চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় অভিজান
২১ নভেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সহযোগবাহিনির সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর কাঠামো অনুমোদিত হওয়ার পর সুস্থভাবে চূড়ান্ত যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি অপারেশন সেক্টর বিভক্ত করে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন পরিকল্পনা করা হয়। এই সেক্টরগুলো ছিল যথাক্রমে দক্ষিণ সেক্টর, উত্তর সেক্টর, মধ্য সেক্টর এবং পূর্ব সেক্টর। পূর্ব সেক্টর তথা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত জেলাসমুহ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়খালী এবং সিলেট নিয়ে গঠিত। এই যুদ্ধ এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর ৪র্থ কোর এবং মুক্তিবাহিনীর ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ এবন ৫ম সেক্টরের সেক্টর ট্রুপ্স, এস ফোর্স, কে ফোর্স ও জেড গোসের অংশবিশেশ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলে অগ্রাভিযানের সময়য় যে অক্ষগুলো অনুসরণ করে সেগুলো হলঃ (ক) ফেনী-জোরারগঞ্জ-মিরসরাই-সীতাকুণ্ড-কুমিরা-ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম শহর। (খ) রামগড়-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-হাটহাজারি-চট্টগ্রাম শহর। (গ) মিজোরাম-রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম শহর। (ঘ) কল্কাতা-বঙ্গপসাগর-কক্সবাজার-চট্টগ্রাম শহর।
১ম অভিযানঃ ফেনী-জোরারগঞ্জ-মিরসরাই-সীতাকুণ্ড-কুমিরা-ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম শহর। ফেনি থেকে চট্টগ্রাম শহরের দূরত্ব ৬৫ মাইল। এই দূরত্ব গিয়ে কিলোফোর্সের সম্পূরক ফোর্স হিসেবে রাখা হয়। প্রথমে কিলোফোর্স চট্টগ্রাম শহরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অগ্রসর হয়। এই ফোর্সের সংগঠন ছিল নিম্নরুপঃ
২ নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ( এই ব্যাটালিয়নগুলো ভারতের পার্বত্যমিজো নিয়ে গঠিত),
২ ক্ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট,
২ ক্ম বি এফ এফ ব্যাটালিয়ন,
৬ ক্ম মুক্তিবাহিনী কোম্পানি,
১ ক্ম মাউন্টেন রেজিমেন্ট (ব্যাটারি ব্যতীত),
১ ক্ম মুজিব ব্যাটারি,
১ ক্ম ৩.৭ ইঞ্চি বিএসএফ হাউইটাজারস,
১ ক্ম বিএসএফ পোস্ট গ্রুপ,
১ ক্ম ফিল্ড কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার (প্রাক্তন ২৩৪ রেজিমেন্ট থেকে) এছাড়া সংশ্লিষ্ট সদর যেমন- যোগাযোগ উ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সাহায্য দেওয়ার জন্য নিয়োজিত। কিলেফোর্সের আধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার আনন্দ সরুপ কাউন্টার ইন্টারজেন্সি অপারেশন সংক্রান্ত ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ থাকায় তাঁকে কিলোফোর্সের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৮৩ মাউন্টেন বিগ্রেড লাকসাম দখলের জন্য অগ্রাভিযান চালিয়ে লাকসামকে শত্রুমুক্ত করার সময় ফেনীতে অবস্থানরত পাকবাহিনী সেখান থেকে পালিয়ে ফেনী নদী উপর রোড ও রেল উভয় ধরনের ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। ফলে কিলোফোর্স নদীর উপর রোড পল্টন ব্রিজ তৈরি করে। অন্যদিকে ৮ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল ও ক্যাপ্টেন আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিলোফোর্স ডিসেম্বরের মধ্যে জোরারগঞ্জে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মুখোমুখি হয় ও পকাসেনাদের পরাজিত করে জোরারগঞ্জ ও করেরহাট দখল করে নেয়।মেজর রফি-করেরহাট সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। মুক্তিবাহিনীর খাদ্যদ্রব্য ও রসদ সরবরাহ ও মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযান ব্যাবহ হচ্ছিল কারণ ফেনী নদীর উপর ধ্বংস করা ব্রিজ ভালো করে ঠিক করা সম্ভব হয়নি। এদিকে মিত্রবাহিনী দ্রুত চট্টগ্রাম শহর থেকে পাকসেনাদের বিতাড়িত করতে চাচ্ছিল (আমেরিকা ৭ম নৌবহর সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই)। মিত্রবাহিনী অগ্রাভিযানকালে গেরিলাদের সহায়তায় মুক্তবাহিনী মিরসরাইতে গোপন ঘাঁটি স্থাপন ও সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। পাকবাহিনী এর বিপরীতে সহযোগিতা না পেয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। ৯ ডিসেম্বর পর পাকবাহিনী মিরসরাই থেকে পশ্চাপৎসরণ করে ১২ মাইলে দক্ষিণে সীতাকুণ্ডে গিয়ে প্রতিরোধ গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ পর্যায়ে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১০ ডিসেম্বর মধ্যে মূলবাহিনীর সাথে সীতাকুণ্ডে মিলিত হন। ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড শত্রুমুক্ত হয়। এরপর মিত্রবাহিনী সীতাকুণ্ড ফৌজদার হাট চট্টগ্রাম শহর অক্ষে, অন্যটি হাটহাজারী চট্টগ্রাম অক্ষে অগ্রাভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ৪র্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল স্বগত সিং চট্টগ্রাম দ্রুত দখল লক্ষে ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের সমাবেশ ঘটান। পরে সম্মিলিত বাহিনী কুমিরার সন্নিকটে পৌঁছান। পাকবাহিনী এখানে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অপারেশন সুবিধার্থে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর সহযোগী লে. মনসুর, পুলিশের হাবিলদার মুসলিম উদ্দিন, সিপাহী মোঃ আবু তাহের, আবু বকর, ইব্রাহিম, আজিজ, নজরুল ইসলাম, স্থানীয় রেলওয়ে কর্মচারী হাসেম মিস্ত্রী, আব্দুর রউফ খালসী ও স্থানীয় কয়েকজন কাঠুরিয়া বেশে ক্যাম্পে পর্যবেক্ষণে জঙ্গলে যান। পর্যবেক্ষণ ও কাঠ সংগ্রহ করে আসার সময়য় হঠাৎ পাক ট্রাক দেখে চিন্তিত হন, কিন্তু সামলে নিয়ে চুপচাপ থাকেন। পাকসেনা ট্রাক ৩ জন রক্ষী ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন যে, “তোমরা রেশনগুলো ক্যাম্পের ভিতরে পৌঁছিয়ে দাও।’ এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা হঠাৎ সুযোগ পেয়ে ক্যাম্পে যান ও সেখানে শতাধিক পাকসেনাসহ ক্যাম্পের সঠিক অবস্থা দেখার সুযোগ পান। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্ব আনুমানিক ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত প্রায় ১২টার দিক মিরসরাই ক্যাম্প থেকে স্থানীয় ট্রাকে করে সাথে ২৫০ ভারতীয় সৈন্য নিজস্ব সামরিক গাড়িতে কুমিরা রেলস্টেশনের দিকে অগ্রসর হন। অপরদিকে লে.মনসুর কুমিরা রেলস্টশনের আউটার সিগন্যালের কাছে এসে একটি ছড়াকে (নালাকে) সামনে রেখে অবস্থান নেন। ভারতীয় সৈন্যরা যক্ষ্মা হাসপাতালের সামনের গেইটের পাশে অবস্থান নেয়। এরপর ক্যাপ্টেন মাহফুজ পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁর নিজ দল ও ক্যাপ্টেন মনসুরের দলকে হাসপাতালের দিকে অগ্রসর হয়ে আক্রমণের আদেশ দেন। এসময় পাকসেনারা দেখে ফেলে ও আচমকা গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন মাহফুজ বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের কভারিং ফায়ার দেয়ার জন্য আহবান জানান। ভারতীয় সৈন্যরা ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার ৭৫ মিমি আর এবং আর্টিলারি গান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। এভাবে ফায়ার পাল্টা ফায়ার চলতে থাকে। উভয়ের ১৫ ডিসেম্বর সকার ১১ টা পর্যন্ত চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পটি দখল করে নেন। এই যুদ্ধে ৮০-৯০ জন পাকসেনা প্রাণ হারায় এবং ২২ জনকে বন্দি করা হয়। ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ৫০ জনের মতো ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। মিত্রবাহিনী পরে কুমিরার দক্ষিণে ভাটিয়ারী এলাকায় তাঁদের মূল প্রতিরক্ষাসহ আরো দক্ষিণে ধাকা-চট্টগ্রাম-ট্রাঙ্ক রোড বরাবর ফৌজদারহাট পর্যন্ত ভাটিয়ারী-ফৌজদারহাট অক্ষে কতগুলো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলে। তবে পাকসেনারা সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন করার লক্ষ্যে সকল সৈন্য ও ভারি অস্ত্র-শস্ত্রের সমাবেশ করে। তবে পাকিস্তান বাহিনী শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করতে পারেনি। তাঁরা পশ্চাদপসারণ করে শহরের দালান-কোঠা, দোকান, বাড়িঘরের মধ্যে যদি দূর্গ গড়ে তোলে তবে তাঁদের পরাজিত করা কঠিন হবে, এ কারণে মিত্রবাহিনী পরিকল্পনা করে যে ভাটিয়ারী-ফৌজদারহাট এলাকার প্রতিরক্ষা অবস্থানেই পাকবাহিনীকে পরাস্ত ও শেষ করতে হবে। এজন্য মিত্রবাহিনীকে ৮৩ ব্রিগেডের ২ রাজপুত এবং ৩ ডোগরা ব্যাটালিয়নকে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান বাইপাস করে পেছনে গিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে যাতে পাকবাহিনী পালিয়ে না যেতে পারে। সৈন্যদের কয়েকদিনের যুদ্ধ প্রস্তুতি অস্ত্র-রশদ নেওয়ার জন্য আনুমানিক ১২০০ বেসামরিক লোক সংগ্রহ করা হয়। পরে ব্যাটিলিয়নের সৈন্যরা ১৬ ডিসেম্বরের সূর্যাস্তের কিছু আগে গাইডদের সহায়তায় পাহাড়গুলোর ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে ও প্রায় ১৫ মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ফৌজদারহাটের কিছু দক্ষিণে গিয়ে রাতের অন্ধকারে মহাসড়কের দুপাশে শক্তিশালি প্রতিরক্ষণ গড়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এদিকে ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের নির্দেশে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড এলাকার প্রায় ২০০ সশস্ত্র গেরিলা শহর এলাকায় পাকবাহিনী মোকাবেলা করার জন্য পজিশন নেন। পরে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে মিত্রবাহিনী ভাটিয়ারীতে পাকবাহিনীদের আক্রমণ করে। তবে পাকবাহিনী তা প্রতিরোধ করে। তবে মিত্রবাহিনী তাদেরকে ব্যস্ত রাখে ও বাইওপাসকৃত ফোর্সটি তা প্রতিরোধ করে। তবে মিত্রবাহিনী তাদেরকে ব্যস্ত রাকে ও বাইপাসকৃত ফোর্সটি লক্ষস্থান পৌঁছে কর্মসূচি সম্পন্ন করে। মহাসড়কে মিত্রবাহিনীও চট্টগ্রাম শহরকে দখল করার জন্য সম্মুখদিক থেকে আক্রমণ চালায়। মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযানের সময়য় আই এন এস ভিক্রান্ত চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধ করে, স্থাপনা ও চট্টগ্রাম রিফাইনারিতে শেল নিক্ষেপ করে। কয়েকটি জাহাজও ডুবে যায়, ফলে বন্দর চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়। এছাড়া মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো স্থলপথে মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযানকে ত্বরান্বিত করে। ফৌজদারহাটে বোমাবর্ষণ করে। পরে ৮৩ ব্রিগেডের অধীনস্ত ২ রাজপুত ১৫ ডিসেম্বর ৩ ডোগরা চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে এবং পাকবাহিনী (১৬ ডিসেম্বর) মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তান বাহিনীর বন্দীদের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৬১ জন অফিসার ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর সমপর্যায়ের লোক এবং তিনবাহিনীর ৮,৬১৮ জন আত্মসমর্পণ করে।
২য় অভিযানঃ রামগড়-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-নাজিরহাট-হাটহাজারী-চট্টগ্রাম শহর অক্ষের ফ্ল্যঙ্ক প্রটেকশন ফোর্স হিসেবে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুজিব ব্যাটারিকে রামগড়-ফটিকছড়ি—নারায়নহাট-নাজিরাহাট-হাটহাজারি-চট্টগ্রাম অক্ষে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মিত্রবাহিনী ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপ এসময় হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হাটহাজারীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অগ্রসর হন। ক্যাপ্টেন জাফরকে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মিত্রবাহিনী দলকে সীতাকুণ্ড রেখে হাটহাজাড়ী অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার আহবান জানান। ১৪ ডিসেম্বর জাফর পিছে যান। ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফারের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নাজিরহাটে পৌঁছে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক ধরে হাটহাজারীর অনতীদূরে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরে হাটহাজারী নিকট পৌঁছে যান। ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকবাহিনীর মেজর হাদী ২৪ ফন্টিয়ার ফোর্সের ব্রাভো কোম্পানি নিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
৩য় অভিযানঃ মিজোরাম-বাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম শহর ভারতীয় বাহিনীর একটি স্পেশাল ফোর্স মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের নেতৃত্বে এই অক্ষে অগ্রাভিযান হয়। অসাম রাইফেল ও অন্যান্য ইউনিট এবং মিজো হিলরেঞ্জ হেডকোয়াটারস থেকে অন্যান্য বাহিনীসহ আনুমানিক ২০০০ সৈন্যের এই বাহিনী গঠন করা হয়। পার্বত্যাঞ্চল দিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন এই বাহিনীতে হেলিকপ্টার এবং ফিকসিড উইং এয়ার ক্র্যকটের মাধ্যমে সরবরাহ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। এই বাহিনী মিজোরাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এরা ৩টি কলামে বিভক্ত হয়ে যায়। যথাক্রমে রামগড়, রাঙ্গামাটি এবং দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রামে অগ্রসর হয়। স্পেশাল ফোর্সের একটি কলামে রাঙ্গামাটি থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে রাঙ্গামাটি-রামগড় অক্ষ হয়ে প্রথমে রামগড় পৌঁছে ওখান থেকে মিত্রবাহিনীর অন্যান্য বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে হাটহাজারীর দিকে অগ্রসর হয়। ২য় কলামটি রাঙ্গামাটি হয়ে রাঙ্গামাটি-হাটহাজারীর অক্ষ বরাবর অগ্রসর হয়। এবং পূর্ব দিক থেকে চট্টগ্রাম শহরের উপকন্ঠে এসে চট্টগ্রাম শহরকে অবরোধ করে রাখে। তবে এই কলামটি উদ্দেশ্য ছিল রাঙ্গামাটিতে অবস্থানরত পাককমান্ডোদের ধ্বংস করে নিজেদেরকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তৃতীয় কলামটি রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই হয়ে দক্ষিণ দিকে কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। এই গ্রুপের উদ্দেশ্য ছিল কাপ্তাই এ অবস্থানরত পাক কমান্ডোদের ধ্বংস করে আরো দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে পাক সেনাদের বার্মায় পলায়নের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা। তবে পাকবাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ারস ফোর্স কক্সবাজার সহ আশেপাশের এলাকা চূড়ান্তজুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়। তখন রাজনৈতিক প্রেক্ষপটে মিজোরামের বিদ্রোহীরা পাকবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে। পাকবাহিনী তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য রাঙ্গামাটিতে ১টি উন্নত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। মিজোরাম থেকে যে কলামটি পূর্বদিকে থেকে রাঙ্গামাটির দিকে অগ্রসর হয়, সেই বাহিনীর রাঙ্গামাটিতে পাকবাহিনীর অবস্থানের বিষয় জানা ছিল না। ফলে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে তাঁদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। এবং ভারতীয় বাহিনী কৌশলগত দিক থেকে সুবিধা অর্জনে ব্যর্থ হয়। তবে ২ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন পাকবাহিনীর কিছু অংশকে পর্যুদুস্ত করতে সমর্থ হয়। ১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনী রাঙ্গামাটিতে থেকে পশ্চাদপসরণ করলে মিত্রবাহিনীর ৮৩ বিগ্রেড রাঙ্গামাটি দখল করে।
[৫৯৭] কে. এম. আহসান কবীর
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত