৪৫ মিনিট পর জাহাজের স্থাপিত মাইনটি বিস্ফোরিত হবে। এ সময়ের মাঝে কমান্ডোদের পৌঁছাতে হবে নিরাপদ দূরত্বে। মাইনের বিস্ফোরণ শুরু হলে শত্রু সৈন্যের প্রচণ্ড গোলাগুলি শব্দে অদূরে অবস্থানরত উদ্ধারকারী দল নৌকাগুলি নিয়ে সরে পড়েন। মাইনের লাগাতার বিস্ফোরণে পাকিস্তানী সৈন্যরা ডাকাতিয়া দু’পাড় থেকেই একটানা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কমান্ডোদের উদ্ধারকারী নৌকা ত্যাগ করায় তাদের এখান থেকে সরে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সকলে মেঘনার তীরে উঠে পাট কিংবা ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। তখন পাকিস্তানী গানবোট গুলি অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে করতে খুঁজে ফিরছে চারদিক। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে স্থানীয় জেলে নান্নুর সহযোগিতা নিতে তার নৌকায় কমান্ডোরা আশ্রয়স্থলে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। চাঁদপুর বন্দরে পাকিস্তানীদের বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটায় হানাদার সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে দেয়। গ্রামের পর গ্রাম তল্লাশী চালাতে থাকে। কমান্ডোরা পালাতে না পেরে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকে। ১৯ তারিখ সন্ধ্যার পর আশেপাশের গ্রাম লুকিয়ে থাকা কমান্ডোরা একত্রিত হয়ে সফরমালি গ্রামের সরকার বাড়িতে। এখানে রাতের খাবার খেয়ে পুনরায় দলটি ভারত প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্য রওনা হয়। চাঁদপুর নৌ অভিযানের ফলশ্রুতিতে পাকবাহিনী চাঁদপুর এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। বর্বরতার শিকারে সম্ভ্রম হারা দাসাদি গ্রামের হিন্দু পরিবারের মেয়ে ঝর্ণা সহ আরও অনেক যুবতী ও মহিলা। নিহত হন ঐ গ্রামের স্কুল শিক্ষক ইব্রাহীম মাষ্টার (বিটি), ও নান্নু মাঝি। এছাড়াও অনেক বাঙ্গালি যুবক, পুরষ ও মহিলাকে জীবন দিতে হয়েছে।
[৪৫] কমান্ডো মোঃ খলিলুর রহমান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!