You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঘিওরের জাবরায় গানবোট আক্রমণ, মানিকগঞ্জ

ঢাকা-আরিচা মহসড়কে মানিকগঞ্জ জেলার জাবরা ব্রিজের নিকট শত্রু গানবোট ধ্বংস করা ছিল বাতেন বাহিনীর একটি কৃতিত্বপূর্ণ আক্রমণ। গোলাবারুদের অভাবে বাহিনীর ৬২টি চাইনিজ রাইফেল এবং ১৫টি এলএমজি প্রায় অকোজে হয়ে পড়ে। সে সময়ে বাহিনীর গোয়েন্দা দপ্তরের মাধ্যমে অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন সংবাদ পান যে, মানিকগঞ্জের জাবরা ব্রিজের উত্তরে এক গ্রামে ১৭ পেটি চাইনিজ গুলি আছে। সেই গুলির সন্ধান এবং উদ্ধার করার লক্ষ্যে অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন দুই কোম্পানি যোদ্ধাসহ ঐ এলাকার দিকে অগ্রসর হন। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন নায়েক আব্দুস সামাদ ও নায়েক আজাহার। বহু কষ্টে বহু পথঘাট অতিক্রম করে মানিগঞ্জের সেই গ্রামে উপস্থিত হন বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যোদ্ধারা। সৌভাগ্যবশত সেখানে ১৭ পেটি গুলিই পাওয়া যান। ফলে জীবন ফিরে পায় ৬২ টি চাইনিজ রাইফেজ এবং ১৫টি চাইনিজ এলএমজি। ওখানে আরো অতিরিক্ত পাওয়া যায় একশ তাজা গ্রেনেড। ঐ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র পাবার পর বাতেন বাহিনীর যোদ্ধারা যখন স্থান ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেয়, তখন চারপাশ থেকে বিভিন্ন গ্রামের লোকজন এসে ভিড় করে। জনতা সংবাদ দেয় যে, পাকসেনারা প্রতি সপ্তাহে একটি করে গানবোট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে উত্তর দিকে যায়। যাবার সময়য় গানবোটটি জাবরা ব্রিজের ৩/৪ মাইল উত্তরে একটি নির্দিষ্ট ঘাটে থামায়। হানাদার সৈন্যরা এ সমস্ত গ্রামে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ করে। ইতোমধ্যে হানাদার সৈন্যরা ঐ এলাকা থেকে ১০/২০ জন যুবতী মেয়েকে গানবোটে তুলে নিয়ে যায়। এর ফলে অত্র এলাকায় স্বজনহারার বেদনা ও যুবতী কন্যা অপহরণজনিত আর্তনাদে আকাস বাতাস ভারী করে তোলে। স্থানীয় জনসাধারণ বাতেন বাহিনীর কাছে বারবার দাবি করতে থাকে, আপনারা এ অত্যাচার থেকে আমাদের মুক্তি দিন। জনতার আকুল দাবীর মুখে বাহিনীর অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। অকুস্থলে যাবার পর দেখা গেল পাল মশাইদের হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করার এঁটেল মাটির ঢিবি সারি সারি ভাবে সাজানো আছে। নদীটিও সে স্থানে একটু সংকীর্ণ ছিল। কোম্পানি কমান্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করে আক্রমণের কৌশল ঠিক করেন বাহিনীর অধিনায়ক। মাটির ঢিবিগুলো নদীর ঘাট থেকে দুইশত গজ দূরে অবস্থিত ছিল। সেখানেই বাঙ্কার করে পজিশন নেন বাতেন বাহিনীর যোদ্ধারা। প্রথম দিকে যেভাবে পজিশন নেয়, সেভাবে শত্রু সৈন্যদের ঘায়েল করা কঠিন হবে ভেবে কোম্পানি কমান্ডারদ্বয় বাহিনীর অধিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে দুই কোম্পানিকে নদীর দুই তীরে পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য ঘন অন্ধকারে নৌকাযোগে নদীর পূর্বতীরে নায়েক আব্দুস সামাদের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হয়। সিগন্যাল কর্মপদ্ধতি এবং শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোম্পানি প্রত্যাহার করার প্রয়োজন দেখা দিলে নদীর দুই তীরের কোম্পানি কোথায় একত্রিত হবে তার পয়েন্ট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এরপর বাতেন বাহিনীর যোদ্ধারা শত্রু সৈন্যর আগমণের জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকে। রাত দুইটার সময় যোদ্ধারা গ্রামবাসীদের দেয়া খাদ্য গ্রহণ করে ক্ষুধা নিবারণ করে। রাত চলে গেল। দিন এল। কিন্তু হানাদারদের গানবোটের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। গানবোটের কোনো খোঁজ না পেয়ে যখন বাতেন বাহিনীর যোদ্ধারা স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন গ্রামবাসীরা আরো এক রাত থাকার অনুরোধ করে। ইতোমধ্যে যোদ্ধারা খাদ্যগ্রহণ করে। আবারো প্রতিরক্ষায় থাকে কোনো সময়য় আসবে হানাদারদের গানবোট, কোন সময়য় গর্জে উঠবে হানাদার নিধনে বাতেন বাহিনীর যোদ্ধাদের মারণাস্ত্রগুলো। রাত দুটোর সময় একজন স্কাউট তিনি ব্যাটারি টর্চের আলোয় সংকেত প্রদান করে গানবোট আসছে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় গানবোটটি আসছে জাবরা ব্রিজের নিচে দিয়ে। স্বভাবত অপর পাড়ে সিগন্যাল চলে যায় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। রাত তিনটার সময়য় গানবোটটি বাতেন বাহিনীর অবস্থানের ৪/৫ শত গজ দূরে ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। ঘাট থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে থাকতে গর্জে ওঠে বাতেন বাহিনীর যোদ্ধাদের মারণাস্ত্রগুলো। তার ফলে গানবোট থেকে শত্রু সৈন্যরা প্রচণ্ডভাবে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে বাতেন বাহিনীর যোদ্ধাদের ওপর। প্রথম দিকে বাতেন বাহিনীর গুলিতে গানবোটের কোনো প্রকার ক্ষতি না হওয়াতে বাহিনীর অধিনায়ক বাধ্য হয়ে গুলি ছোড়ার কৌশল পরিবর্তন করে। গানবোটের ফোকাস হোলে এওং চেইনে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো যোদ্ধারা গুলি ছোঁড়া শুরু করে। এবার কাজ হলো, গুলিতে গানবোটের হালের চেইন ছিঁড়ে যায়। গানবোটটি নদীর পূর্বপার্শ্বের দিকে অগ্রসর হয়। স্রোতের টানে গানবোটটির একটু ভারির দিকে চলে যায়। তার পরক্ষণেই ওপারে অবস্থানরত কোম্পানি গুলি ছুঁড়তে থাকে। রাত সাড়ে চারটার সময়য় স্কাউটের সংকেত পাওয়া যায় শত্রুবাহিনী উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর গানবোটটি নদীর এক কিনারায় আটকে যায়। এই আক্রমণে গানবোটের প্রচুর ক্ষতি হয়। হানাদারদের ১৮ জন নিহত হয় এবং ২৫ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। উল্লেখ্য ঐ সময়য় পাকবাহিনী পুরু স্টিল বডি ইঞ্জিন চালিত নৌকাকে উন্নত করে গানবোট হিসেবে ব্যবহার করত। সাধারণের কাছে এগুলোই গানবোট হিসেবে পরিচিত পায়। ভোর ৫টার দিকে সংকেত পেয়ে বাতে বাহিনী উত্তর দিকে সরে যায়। দুই কিলোমিটার নদীর পাড় ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে খেয়ার মাধ্যমে একত্রিত হয়। অপারেশন থাকে অসম্পূর্ণ।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!