চট্টগ্রাম নৌ-কমান্ডো অভিযান
মধ্য আগস্ট থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত নৌ-কমান্ডোরা বাংলাদেশের জলসীমায় ৪৫ টি দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে শত্রুবাহিনীর প্রায় ৭৫হাজার মেট্রিক টন যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ সামগ্রী সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করে এবং প্রায় এক লক্ষ টন আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এই ক্ষতির পরিমাণ নয় মাসের যুদ্ধে দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ ক্ষতির অর্ধেকের সমান। এপ্রিলের পর উপকূলবর্তী এলাকাসহ চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দর নিয়ে গঠিত হয় ১০ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে কাজ শুরু করেন ১৩ জন বাঙালি নাবিক যারা বিবিসিতে বাংলাদেশে পাকসেনাদের গণহত্যার খবর পেয়ে ফ্র্যান্সের পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে ভারতে আসেন। ১৩ জনের মধ্যে ৮ জনকে ২৩ এপ্রিল থেকে ৮ মে, ১৯৭১ পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় দিল্লিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় অপারেশন ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১: ১৫ আগস্ট ’৭১ এর সফল নৌ-অপারেশনের পর চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবহারের অকেজো হয়ে পড়লে নিরাপত্তার কারণে বিদেশী জাহাজসমূহ বঙ্গোপসাগরের গভীর জলসীমায় রাত্রিযাপন করতে বাধ্য হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে নৌ-কমান্ডোরা পরিকল্পনা করেন তাঁরা গভীর সমুদ্রে নোঙ্গরকৃত জাহাজ আক্রমণ করবেন ও ধ্বংস করবেন এবং অবস্থানরত সমরাস্ত্র ও তেলের জাহাজ ডুবিয়ে দেবেন। নৌ-কমান্ডো ফারুক-ই আজমের নেতৃত্বে ১১ জন কমান্ডো এই অপারেশন পরিচালনা করবেন। তাঁরা নৌকায় করে জাহাজ বরাবর নেমে গভীর সমুদ্রে নোঙর করা জাহাজে পৌঁছে দ্রুত মাইন লাগিয়ে নৌকায় করে ফিরে আসবেন এই পরিকল্পনা করেন। অপারেশনের দিন ১১ জন কমান্ডো সমুদ্রপাড়ের পূর্ব নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হন। তবে যে নৌকায় তাঁরা সাগরে পৌঁছবেন তা যথাসময়ে না আসায় সেদিনের মতো অভিযান পরিত্যাগ করে ঘাঁটিতে ফিরে যান। ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে কমান্ডোরা কর্ণফুলী নদীর পূর্ব মোহনায় উলদিয়া বাতিঘরের কাছে একটি স্থান থেকে ভাঁটার পর সমুদ্রে নেমে পড়েন। অপারেশনে ছিলেন মোহাম্মদ ফরিদ, আমি হোসেন, গোলাম মওলা, সাইদুর রহমান মনুন, আবেদিন কাজল, আবু মুসা, নুরুল হক, রশিদ, তাহের, মনোজ অ হাশেম। দেড় ঘণ্টা সাঁতরানোর পরও দুঃসাহসী কমান্ডোরা কাছাকাছি পৌছাতে পারেননি। তাঁদের পর্যবেক্ষণ দুরত্বের পরিমাণ ভুল ছিল। ক্লান্ত শরীরে কোনো রকমে কয়েকজন তীরে উঠতে পারেন এবং ৭ জন মেরিন একাডেমি কাছে মৃতপ্রায় অবস্থায় পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। অন্য একজন মোহাম্মদ হোসেন পানিতে ডুবে মারা যান। কমান্ডো ফরিদকে অমানুষিক অত্তাচারে হত্যা করে পাকবাহিনী। অনভিজ্ঞভাবে অপারেশন করতে গিয়ে মূল্য দিতে হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের।
এমভি ‘অ্যাভলুস’ অভিযানঃ অক্টোবরের ২ তারিখ ১৯৭১ সালে ফারুক ই আজম এর নেতৃত্বে মুসা চৌধুরী অ মনোজ এই অভিজান করেন। মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে বার্মার জেটিতে গ্রিক তেল ট্যাংকার ‘এমভি এ্যাভলুস’ অ আরেকটি ছোট জাহাজ ‘মোনা’ নঙর করেছে। পাকবাহিনীকে জ্বালানি সংকটে ফলতে এই অপারেশনের সিদ্ধান্ত হয়। এই ইপারেশনে ২ জন কমান্ডোকে পাঠানো হয়। যথাসময়ে রাত ১২ টায় কমান্ডো মুসা অ মনোজ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পোস্তগোলা বরাবর গুপ্তাখালের নিকট পৌঁছান, এরপর সামনের ব্রিজ ডুব দিয়ে পার হয়ে নিচ দিয়ে কর্ণফুলি নদীতে পৌঁছান। মুসা মাইন স্থাপন করেন ‘এমভি এ্যাভলুসে’ আর মনোজ ‘মোনা’তে। তাঁরা সাতরিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। অভিজান সফল হয় এবং যথাসময়ে দুটি জাহাজ-ই নিমজ্জিত হয়।
[৫৯৭] কে. এম. আহসান কবীর
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত