You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.14 | গোপালগঞ্জপূর্ণ যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

গোপালগঞ্জপূর্ণ যুদ্ধ

গোপালগঞ্জ মুক্ত হওয়ার আগে এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয় পাকবাহিনীর সাথে। ৩ জন কোটলীপাড়া মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে পাকবাহিনী আরও বড় দলসহ ৭ জুন তাদের রাজাপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে বসে। পাকবাহিনীর সঙ্গে ছিল ৩টি লঞ্চভর্তি সৈন্য ও অস্ত্রসস্ত্র। হেমায়েতসহ তাঁর বাহিনীর সদস্যরা লঞ্চটিকে পেছন থেকে আক্রমণ করেন। অন্যদিকে ঘাঁটির বাঙ্কার থেকে সামনের দিকে গোলাবর্ষণ শুরু হয় হেমায়েত বাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী লঞ্চগুলো নিয়ে শাতলা গ্রামের বাঁক ধরে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় জনগণ বিপুল উৎসাহ লাভ করে। তারা হেমায়েত বাহিনীর এ দলটিকে কাঁধে তুলে পয়সার হাট পর্যন্ত নিয়ে আসে। সেখানে এক জনসভায় হেমায়েতকে জনগণ ‘মেজর’ খেতাবে ভূষিত করে। এ যুদ্ধের ফলে প্রায় ২০ মাইল এলাকা মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। এসময় শাতলা নদীর বাঁকে একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও স্থাপিত হয় মুক্তিযোদ্ধাএর। এরপর তারা রাজাপুর থেকে সরে গিয়ে জহরের কান্দি হাই স্কুলে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলে। দলে দলে যুবক-ছাত্র-জনতা এই প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। এদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি। কালকিনি থানার চলবল গ্রাম থেকে অপারেশন ঘাঁটি সরিয়ে নেয়া হয়। ১৪ জুন পাকবাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট এই তিনদিক দিয়ে চলবল ঘাঁটির ওপর হামলা চালায় এবং ক্যাম্পের নিকটবর্তী রামশীল গ্রামে ঢুকে পড়ে। এ অভিযানে অংশ নেয় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রায় ২শ’ সদস্য। তারা এ গ্রামের ভেতর দিয়ে গৌরনদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হতেই হেমায়েত বাহিনীর সদস্যরা বান্দাবাড়ি খালের কাছে তাদের মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। উভয়পক্ষের মধ্যে এখানে তুমুল গোলাগুলি বিনিময় হয়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে। এ যুদ্ধে মুকিতযোদ্ধা মকবুল শহীদ হন এবং হেমায়েত আহত হন। শত্রুপক্ষের ৫ জনের লাশ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় ১৮ জন শত্রুসৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এই সাথে মুক্তিবাহিনীর ৫টি রাইফেল ও বেশকিছু বুলেট উদ্ধার করে। এ যুদ্ধের পর হেমায়েত বাহিনীর ঘাঁটি কোদালধোয়া গ্রামে সরিয়ে নেয়া হয়।
১৬ জুন পাকবাহিনী চারটি স্পিডবোটে করে কোদালধোয়া গ্রাম আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করে। দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী শত্রুদের পয়সারহাট থেকে আট মাইল দূরে তাড়িয়ে দেয়। এ যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর বড় ধরনের যুদ্ধ হয় ১৪ অক্টোবর তারিখে।
ঐদিন রাজাপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। ১৩ অক্টোবর রাতে পাকসেনারা ৬টি লঞ্চে করে রাজাপুরে আসে। ৩টি লঞ্চ রাজাপুরের দু’মাইল দক্ষিণে লাম্মরহাটে। তারা দু’দিক থেকে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। এসময় পাহারারত মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে ছিল। যুদ্ধে নেতৃত্বে দেন হেমায়েত ও তাঁর সহকারী কমলেশ বেদজ্ঞ। মুক্তিযোদ্ধারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেন। সারাদিন যুদ্ধ চলে এবং সন্ধ্যা ৭টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয় এবং যুদ্ধে ইব্রাহিম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হেমায়েত গালে এবং চোয়ালে গুলিবিদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনী ১০ জন আহত হয়। খানসেনারা সন্ধ্যার দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে যায়।

এ অঞ্চলের সব থেকে বীরত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ যুদ্ধ হয় ৬ নভেম্বর তারিখে। কাশিয়ানি থানার ভাটিয়াপাড়া অয়ারলেস কেন্দ্রের পাকবাহিনীর ক্যাম্পের দখল নিয়ে শুরু হয় এই যুদ্ধ। হেমায়েত এবং “ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামার যৌথ নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি পধান ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। একটি নেতৃত্বে দেন হেমায়েত। এ দলে ৫০ জন যোদ্ধা ছিল। অন্য দলটি ভাটিয়াপাড়ার পশ্চিম তীরে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ইসমত কাদির গামা ৫৫ জনের দল নিয়ে পিপাইল গ্রামের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশে অবস্থান নেন। পূর্ব্দিকে কমান্ডার সাহাবুদ্দিন ৩৫ সদস্যের একটি দল নিয়ে পিপাইল গ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশে অবস্থান নেন। পূর্বদিকে কমান্ডার সাহাবুদ্দিন ৩৫ সদস্যের একটি দল নিয়ে বাসরতের খাল পার হয়ে অগ্রসর হন। ভোর ৫টায় তিনদিক থেকে একযোগে আক্রমণভিযান শুরু হয়। একটানা ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য বিমান থেকেও এখানে গুলিবর্ষণ করা হয়। তা সত্ত্বেও অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নি। যুদ্ধে হেরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। ২৫ জন পাকসেনা এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং আহত হয় ৩০ জন। আহতদের সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এই যুদ্ধে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুসহ ইয়াসিন শহীদ হন। তবে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনী অয়ারলেস কেন্দ্র এবং তাদের ক্যাম্প দখল করে নেয়। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী ২টি মর্টার, ৭টি এলএমজি, ১০টি এসএলআর এবং ১১০টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ গুলি উদ্ধার করে।
গোপালগঞ্জের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ফুকরার যুদ্ধ। ফকরার ভেতর দিয়েই নদীপথে কাশিয়ানী ও ভাটিয়াপাড়াস গোপালগঞ্জ উত্তর এলাকার যোগসূত্র ছিল এ পথে পাকবাহিনী প্রায়ই লঞ্চযোগে টহল দিত। অক্টোবরের শেষ নাগাদ ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্ব পাকবাহিনীর দুটি টহল লঞ্চে আক্রমণ করা হয়। ৬ ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে ফুকরার রবিউল, বাহিরবাগের ইমামউদ্দিনসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রায় ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন
অপর গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধও অক্টোবরেই হয়। এ যুদ্ধের নাম কলাবাড়ি গ্রামের যুদ্ধ। হেমায়েত বাহিনী পাকবাহিনীর খাদ্য সরবারাহের একটি কার্গো ছিনিয়ে নিয়ে তা কোটালীপড়া থানার কলাবাড়ি গ্রামে নিয়ে আসে। এ খবর পাকবাহিনীর কাছে পৌছুলে বিপুলসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পাকবাহিনী কলাবাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয় ৪ ঘণ্টা। তবে এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকে। বন্যা প্লাবিত নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার চালিয়ে একই দিন পাকবাহিনী এখানাকার ২৮০ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
[৬] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত