You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঘাটনা রেলসেতুর যুদ্ধ, সিরাজগঞ্জ

একাত্তরের ২৪ এপ্রিল তখন সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। সকালে সিরাজগঞ্জের সাবেক এস.ডি.ও শামসুদ্দিন আহমেদ ও তদানীন্তন উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের পরিচালক আবদুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঘাটানি রেলসেতুতে আসেন। সিরাজগঞ্জ থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথের করতোয়া নদীর ওপর অবস্থিত ঘাটিনা রেলসেতুর কয়েকটি রেললাইন তারা খুলে ফেলেন। ঈশ্বরদীর সঙ্গে সিরাজগঞ্জের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া ছিল এ অভিযানের লক্ষ্য। কারণ ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর ২১ এপ্রিল পাকবাহিনী সড়কপথে সিরাজগঞ্জ ঢুকতে প্রথমেই বাধা পায় শাহাজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি ঘাটে। বড়াল নদীর এ ঘাটে তখন সেতু ছিল না। স্থানীয় লোকজন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর ঢুকে পড়ার খবর পেয়ে ঘাট থেকে নৌকা-ডিঙ্গি সব সরিয়ে ফেলেছিল আগেই। পাকবাহিনী নদীর পূর্বপাড়ে এসে আটকে যায়। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এম.পি.এ এডভোকেট গোলাম হাসনায়েনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাড়ে সংঘঠিত হয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় পাকসেনারা দু’তিনদিন নদী পার হতে ব্যর্থ হয়। ফলে এই বাহিনীর একটি গ্রুপ রুট পরিবর্তন করে ওখান থেকে পাবনা হয়ে ঈশ্বরদী রেলস্টেশন থেকে ট্রেনযোগে সিরাজগঞ্জে ঢোকার পরিকল্পনা নেয়। এই গোপন খবরটি ২৩ এপ্রিল গভীর রাতে সিরাজগঞ্জের পৌঁছুলে সেখান থেকে প্রায় ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা পায়ে হেঁটে ২২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পরদিন সকালে উল্লাপাড়া থানার ঘাটিনা রেলসেতুর পাশে শাহজাহানপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেন। এ সময় শামসুদ্দিন আহমেদ ও লতিফ মির্জা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের তৎকালীন জি এস আবদুস সামাদ ও সাবেক পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার লুৎফর রহমান অরুণ। ঐ দিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল বেশ ক’টি ৩০৩ রাইলফেল ও একটি এল.এম.জি। সকাল থেকে ঘাটিনা সেতুর রেল অপসারণ, শাহজাহানপুর গ্রামের সীমানায় বাঙ্কার খননসহ প্রতিরোধ কার্যক্রম পার্শ্ববর্তী চরঘাটিনা, ঘাঁটিনা, মাটিকোড়া, লক্ষ্মীপুর, কানসোনা, সলপ, রামগাতি শাহজাহানপুর গ্রামের শত শত উৎসাহী যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে। এস.ডি.ও. শামসুদ্দিন আহমেদ ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লতিফ মির্জা বেলা ১২টার দিকে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীদের ডেকে যে কোনো বিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। বেলা ৩টায় শতাধিক পাকসেনা বহনকারী একটি ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে এসে দাঁড়ায় ঘাটিনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে। রেলপথে মাইন বসানো থাকতে আরে সন্দেহে ইঞ্জিনের সামনে জুড়ে দেয়া হয়েছিলি দুটি মালবগি। সেতুতে কয়েকটী রেল খুলে না ফেললে হয়তো ট্রেনটির পথে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন হতো না। ট্রেন থেমে যাওয়ার পর ১০/১২ জন পাকসেনা সেতুর অবস্থা দেখার জন্য যখন নিচে নেমে আসে, ঠিক তখনই নদীর অপর পাড় থেকে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারগুলো গর্জে উঠে একযোগে। আচমকা গুলিতে হতচিকত হয়ে পড়ে শত্রুবাহিনী। সুযোগ-প্রত্যাশী মুক্তিবাহিনী গুলিতে নিহত হয় ৫ জন পাকসেনা; কিন্তু এর কয়েক মিনিট পরেই শুরু হয় পাল্টা গুলি। ভারি অস্ত্র থেকে গুলি চললো বৃষ্টির মতো। ফলে শুরু হ ভয়াবহ যুদ্ধ। ভয়ে, আতংকে ঘাটিনা রেলসেতুর পার্শ্ববর্তী হাজার হাজার লোক গ্রাম ছেড়ে গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া, পোটালা, পেটারা নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যায় বেল্কুচি থানার দিকে। বুড়োবুড়ি ও শিশু অসহায় নারী-পুরুষের আহাজারি। গুলিতে আহত হয় ৮/১০টি শিশু। কারো পায়ে, কারো হাতে গুলি লেগেছে। রক্ত ঝরছে ক্ষত স্থান থেকে তবুও প্রাণ বাঁচানোর কি কঠিন প্রায়াস। চিৎকার করে ছুটছে তারা। বুড়োরা ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে। আবার উঠছে। পালাচ্ছে তারা প্রাণপণে নিরাপদ আশ্রয়ে। সন্ধ্যার আগে পাকবাহিনীর গুলি থেমে যায়। ট্রেন পিছিয়ে যায় উল্লাপাড়া স্টেশনে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ জোরদার করতে আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন; কিন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদও শেষ হয়ে যাওয়ায় তারাও থামে। রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নেয়া শাহহাজাহনপুর গ্রামটি পরিণত হলো এক ভূতুড়ে পল্লীতে। কোনো বাড়িতে জনমানবের চিহ্ন নেই। প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়েছে সবাই। রয়ে গেছে শুধু মুক্তিযোদ্ধা ক’জন। এস.ডি.ও শামসুদ্দিন আহমেদ গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য সন্ধ্যার আগেই সিরাজগঞ্জের রওনা হয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা আব্দুল লতিফ মির্জা পাকবাহিনীর পরবর্তী আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে দলে সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে। সিরাজগঞ্জ থেকে রাতেই আবার বেশ কিছু গোলাবারুদ এসে পৌঁছায়। ধারণা ছিল পরদিন সকালে পাকবাহিনী আবারও ব্যাপক সমরসজ্জা নিয়ে ঘাটিনা রেলসেতুর ওপার থেকে আক্রমণ চালাবে; কিন্ত তা হলো না। ২৫ এপ্রিল শত্রুবাহিনী উল্লাপাড়া রেলস্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পারাদহ বাজারে ৬ ইঞ্চি মর্টার বসিয়ে সেলিং শুরু করল মুক্তিযোদ্ধাদের শাহজাহানপুর গ্রামের অবস্থানের ওপর। বৃষ্টির মতো সেল এসে পড়তে শুরু করল তাদের বাঙ্কারে, আশপাশের বাড়িতে, গাছে। প্রায় ৬ মাইল দূর থেকে এই সেলিং করা হয়। হালকা অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পড়লেন মহাবিপদে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এদিনই পাকবাহিনী রেলসেতুতে নতুন রেল বসিয়ে ট্রেন পাড় করলো এপারে। এরপরহ শুরু হলো তাদের তাণ্ডবলালা। রেলপথের পার্শ্ববর্তী শাহজাহনপুর, কর্মকারপাড়া, মাটিকোড়া, বেতাকান্দি, লক্ষ্মীপুর-এ সমস্ত গ্রাম পুরিয়ে দেয়া হলো। চালানো হলো লুটপাট। একইভাবে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত পথের দু’ধারের গ্রামগুলো তারা জ্বালিয়ে দিল। হত্যা করল শতাধিক লোক। সিরাজগঞ্জ শহরে পৌছেও তারা শুরু করলো ভয়াবহ ধংসযোজ্ঞ। প্রাণভয়ে, ইজ্জত বাঁচাতে শহরের লোক ছুটলো প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে/ এদিকে পাবনার ডাব্বাগানের প্রতিরোধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন পিছিয়ে এসে শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি ঘাটে অবস্থান নেয়ে সে সময়য় উল্লাপাড়ার সংগ্রাম পরিষদ নেতা গোলাম হাসনায়েন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ জিপে করে হিলি সীমান্ত পথে ভারতে যেতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। এরপর তিনি দীর্ঘদিন ভারতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অপরদিকে ২৫ এপ্রিলের পর থেকেই উল্লাপাড়া বিভিন্ন অঞ্চল ক্রমান্বয়ে পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। থানা সদরে হামিদা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প তৈরি করে শুরু করল ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। ঘাটিনা রেলসেতুর যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর নারকীয় কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াই তখন এ অঞ্চলের যুব সম্প্রাদায়কে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের প্রেরণা যুগিয়েছিল। শত শত যুবক উল্লাপাড়া থেকে প্রায় ৪০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে কাজিপুর থানার শুভগাছা যায়। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে নৌকাযোগে যমুনা নদীপথে পালিয়ে যায় ভারতের মাইনকারচর। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এরপর এদেরকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় বিভিন্ন ক্যাম্পে। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা দেশের ভেতরে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে আত্ননিয়োগ করে। যারা ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিল তারা জুলাই মাসের প্রথমদিকে বিভিন্ন পথে দেশে ফিরে বিচ্ছিন্নভাবে অথবা দেশে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়। এ সময়য় থানার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলোতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন শিবির।
[১২] কল্যাণ ভৌমিক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!