You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.28 | চট্টগ্রাম বন্দরে “অপারেশন জ্যাকপট” - সংগ্রামের নোটবুক

চট্টগ্রাম বন্দরে “অপারেশন জ্যাকপট”

চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় ২৮ জুলাই, ১৯৭১ সালে। ১ নম্বর সেক্টর এর কমান্ডার মেজর রফিক ও ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় ডেলটা সেক্টরের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং সম্মিলিতভাবে এই অপারেশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অপারেশনের পূর্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক অবস্থা। পাকসেনাদের অবস্থান ও শক্তি, বন্দরে পৌঁছানোর নিরাপদ গতিপথ, আশ্রয়স্থল। সমুদ্র বন্দরের জোয়ার-ভাটার তালিকা, মানচিত্র, সাংকেতিক নির্দেশনা, নৌ কমান্ডোদের প্রত্যাগমণ ও নিরাপত্তার জন্য সাহায্যকারী দল, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ১৪ আগস্ট রাতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ কমান্ডো অপারেশন পরিচালিত হবে। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানীদের কাছে তাদের জাতীয় জিবনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিবস। দিন তাদের সাধিনতা দিবস। স্বভাবতই দিবসটি তাঁরা আনন্দ-উল্লাস আর পান-ভোজনের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করবে। ধরে নেয়া হয়, স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের কারণে ১৪ আগস্ট বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী বড় ধরনের কোনো সামরিক অভিযানে যাবে না। একই কারণে তাদের নিরাপত্তামূলক সতর্কতায়ও কিছুটা শৈথিল্য আস্তে পারে। আর এই সুযোগটি সযত্নে কাজে লাগানোর জন্যেই অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার উপযুক্ত সময়য় হিসেবে ১৪ আগস্টের রাতটিকে বেছে নেয়া হয় তবে পরে বিভিন্ন বাস্তব কারণে (কমান্ডো দল সময়মতো যথাস্থানে পৌঁছাতে না পারায়) নৌকমাণ্ডো অপারেশনের তারিখ একদিন পিছিয়ে ১৫ আগস্ট করা হয়েছিল। তবে এ তারিখ পরিবর্তনের কথাটি নৌকমান্ডো দলের নেতা ছাড়া আর কাউকে জানানো হয়নি।
নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম বলেনঃ ২৮ জুলাই আমি ভারতীয় বাহিনীর ‘ডেলটা’ সক্তরের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সাথে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। চার ঘন্টারও বেশি সময়য় ধরে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর অ কর্ণফুলী নদীর ম্যাপ অ চার্ট পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। এ ধরনের অভিযানে চন্দ্রতিথি, আবহাওয়া অবস্থা, জোয়ার-ভাঁটার সময়সমূহ, বাতাস, স্রোতের গতি-প্রকৃতি এবং আরো অসংখ্য তথ্য গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়। মে মাসে থেকেই আমি চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ধরনের কর্মতৎপরতা ও জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। ফলে, জুলাই মাসের ২৮ তারিখে যখন আমরা পরিকল্পনায় বসলাম, ততক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড ও কর্মচঞ্চলতা এবং কর্ণফুলী নদীতে জাহাজ-চলাচল সম্পর্কিত বিস্তারিত সব তথ্যই আমাদের হাতে ছিল। তাই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারছিলাম যে, বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যোদ্ধারা (পরে নৌ-কমান্ডো হিসেবে পরিচিত হয়) এই অভিযান পরিচালনায় কি ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং কোন কোন পর্যায়ে কোথায় পাকিস্তানীদের সাথে তাদের সংঘর্ষ পারে। বন্দরে নিরাপত্তা জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী কি ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্ভন করছে এবং সেখানে প্রহরারত সেন্ট্রিদের মানসিক অবস্থা ও সার্বিক প্রস্তুতিই বা কেমন-এ সবকিছু সম্পর্কেই ততদিন আমাদের বেশ স্বচ্ছ ধারণা হয়ে গিয়েছিল। রাতেরবেলা নদীতে সব ধরনের নৌ-চলাচল বন্ধ ছিল শুধুমাত্র পাকিস্তানীদের গানবোটগুলো নির্দিষ্ট সময়য় অন্তর অন্তর প্যাট্রোল ডিউটিতে বেরিয়ে যেত। তাদের প্যাট্রোলিংয়ে আসা-যাওয়ার সময়সুচি যদি আমাদের জানা থাকে এবং আমরা যদি আমাদের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে পারি, তাহলেই এ ধরনের অভিযান চালানো সম্ভব। অভিযানের দিন হিসাবে ১৪ আগস্ট নির্ধারিত হলো-সে দিনটি পাকিস্তানীদের স্বাধীনতা-দিবস। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ আগস্ট রাতেরবেলা ৬০ জন নৌ-কমান্ডো, কর্ণফুলী নদী সাঁতরিয়ে বন্দরের দিকে চলে যাবে, এবং সেখানে ‘বার্থিং’ করা সমুদ্রগামী ও অন্যান্য জাহাজে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘লিমপেট মাইন’ লাগিয়ে ভাঁটার টানের সাথে চলে যাবে সমুদ্রের দিকে। ততক্ষণে পেছনে শুরু হয়ে আবে তুমুল কাণ্ড। এক এক করে অনেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে যাবে, এবং মূল জেটিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অভিযানের জন্য নির্বাচিত ৬০ জন নৌ- কমান্ডো তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ৮ আগস্ট চট্টগ্রামের পথে রওনা হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নির্ধারিত তিনটি গ্রুপের দুটি গ্রুপ স্থলপথে ও একটি গ্রুপ জলপথে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ অপারেশন পরিচালনার জন্য পূর্বনির্ধারতি বিভিন্ন গাইডের মাধ্যমে চট্টগ্রামের চরলাক্ষায় পৌঁছাবে। তারপর তাঁরা অপারেশন জন্য মোট ৬০ জন নৌ-কমান্ডো ৩টি গ্রুপে ভাগ হয়ে অংশগ্রহণ করবে। নৌ-কমান্ডোরা কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত নির্ধারতি ওয়েভে বাজানো গান-সংকেতের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের একটু দূর থেকে কর্ণফুলী নদীতে নেমে সাঁতরে বন্দরে পৌঁছবে। সেখানে নোঙর করা প্রত্যেকটি জাহাজে ৩টি করে লিমপিট মাইন মাইন লাগিয়ে দেবে। তারপর ভাঁটার টানের সাথে সাথে তীরে পৌঁছে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবে। নৌ-কমান্ডোদল বাংলাদশে প্রবেশের উদ্দেশ্যে ৭ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে ভারতে পলাশী ঘাঁটি ত্যাগ করেন। ঐ দিনেই কলকাতা ব্যারাকপুর সেনানিবাসে পৌঁছেন। পরেরদিন ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে করে তাঁরা আগরতলার বিএসএফ “নিউ ক্যাম্পে” এসে পৌঁছায়। এখানে কমান্ডোদের পরিকল্পনা, দলবিভাজন সমন্বয়, গতিপথ, অপারেশন স্থলের মানচিত্র, জোয়ার-ভাঁটার সময়, স্রোতের গতিসহ অপারেশনসংক্রান্ত সার্বিক বিষয়াদি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট কমান্ডোরা নিউ ক্যাম্প ছেড়ে হরিনা পৌঁছেন। এখানে কমান্ডো দলের নেতা এ ডব্লিউ চৌধুরী, ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের কাছে থেকে অপারেশন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি ও সামরিক সরঞ্জাম বুঝে নেন। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রত্যেকের জন্য দুটি করে লিমপেট মাইন, ধারালো ছুরি, একজোড়া কাপড়ের জুতা, একজোড়া ফিনস, একটি সুইমিং কস্টিউম, একটি হাফপ্যান্ট ও একটি চটের ব্যাগ। এই দিনই কমান্ডো দল হরিণা ক্যাম্প ত্যাগ করে শ্রীনগর ক্যাম্পে পৌঁছেন এবং ঐ দিন রাতেই বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্দেশ্যে শ্রীনগর ক্যাম্প ত্যাগ করেন। কিন্তু সীমান্ত এলাকায় পাকসেনাদের নিরবিচ্ছিন্ন প্রহরার কারণে তাঁরা ৯ আগস্ট বাংলাদেশ প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। ১০ আগস্টেও একই কারণে তাদের বাংলাদেশ প্রবেশের চেষ্টা সফল হয়নি। অবশেষে ১১ আগস্ট বৃষ্টি আর অন্ধকারের সুবিধা নিয়ে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে নৌকমান্ডোদের দুটি গ্রুপ স্থলপথে আর অন্য গ্রুপটি জলপথে বাংলাদেশ প্রবেশের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থলভাগে আসা গ্রুপ দুটি পথপ্রদশর্কের সাহায্যে সাব্রুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পায়ে হেঁটে ছাগলনাইয়া থানার জিনারহাট, রানাঘাট এবং ফাজিলপুর হয়ে মুহুরি নদীর তীরবর্তী কৃষ্ণমন্দার বাজার এলাকায় পৌঁছেন। সেখান থেকে কমান্ডোরা নৌকা করে মুহুরি ও ফেনী নদী পার হয়ে মিরসরাই থানার ইছাখালী গ্রামে পৌঁছেন। কমান্ডোরা এরপর মলিইয়াস, সুফিয়া, মগাদিয়া, মায়ানি, শাহেবখালি ও ডোমখালি হয়ে ১২ আগস্ট সমিতির হাটের নিকট করমআলী বাজারে পৌঁছেন। উল্লেখ্য, তাঁরা তাঁদের অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম ইছাখালিতে রেখে এসেছিলেন। পরে সেখান থেকে এগুলো নূর মোহাম্মদ নামে এক গাইড সাম্পানে করে ফৌজদারহাটে নিয়ে আসেন। তারপর এখান থেকে অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি তরিতরকারির ঝুড়ির নিচে লুকিয়ে বিদ্যুৎবিভাগের একটি পিকআপে করে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কমান্ডোরা যাত্রীবেশে বাসে করে শহরে পৌঁছেন। ১৩ তারিখে সন্ধ্যায় ৪০ জনের কমান্ডো যাত্রীবেশে বাসে করে শহরে পৌঁছেন। ১৩ তারিখে সন্ধ্যায় ৪০ জনের কমান্ডো দলটি আগ্রাবাদের মমতাজ মহল ও কাকলীসহ অন্যান্য গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছেন। এখানে উল্লেখ্য, ২০ জনের তৃতীয় কমান্ডো দলটি সীতাকুণ্ড থানার সলিমপুরে জেলেপাড়ায় পাকসেনাদের প্রতিরোধে আটকে অপারেশনে অংশ নিতে পারেননি। সেখান থেকে নৌকমান্ডোরা শ্রমিকের বেশে মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমানের সহায়তায় বিদ্যুৎবিভাগের পিকআপ ও এ্যাম্বুলেন্সে করে কর্ণফুলি নদীর তীরস্থ মাঝিরঘাট খেয়াঘেট পৌঁছেন। এখান থেকে কমান্ডোদের অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামদি তরকারির ঝুড়িতে লুকিয়ে নৌকায় করে নদীর অপর তীর চরলাক্ষার আশ্রয়স্থলে পৌঁছে ১৪ আগস্ট।।….এদিকে ১৪ আগস্ট তারিখে ‘ট্রানজিস্টার’ ‘অন’ করতেই আকাশবাণী কলকাতার গানের অনুষ্ঠানে দলনেতা শুনতে পেল পুরানো একটা বাংলা গানঃ “আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাইনি প্রতিদান।‘ শুধু নৌ-কমান্ডোদের জন্যই এই গান। ২৪ ঘন্টা মধ্যে ওদের জন্য কলকাতাকেন্দ্র থেকে অন্য একটি গান প্রচারিত হবে। তারপর ট্রানজিস্টার ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে। যুদ্ধের জন্য এসে গান শুনতে উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে না আর।।….. ১৫ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো সেই গান, যার জন্য দলনেতা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষায় ছিল, ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ী,….।’ ১৪ আগস্টের প্রথম গানটি আসলে একটা গোপন সংকেত হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ ছিল’ ২৪ ঘন্টার মধ্যেই দ্বিতীয় গান প্রচারিত এই গানটিতে ছিল সুস্পষ্ট নির্দেশঃ অবিলম্বে যেভাবেই হোক মূল “অপারেশন” চালাতে হবে। বন্দরে অপারেশন সফল করার জন্য অপারেশনস্থল পর্যবেক্ষণ করার লক্ষ্যে নৌকমান্ডোরা চরলাক্ষার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে ১৫ আগস্ট সতর্কতার সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের অপর পাড়ে এসে পৌঁছেন। এখানে তাঁরা নদীতে নামার স্থান, স্রোতের সময়য়, গতি, বন্দরে অবস্থিত জাহাজের সংখ্যা, আকৃতি ও অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন। বন্দর এলাকা পর্যবেক্ষণকালে তাঁরা দেখতে পান ১২ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা আছে এমভি আল-আব্বাস নামের একটি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ। হাজার টনের ওপর সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এই জাহাজটি বন্দরে ভিড়েছে ৯ আগস্ট। কিন্তু তার মালামাল এখনো খালাস করা হয়নি। বন্দরের সবচেয়ে বড় জাহাজ এমভি হরমুজ। পাকিস্তানের এই জাহাজটিতেও রয়েছে প্রায় হাজার টন যুদ্ধাস্ত্র। এমভি হরমুজ বন্দরে ভিড়েছে মাত্র একদিন আগে ১৪ আগস্ট। এই জাহাজের মালামালও খালাস হয়নি। জাহাজটি নোঙ্গর করেছে ১৩ নম্বর জেটিতে। বড় আকারের এই জাহাজ দুটির কাছাকাছি জলসীমায় আরো কয়েকটি বার্জ বা গানবোট নোঙ্গর করা আছে। এর একটিতে রয়েছে প্রায় তিন শো টনের মতো সমরাস্ত্র। কয়েকটি গানবোটও আছে এখানে ওখানে ছড়িয়ে। জাহাজগুলো সঠিক অবস্থান এবং অন্যান্য রেকিপর্ব শেষ করে আবার চরলাক্ষার ঘাঁটিতে ফিরে যায় কমান্ডোরা। দলনায়ক মোটামুটি মুখস্থ করে নিলেন পুরো চিত্রটি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে শত্রুপক্ষের অত্যধিক সতর্কতা ও শক্তির কারণে ৩ জন নৌকমান্ডো এই ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বাকি ৩৭ জনকে ৩ জনের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করা হয়। তাঁরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষে চরলাক্ষার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে পাকসেনাদের গানবোটের নিরন্তর টহল ও জাহাজের সার্চলাইটের তীব্র আলো এড়িয়ে রাত ১টার দিকে কর্ণফুলির ওপারে নৌ-কমান্ডোরা পায়ে ফিনস এবং পেটে গামছায় মাইন বেঁধে নিয়ে ছোট ছোট দলে পৃথক হয়ে নিঃশব্দে নেমে পড়ছে পানিতে। নদীতে এহন জোয়ারের শেষ বেলা। একটু বাদেই ভাঁটার হালকা টান শুরু হবে। কমান্ডোরা এই জোয়ার-ভাঁটার সন্ধিক্ষণে ফিনসের হালকা টানে পানির ওপর নাক জাগিয়ে হাসের মতো এগিয়ে যায় জাহাজের দিকে। কোন জাহাজে মাইন লাগাবে তা আগেই থেকেই দেয়া আছে। কমান্ডোদের একটি দল নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে নিঃশব্দে ডুব দিল। ভেসে উঠল এমভি আল আব্বাসের শরীর ঘেঁষে। এখানটায় বন্দরের আলো কিংবা সার্চলাইটের ফোকাস পড়েনি। প্রায় একই সময়য় অন্য একটি দল ভেসে উঠে এম.ভি হরমুজের গাঁ ছুয়ে। বাদবাকি কমান্ডোরাও ততক্ষণে পৌঁছে গেছে অন্যান্য গাদাবোট ও গানবোটের কাছে। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে আল-আব্বাসের ইস্পাতের শরীর ছুঁয়ে আবার ডুব দিল কমান্ডোরা। তিনজন কমান্ডো জাহাজের তিন জায়গায়, বিশেষ করে ইঞ্জিন রুম এবং বয়লার সোজা চার থেকে পাঁচ ফুট পানির নিচে তিনটি মাইন সেঁটে দেয়ার প্রস্তুতি নিল। কোমরের ছুরি দিয়ে নির্দিষ্ট ওই স্থানের শ্যাওলা সরিয়ে অনায়াসেই মাইন লাগিয়ে দেয় তাঁরা। একইভাবে হরমুজ এবং অন্য জলযানগুলোতেও মাইন লাগিয়ে দেয়া হলো। এদিকে তখন নদীতে ভাঁটার টান শুরু হয়ে গেছে। কমান্ডোরা এবার জাহাজের আড়াল ত্যাগ করে লম্বা এক ডুব দিয়ে যতোদূর সম্ভব সরে গিয়ে ভেসে ওঠে। তারপর আগের মতোই নাক জাগিয়ে হাঁসের মতো পা দুলিয়ে নিঃশব্দে সাঁতরে ফিরে যায় ওপাড়ের দিকে নৌকামান্ডোদের এই দুঃসাহসিক নৌওপারেশনে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০টি টার্গেট সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নিমজ্জিত হয়। এম ভি আল-আব্বাস, এম ভি হরমুজ, বার্জ ওরিয়েন্ট, ২টি গানবোট, ছোট ছোট কয়েকটি বার্জ ধ্বংস হয়। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী সম্প্রাচারতি হয়ে গেলে বিদেশী জাহাজ চট্টগ্রাম আসতে অসম্মিত জানায়। এই অপারেশন মুক্তিযুদ্ধের চত্রিত্রে নতুন পেক্ষাপটে তৈরি এবং গতিতে নতুনতর মাত্রা যুক্ত করে এবং পাকসেনাদের নতুনভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা করতে বাধ্য করে। এই অপারেশনের মাধ্যমে নৌকমান্ডোদের মনোবল গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাক সরকার বহির্বিশ্বে যে অপপ্রচার চালাচ্ছিল তা আসার প্রমাণিত হয়। সারাবিশ্বের বিবেক বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তির এ লড়াইয়ের প্রতি আকর্ষিত হয়।
