You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.04 | গোয়াইনঘাটের যুদ্ধ, সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

গোয়াইনঘাটের যুদ্ধ, সিলেট

ভারতীয় সীমান্ত থেকে গোয়াইনঘাটের দূরত্ব দক্ষিণে ১০ কি. মি.। সিলেটের উত্তরে অবস্থিত গোয়াইনঘাটের থানা সদর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান বাহিনী শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল। ২৪ অক্টোবর লেফটেন্যান্ট নূরন্নবীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা (৩য় ইস্ট বেঙ্গল, গণবাহিনী) পাকিস্তান বাহিনীর অপর একটি ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ৪ নভেম্বর ওই মুক্তিযোদ্ধারাই মিত্রবাহিনীর সহায়তা ছাড়া গোয়াইনঘাট দখল করতে সমর্থ হয়। গোয়াইনঘাটের যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর প্রয়োগকৃত রণকৌশল, নিপঞ্চতা ও সাহস সেক্টরের অন্যান্য যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়। ৩/৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দল নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিতে থাকে। আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয় ৪ ডিসেম্বর ভোর ঠিক সাড়ে চারটায়। লেফটেন্যান্ট ইয়ামিনের গণবাহিনী কোম্পানি ও ৩ ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামনের লেংগুরা গ্রামের দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। কয়েক মূহূর্তের ব্যবধানে উত্তর-পুর্ব দিক থেকে একইভাবে চিৎকার করে সুবেদার মোশাররফের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসেন। আরো পূর্ব দিকের লেফটেন্যান্ট মতিউর-এর অবস্থান থেকেও প্রচণ্ড গুলিগোলার আওয়াজ আস্তে থাকে। এলাকাটি মূহূর্তের মধ্যেই একটি ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিকল্পনা অনুসারে ৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত তিনটার পর মুক্তিবাহিনী তাদের নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করে। সেই রাত ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা। লেফটেন্যান্ট নবী রাত চারটার মধ্যে সকল কোম্পানির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নদীর পশ্চিম পাড়ে একটি গাছের আড়ালে অবস্থান নেন। রাত সাড়ে চারটায় দক্ষিণ প্রান্ত থেকে সিগন্যাল পিস্তলের সবুজ সঙ্কেতের সাথে সাথে আক্রমণ শুরু হয়। শ্ত্রুও পাল্টা ফায়ার শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুর ভারী অশ্ত্র, মর্টার, এমজি ইত্যাদি মুক্তিবাহিনীর রিকোয়েললেস রাইফেলের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে শত্রুর ফায়ার পাওয়ায় প্রায় অর্ধেক কমে যায়। লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী সংকেত দিয়ে ডি কোম্পানিকে নদী অতিক্রম করে আক্রমণের নির্দেশ দেন। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ২০টি নৌকায় কোনো বাধা ছাড়াই ডি কোম্পানি নদী পার হয়ে শত্রুর অবস্থানে পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে আধার ফিকে হয়ে আসে, শত্রুর গোলাগুলির পরিমাণও কমে আসে। ভোর পৌনে ছ’টায় হঠাৎ করে শত্রুর গুলির দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শত্রু তখন সারিবদ্ধ হয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পশ্চাৎপসরন করছিল। মুক্তিবাহিনী ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে পলায়নরত শত্রুর ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ডি কোম্পানি সাফল্যের সাথে শত্রুর অবস্থান দখল করে নেয়। শত্রু রণেভেঙ্গ দিয়ে পলায়ন করে। মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও বিরত্বের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে শত্রুর সকল প্রতিরোধ। পড়ে দলে দলে অসংখ্য রাজাকারও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণ করে। ৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় গোয়াইনঘাট মুক্ত হয়। যুদ্ধের ফলাফল গোয়াইনঘাট ছিল পাকিস্তানীদের ডাউকি-তামাবিল সীমান্তের সর্বশেষ শক্ত অবস্থান (Strong point)। এর পরপরই ছিল সিলেট শহর এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো। সুরমা নদীর তীর হয়ে পায়ে হাটা পথে গোয়ানঘাট থেকে সালুটিকর ফেরিঘাট ও বিমানঘাটি এলাকার দূরত্ব ছিল মাত্যর ৭ থেকে ৮ কি.মি.। কাজেই সামরিক দিক থেকে গোয়াইনঘাটের গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। গোয়াইনঘাট হাতছাড়া হয়ে যাবার পর পাকিস্তানীদের সিলেট শহরের আশপাশের পাহাড়্গুলোতে অবস্থান নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। আর কার্যত হলোও তাই। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে গোয়াইনঘাট দখলের পর সরাসরি সিলেট শহরের অপারেশন পরিচালনা সহজতর হয়ে যায়। সিলেটের মুক্তি মাত্র সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। শত্রুর ওপর শেষ আঘাত হানার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা উদগ্রীব হয়ে ওঠে । ওদের সাহস ও উদ্যম লক্ষগুণে বেড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর সামনে আর কোনো বাধাই তখন থাকল না। ওদিকে পাকিস্তানীদের মনোবল ভেঙে পড়ল। তাদের সীমান্তবর্তী প্রতিটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। শক্তিশালী অবস্থানগুলো হাতছাড়া হয়ে পড়লে এঁদের পশ্চাৎপসরন ছাড়া কোনো বিকল্প থাকল না। উপসঙ্ঘারে গোয়ানঘাট যুদ্ধটি ৩ ইস্ট বেঙ্গল গণবাহিনী ও স্থানীয় গণবাহিনী যোদ্ধাদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। ২৫ অক্টোবর পরিচালিত গোয়াইনঘাটের ওপর প্রথম যুদ্ধে বিপর্যয় ঘটলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ৪ ডিসেম্বর গোয়াইনঘাট দখলের মাধ্যমে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। মিত্রবাহিনীর সাহায্য ছাড়াই পরিচলিত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিরত্ব ও সাহসের পরিচয় দেন। লেফটেন্যান্ট নবী, লেফটেন্যান্ট ইয়ামীন, লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর, সুবেদার মোশাররফ ও সুবেদারবদির নেতৃত্বাধীন এই যুদ্ধ সিলেটের রণাঙ্গনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। গোয়াইনঘাট পতনের পর মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চলের মূল ঘাঁটি সিলেটের দিকে উচ্চ মনোবল ও অনুপ্রেরণা নিয়ে অভিযান শুরু করে। গোয়াইনঘাট দখলের পর মিত্রবাহিনীর কাছে মুক্তিবাহিনীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
[৫৫] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত