You dont have javascript enabled! Please enable it!

গোয়ালিনিমান্দ্রা যুদ্ধ, মুন্সিগঞ্জ

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক ঐতিহাসিক ঘটনা মুন্সিগঞ্জ জেলার গোয়ালিনিমান্দ্রার যুদ্ধ। একাত্তরের ২৬ অক্টোবর, বুধবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাবাহিনীর ৩৮ ঘন্টা ব্যাপী এক তুমুল লড়াই হয়। এই জেলার মুক্তিযোদ্ধারা জুলাই-আগস্টের পর থেকে মুসলিম লীগ নেতা, শান্তিকমিটী, রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, বিভিন্ন থানা আক্রমণসহ বিভিন্ন ছোট-খাটো অপারেশনের মাধ্যমে পাকবাহিনীকে সদা ব্যস্ত রেখেছিল। পাক মিলিশিয়া বাহিনীর একটি দল অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় নৌকাযোগে লৌহজং থেকে শ্রীনগরের দিকে যাচ্ছিল। এই খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গেরিলা পদ্ধতিতে অতর্কিতে ঐ নৌকার উপর আক্রমণ করতে পাকবাহিনী ৫টি রাইফেল ফেলে শ্রীনগরের দিকে পালিয়ে যায়। এই খবর আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছার ২/৩ দিন পরে প্রায় শতাধিক সৈন্য নিয়ে পাকবাহিনী মুন্সিগঞ্জ থেকে লৌহজং থানা অভিমুখে খাল দিয়ে যাত্রা করেছে এ সংবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে যায়। গোয়েন্দা বাহিনী এ খবরও দেয় যে পাকবাহিনী কামারখোলা ও দক্ষিণ পাইকশা গ্রামের সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে গোয়ালিনীমান্দ্রার হাটের চারদিক থেকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাবার সিদ্ধান্ত নেন। এ যুদ্ধের এক অধিনায়ক ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন বলে- ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সাথীদের নিয়ে বাঙ্কারের মধ্যে এলএমজি তাক করে শত্রু হননের আশায় প্রহম গুণছি। বেলা অনুমাণ ৯টা হবে। পাকসেনাদের দুটো লঞ্চ শ্রীনগর হতে লৌহজং যাওয়ার জন্য হলদিয়ার দিকে ধীরগতিতে এগুচ্ছিল। গোয়ালিনীমান্দা হাটের দক্ষিণ পাশে আসামাত্র লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে সাড়াশি আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের হতভম্ব করে ওদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে আমার ও অন্যান্য গ্রুপের প্রায় শতাধিক মুক্তিবাহিনী চারদিক ঘিরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে চোরাগুপ্তা হামলা শুরু করে। এভাবেই সারাদিন কেটে যায়। এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথে আমি আমার বাহিনীর সদস্যদের ছয়টি গ্রুপে বিভক্ত করে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অবস্থান নেই। সারারাত পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষে পরদিন সকাল ১১টার সময়য় পাকসেনাদের সর্বশেষ জীবিত সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করি। বেলুচ পাঠান আর পাঞ্জাবীসহ মোট ৬০ জন পাকসেনা বন্দী করে, ওদের নিকট হতে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করি। এ যুদ্ধের আর এক বিবরণ পাওয়া যায় কমান্ডার আব্দুস শহীদ ভূঁইয়া হতে-‘ ঠিক হয় কমান্ডার সুলায়মান তার বাহিনী নিয়ে গোয়ালিমান্দ্রার হাটের দক্ষিণ পাশে, আমি ও আমার বাহিনী হাতের পশ্চিম দিকের খাল পাড়ের বেদে বাড়িতে এবং কমান্ডার মাসুদ তার বাহিনী নিয়ে হাটের পশ্চিমে উত্তর দিকে পজিশন নিয়ে আক্রমণ চালাবো। পরিকল্পনা অনুসারে আমরা যার যার অবস্থানে পজিশন নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ করে দেখা গেল উত্তর দিক থেকে দুটি লঞ্চে করে পাকবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা গোয়ালিমান্দ্রা হাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। লঞ্চ দুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব আনুমানিক ১০০ গজ। দুটি লঞ্চের ছাদেই একটি করে এলএমজি হাটের দিকে তাক করা। এই অবস্থা দেখেই কমান্ডার সুলায়মান হাটের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। সিদ্ধান্ত হয় দু’লঞ্চের এলএমজি ম্যানকে প্রথম আঘাত করা হবে। কমান্ডার মাসুদ তার সহযোদ্ধা সেলিম মাহাগীর, ইদ্রিস, আলী হোসেনসহ অন্যান্যদের হাটের মাঝামাঝি পশ্চিম পাশ থেকে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তিনি আমাকে, কুতুবদ্দিন খান ঝিলু ও আউয়ালকে নিয়ে হাটের দক্ষিণ পাশে রাইস মিলের মধ্যে খৈলের বস্তা ও আটা ভাঙ্গার পাথর দিয়ে বাঙ্কার তৈরি করে আক্রমণের জন্য পজিশন নিতে বলেন। কমান্ডার মাসুদ দ্বিতীয় লঞ্চের এলএমজি ম্যানকে প্রথম আঘাত করার দায়িত্ব দেন আমাকে। আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলাম। তাই আমার হাতের নিশানা সম্পর্কে কমান্ডার মাসুদের ধারণা ছিল। পাকবাহিনীর প্রথম লঞ্চটি আস্তে আস্তে হাটের দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছিল। তখন দ্বিতীয় লঞ্চটি আমাদের পজিশনের সামনে এসে যায়। অর্থাৎ দু’টি লঞ্চই আমাদের হাতের মুঠোয়। কমান্ডার সুলায়মান ইতিমধ্যে ‘ফায়ার’ বলে চেচিয়ে উঠেন। সাথে সাথে তাঁর বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে পাকবাহিনীর প্রথম লঞ্চটির। একই সঙ্গে আমি হাতের চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে দ্বিতীয় লঞ্চের এলএমজিম্যানকে ফেলে দিতে সক্ষম হই। একই সময়ে গর্জে ওঠে কমান্ডার মাসুদের এলএমজি, ঝিলুর এলএলজি আর আউয়ালের ব্রিটিশ এলএমজি। দক্ষিণে পজিশনধরা মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম লঞ্চের এলএমজি ম্যানকে গুলি লাগাতে পারেনি। ফলে সুযোগ পেয়ে এলএমজিম্যান (পাকবাহিনীর সুবেদার) অস্ত্র নিয়ে লাফিয়ে পানিতে নামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর অবিরাম ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। ইতিমধ্যে পাকসেনারা তাদের লঞ্চ দুটিকে পাড়ে ভিড়ায়। কমান্ডার মাসুদ নির্দেশ দেন যেন লঞ্চ থেকে একজন পাকসেনাও খালের পাড়ে নামতে না পারে। কমান্ডার মাসুদের নির্দেশে সেলিম জাহাঙ্গীর দুলাল, কাশেম, নান্নু, রতনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ভাঙ্গাকুল ইউনিটের বাহারুল ইসলাম, হাবিলদার বাহাউদ্দিন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাই আ.হামিদ, মোহের খসরু, নূরুল ইসলাম, মন্টু, আরশাদ, বাদশাসহ সব মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণে পাকবাহিনীর লঞ্চের দিকে অবিরাম গুলি করতে থাকে। এক সময়য় দুটি লঞ্চ থেকেই গুলি আসা বন্দ হয়ে যায়। কিন্তু কমান্ডার মাসুদ দ্বিতীয় লঞ্চটিকে মেড়ে উড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। প্রথম লঞ্চটি তিনি নিজেই মারেন। মুহূর্তে লঞ্চের ছাদের এক অংশে দ্বিতীয় গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করলেন আউয়াল। তৃতীয়টি ছুড়লাম আমি। সর্বশেষ গ্রেনেড ছুড়লেন কুতুবউদ্দিন খান সিলু। লঞ্চটির ছাদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হলেও লঞ্চের নিচ থেকে তখনও গুলি আসছে, তাই আমরা নিশ্চিত হলাম এখনও লঞ্চে পাকসেনা জীবিত আছে। তাদের ক্রমাগত ফায়ারে দক্ষিণ পাশে যুদ্ধরত কমান্ডার সুলায়মানের বাহিনী কৌশলগত কারণে কিছুটা পিছিয়ে আসেন। এই সুযোগে পাক বাহিনী প্রথম লঞ্চটিকে খালের দক্ষিণ পাড়ে চাপিয়ে নিয়ে যায়। পাকবাহিনীর এক সুবেদার ১৪/১৫ জন সঙ্গী নিয়ে মুহূর্তে নিচে নেমে পজিশন নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। বাকিরা লঞ্চ থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এই অবস্থায় খবর পেয়ে হলদিয়া থেকে ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন ও শিমুলিয়া থেকে ইকবাল হোসেন তাদের বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। যৌথভাবে দীর্ঘ সময়য় যুদ্ধের পর পাক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে আমরা সক্ষম হই। ওদের ৫০/৬০ জনকে ধরা হয়। লোকজন দিনভর ওদের দেখে। রাতে হত্যা করে পদ্মায় ফেলে দেয়া হয়। পরে সেনাবাহিনীর সর্বশেষ সদস্যটি নিহত হবার মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে প্রায় ৩৪ ঘন্টার এক ভয়াবহ যুদ্ধের। গোয়ালিনীমান্দ্রার এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে একাত্তরে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকা লিখেছে- গত ২৬শে অক্টোবর শত্রু সৈন্যবাহিনীর দুটি স্পীডবোট শ্রীনগর থেকে লৌহজং অভিমুখে যাত্রা করলে আমাদের বীর গেরিলারা পথিমধ্যে গোয়ালিনীমান্দ্রা বাজারের নিকট এক প্রবল আক্রমণ চালিয়ে ৩৬ জন হানাদার সেনাকে নিহত এবং ৮ জনকে বন্দী করে। নিহতদের মধ্যে সুবেদার কোরবান আলী এবং লেন্স নায়েক মোনসের খানও রয়েছে। এ সংঘর্ষে দুটি হালকা মেশিনগান ও ৩৪টি রাইফেলসহ বেশ কিছু গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।
[৮৮], [১৮৭] হাসিনা আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!