একাত্তরের নৌকমান্ডোরা, যার সূচনা মধ্য আগস্টের একটি নিঃশব্দ গভীর রাত সুতীব্র বিস্ফোরনের শব্দাবলী থেকে। পাক-সরকারের দলিলে এই নৌকমান্ডো অভিযানের স্বরূপঃ ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের সেই দুঃসাহসিক ও ধ্বংসাত্মক নৌকমান্ডো অভিযান এবং তাতে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতিএর ওপর তদন্ত করে পাকসামরিক কতৃপক্ষ একটি খসড়া রিপোর্ট তৈরি করে। এই রিপোর্টে ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। কমান্ডো অভিযানের ধারণাক্রম, আক্রমণের সময়ক্রম, আক্রান্ত জাহাজের নাম এবং ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে দুটো জাহাজের ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া হলোঃ ক. পাকিস্তানী পতাকাবাহী এমভি হরমুজ ৯৯১০ টন মালামাল নিয়ে করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৪.০৮.৭১ তারিখে ১৩ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করে। খ. পাকিস্তানী পতাকাবাহী এমভি আল-আব্বাস ১০৪১৮ টন মালামাল নিয়ে করচি থেকে ০৯.০৮.৭১ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করে। গ. ওরিয়েন্ট বার্জ ২৭৬ টন মালামাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ‘ফিস হারবার জেটিতে’ ঢাকা আসার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। ঘ. হরমুজ জাহাজের মাস্টারের বিবৃতিমতে, ৪ নম্বর হোল্ডে রাত ১টা ৪০ মিনিটে আর রাত ১টা ৪৮ মিনিটে আল-আব্বাসে বিস্ফোরণ ঘটে। ১ টা ৫৫ মিনিটে তৃতীয় ও ২টা ২ মিনিটে ২ নম্বর হোল্ডে বিস্ফোরণ, ১টা ৫৫ মিনিটে ২য় বিস্ফোরণ ঘটে। চ. ওরিয়েন্ট বার্জের সারেং এর বিবৃতিমতে, প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে রাত ২টা ৩০ মিনিটে, ২য় বিস্ফোরণ রাত তিনটায় এবং ভোর ৬টার দিকে বার্জটি প্রায় তলিয়ে যায়। ছ. নৌকমান্ডো অপারেশনের বিভিন্ন জাহাজের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা রয়েছে। জ. সামরিক কর্তৃপক্ষের পরিদর্শনের তথ্য, কাউকে দায়ী করতে না পারা এবং চূড়ান্ত তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা নেই মন্তব্য প্রদত্ত। ঝ. তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যাবলিতে বলা হয় বন্দরকর্তৃপক্ষ ভাবতেই পারেনি এমন ধ্বংসাত্মক অপারেশন চলতে পারে। নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্রুত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও এই দলিলটি থেকে জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নিন্মলিখিত অংশ উদ্ধৃত হলো। নৌকমান্ডো অপারেশন সংঘটিত এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির পাক-সরকারের ভাষ্যপ্রাপ্তি এই প্রথমঃ DAMAGE CAUSED DUE TO EXPLOSIONS M.V HORMAZD”, Hole at No. 4 holed: Two shell plates H 20 & J21 hold: 64” vertical. 33” horizontal. Two stell plates H20& J21 Holded: Indented 10”6” horizontal/frames & beam knees 45,46,47 Twisted Cargo battens & Supports broken. Damage to cargo in way of No4 Lower Hold filled with river Water M.V “AL-ABBAs”: Hole at fore peak & NO. 2 Hold Measured as: Fore peak=2*3 No. 2Hold= 2’-10”*6’*3 Buckled= 6’-6”*5-00’ Cargo in No. 2 hold damaged.
চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত রচনায় এই দলিলটি অত্যন্ত মূল্যবান, মৌলিক, গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত