গৌরীনগর অপারেশন, সিলেট
সিলেটের গৌরীনগর অপারেশনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গ্রামটি সিলেট শহর থেকে বার মাইল, সালুটিকর বিমান বন্দর থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে। সেখানে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানির অবস্থান ছিল এবং শত্রুদের ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার ছিল সালুটিকর বিমানবন্দরে। এখান আঘাত হানা ও মোকাবেলার জন্যে গৌরীনগর অবস্থান নেয়া উভয় পক্ষের জন্যেই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৮ অক্টোবর গৌরীনগরে অভিযান শুরু হয়। দু’শ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাতের অন্ধকারে গৌরীনগর শত্রুর অবস্থান আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু আধ মাইল কাচে যাবার সাথে সাথে তাদের উপর হঠাৎ শত্রুর আক্রমণ শুরু হয়। এতে তারা হতবাক হয়ে পড়েন। তুমুল গুলিবর্ষণের ভিতর তারা যে যেখানে পারে অবস্থান নেন এবং শত্রুর সঙ্গে পাল্টা গুলিবিনিময় শুরু করেন। সে সঙ্গে সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে আরো মুক্তিযোদ্ধা পাঠানোর জন্যে জরুরি ওয়ারলেস ম্যাসেজ পাঠান। ওই নতুন দলকে তাদের নতুন অবস্থান নেওয়ার জন্য খবর পাঠানো হল তখন রাত প্রায় তিনটা। সারা রাত গুলিবিনিময় চলে। কিন্তু অন্ধকারে কেউ কাউকে কাবু করতে পারছিল না। এভাবে ভোর হয়ে গেল। ভোরের আলোতে দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দশ বার জন ছাড়া কারো সংবাদ নেই। তাদের অবস্থান তখন খোলা মাঠের মাঝখানে। সনে সঙ্গে বর্ণী গ্রাম অবস্থানরত নতুন দলকে মেজর তাহের উদ্দিন আখাঞ্জি খবর পাঠালেন, অতি দ্রুত গৌরীনগরে সেতুর পিছন থেকে আক্রমণ করার জন্য, অন্যথায় দিনের আলোতে তাদের তারা মেরে ফেলবে। তিনি এদিকে দশ/বার জনের মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে শত্রুবাহিনীর সাথে টুক টাক গুলিবিনিময় চালিয়ে গেলেন, যাতে শত্রু পক্ষের দৃষ্টি তাদের দিকেই নিবন্ধ থাকে। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচজন। তিনি তখন তাদের নিয়ে কাছাকাছি একটি বিলের কচুরিপানা আড়ালে আশ্রয় নেন। বেলা তখন তিনটা। তাদের দিক থেকে কোন প্রকার গুলির শব্দ না পেয়ে পাকসেনারা উল্লাসভরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে কেউ জীবিত আছে কিনা তাঁর সন্ধান করতে। তাদের সৌভাগ্য যে, শত্রুরা তাদের দেখতে পায়নি। এদিকে গৌরীনগরে পৌঁছতে নতুন দলটি প্রায় সারাদিন লেগে গেল। সন্ধ্যার দিকে তারা গৌরীনগরে শত্রুর অবস্থানের উপর পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণে পাক বাহিনী হতভম্ব হয়ে যায়। গৌরীনগরে যখন নতুন দলের আক্রমণ চলছিল তখন মেজর তাহের উদ্দিন আখঞ্জ এবং তার সাথে চার পাঁচজন দ্রুত উক্ত স্থান ত্যাগ করেন এবং নতুন দলের সাথে যোগ দেবার জন্য রওয়ানা হন। কিন্তু পথে বিলাজুর গ্রামে পৌঁছে দেখেন তাদের গত রাতের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলের আশিজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের দেখে তারা নতুন করে সাহস ও শক্তি পেলেন। তাড়াতাড়ি তাদের সংগঠিত করে গৌরীনগরের পিছনের দিক দলের সাথে যোগদান না করে বর্নীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। বর্নীতে অবস্থানরত পঞ্চাশজন পাক সেনার মধ্যে এগারজন এই অতর্কিত হামলায় নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। দুইদিন যুদ্ধ চলার পর গৌরীনগর ও বর্নী উভয় গ্রাম তাদের দখলে আসে। কিন্তু গৌরীনগরের পরদিন সালুটিকর থেকে শত্রুবাহিনীর সাহায্যকারী দলের প্রচণ্ড আর্টিলারী সেলিং এর জন্য টিকে থাকতে না পেরে সকলে বর্নীতে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। এই যুদ্ধে এগারজন পাকসেনা নিহত ও প্রচুর আহত হয়। দু’জন ধরা পড়েছিল। তাছাড়া চারটি বড় নৌকা বোঝাই এলএমজি, এসএমজি, ওয়ারলেস সেট, গোলাবারুদ ও রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এসব মালামালসহ নৌকা চারটি ছেঙ্গের খান নদী পথে গৌরীনগরের পাকসেনাদের জন্য সিলেট থেকে পাঠানো হয়েছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধদের পক্ষে হতাহত হয়েছিলেন পনেরজন।
[৫৫] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত