You dont have javascript enabled! Please enable it!

চাঁদহাটে যুদ্ধ, ফরিদপুর

২৯ মে, ১৯৭১। সকাল ১০টায় খবর এলো নগরকান্দা থেকে ২০/২৫ জন পাকসেনা পায়ে হেঁটে ফরিদপুরের চাঁদেরহাতের দিকে আসছে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তড়িৎ গতিতে একত্রিত হয়। কমান্ডার আজিজ মোল্লা বলেন, আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। সবাই একমত হয়। তখন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মাত্র ১৫ জন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাঁদহাটের উত্তরে কুমারদিয়ার সামনে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করা হয়। কমান্ডার আজিজ মোল্লার সঙ্গে ছিল সশস্ত্র ৫জন সহ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি চাঁদহাট রাস্তার পূর্ব দিকে অবস্থান গ্রহণ করেন। নগরকান্দা-চাঁদহাট রাস্তায় আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে ৪ জন সশস্ত্র যোদ্ধা দোহিসারার রশিদ ফকিরের নেতৃত্বে ১০ জনের অপর একটি গ্রুপ পশ্চিম দিকে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের পেছনে ছিল ঢাল-সড়কি হাতে হাজারো জনতা, যাঁদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। পাকসেনারা যখন ৩০০ গজের মধ্যে এসে যায় তখন আজিজ মোল্লা ফায়ার ওপেন করার সঙ্গে সঙ্গে তিন পাশ থেকেও গুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ছিল একটি চাইনিজ স্টেনগান এবং ১৩টি রাইফেল। পক্ষান্তরে পাকসেনারা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির জবাবে ঝাঁক ঝাঁক গুলি উড়ে আসতে লাগল। কিন্তু ওদের লক্ষ্য ব্যর্থ হতে থাকে। ওরা ঢালু স্থান থেকে গুলি করায় তা মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে চলে যায়। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল থেকে অব্যর্থ লক্ষ্যে গুলি নিক্ষিপ্ত হয়। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে একাধিক পাকসেনা বুলেটবিদ্ধ হলে তারা পিছু হটতে শুরু করে। বুলেটবিদ্ধ একজন পাকসেনা তার অস্ত্রটি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্রাশফায়ার করতে থাকলে আলতাফ রাস্তার ধার দিয়ে ক্রলিং করে সেখানে পৌঁছান এবং রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করলে পাকসেনাটি লুটিয়ে পড়ে। তখন তিনি তার হাত থেকে এমএমজি তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফায়ার করতে শুরু করেন। এতে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। তখন চারপাশ সমবেত হাজার হাজার জনতার ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে বিলে নেমে যায়। এ সময় তাদের পথপ্রদর্শক রাজাকার জাফর জনতার হাতে ধৃত হয় এবং বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেনের ব্রাশফায়ারের এক সঙ্গে কয়েকজন পাকসেনা বিলের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে। বিলটির চারপাশে হাজার হাজার জনতা কর্তৃক পাকসেনা ঘেরাও হয়। জনগণ বিলের মধ্যে নেমে ওইসব পাকসেনাকে সড়কি-বল্লম দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ঐ যুদ্ধে ঈশ্বরদী বাগাট, পাইককান্দাসহ বিভিন্ন গ্রামের মহিলারা চিঁড়া, গুড়, দুধ, রুটি ডাব ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরবরাহ করে। যুদ্ধে ঢাল-সড়কি হাতে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা নাগারদিয়ার আবুবকর সরদার (পিতা ফাণ্ড সরদার) এবং ঈশ্বরদী নুরু মিয়া (পিতা মুজিব মাতব্বর) শাহাদাত বরণ করেন। ঢাল-সড়কি নিয়ে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র এগিয়ে দিতে গিয়ে মনোয়ারা বেগম শহীদ হন। পক্ষান্তরে ১ জন ক্যাপ্টেন, ২ জন লেফটেন্যান্টসহ ২৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। তিনটি মিডিয়াম মেশিনগান, একটি স্টেন, চারটি চাইনিজ রাইফেলসহ বহু গোলাগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন আলতাফ হোসেন খান, রশিদ ফকির, বারেক হাবিলদার (পরবর্তী শহীদ), মোফাজ্জেল হোসেন খসরু, ইসরাইল, ইসহাক, দেলোয়ার হোসেন, আওয়ালসহ অনেক। ঐ যুদ্ধে অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন বলেন, আজিজ মোল্লার পরিকল্পনা, আমাদের সাহস এবং জনগণের অংশগ্রহণ ও উৎসাহ ছিল বলেই আমরা সেদিন ঐ বিজয় ছাড়া আমাদের পক্ষে এলাকায় সহজে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন করে গড়ে তোলা কঠিন হতো। উল্লেখ্য, পাকসেনারা পরে নগরকান্দার বিভিন্ন গ্রামে পুঁতে রাখা ১৮টি লাশ উদ্ধারে সক্ষম হয়। ঐ লাশগুলো আলীপুর গোরস্থানে দাফন করে। দু’জন কর্মকর্তা লাশ আলাদাভাবে এবং ১৬ জন সেপাইর লাশ একত্রিত করে দাফন করে। ঐ কবরগুলো এখনো রয়েছে। স্বাধীনতার পর বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ নামফলকস কবরের কিছু অংশ ভেঙে ফেলে।
[১৫] আবু সাঈদ খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!