গোপীনাথপুরের অ্যামবুশ,ব্রাক্ষণবাড়িয়া
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ-প্রস্তুতি কাজে ব্যস্ত। অপর দিকে পাক-বাহিনী ব্রাক্ষণবাড়িয়ার শাহপুরের প্রাক্তন রাজস্ব মন্ত্রী (১৯৪৮-১৯৫৪) তফাজ্জল আলী (টি আলী)-এর বাড়ি, লেশিয়ারা, উজানিশার ও গঙ্গাসাগরে ক্যাম্প স্থাপন করে এলাকার লোকজনের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন আরম্ভ করে। প্রস্তুতিরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট যখন খবর আসে যে, পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য (১৫০-১৫৬ জন) ও রাজাকারসহ প্রায় ২০০ জনের এক বাহিনী প্রতিদিন সকাল ৭টার সময়য় টি.আলীর বাড়ি হতে বের করে কসবা রেল স্টেশনের উপরে এসে ফিস ফায়ার করতে করতে আনন্দ করে এবং গঙ্গাসাগরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে উল্লাস করে। আবার দুপুর ১২টার সময় তারা একই রাস্তা দিয়ে টি. আলী বাড়িতে ফিরে আসে। এই খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্দারা পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হানাদার বাহিনী ভাবতে পারেনি যে, এই রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করতে পারে। তাই একই রাস্তা দিয়ে একই সময়ে তারা নিত্য আসা-যাওয়া অব্যাহত রাখে। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এই সংবাদের ভিত্তিতে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনি এই রাস্তায় অ্যামবুশ করার জন্য সুবেদার আবদুল আওয়ালের নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি বাহিনী গঠন করেন। তাদের মধ্যে একজন হাবিলদার, দুইজন নায়েক, একজন ল্যান্স নায়েক আর বাকি সবাই ছিল সাধারণ সৈন্য। এই বাহিনীর নেতা হিসাবে সুবেদার আবদুল আওয়ালকে নির্ধারন করা হয়, কারণ, এই এলাকার অধিবাসী হিসাবে আবদুল আওয়ালই সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি, পথঘাট তাঁর সম্পূর্ণ চেনা। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সুবেদার আবদুল আওয়ালকে অ্যামবুশ করার পূর্বে অ্যামবুশ তুলে নেবার রাস্তা পরিস্কারভাবে দেখে নেওয়ার পরামর্শ দেন। যেন কোন বিপদ এলে সাথে সাথে তা এড়ানোর সম্ভব হয়। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ক্ষতি না হয়। সুবেদার আবদুল আওয়াল সেই অনুসারে বাহিনীকে চার গ্রুপে ভাগ করে। এরপর চারটি গ্রুপের অবস্থান নির্দেশ করে দেওয়া হয়। যেমন নেমতাবাদ গ্রামের পূর্ব পার্শ্বে একটি গ্রুপ অবস্থান করে। বাকি তিনটি গ্রুপ অবস্থান করে গোপীনাথপুর গ্রামের পশ্চিমে একটি খালের মধ্যে। তবে সবার প্রতিই নির্দেশ ছিল যে, সুবেদার আবদুল আওয়াল আগে ফায়ার করবেন, পড়ে অন্যরা করবে এবং প্রথম ফায়রের ১৫ মিনিটের মধ্যে যদি সুবেদার আবদুল আওয়াল না আসে তাহলে হবিলদারের নির্দেশে কাজ করতে হবে। সেই নির্দেশমত যার যার অবস্থানে যাওয়ার কয়েকমিনিটের মধ্যেই দক্ষিণ দিকের ব্রাক্ষনগাও গ্রাম থেকে ২ট গুলির শব্দ ভেসে আসে। তখন সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলা হয়। ঠিক পাঁচ মিনিট পরই দেখা যায়, পাকবাহিনী ব্রাক্ষণগাঁও রেলওয়ের ব্রিজ পার হয়ে রেল লাইনের ওপর দিয়ে আনন্দ করে এগিয়ে আসছে। পাকবাহিনীর প্রথম লোকটি সুবেদার আব্দুল আওয়ালের পজিশনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফায়ার করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অপর অবস্থান থেকে ফায়ার শুরু হয়। অপ্রস্তুত পাকবাহিনীর প্রথম সারির প্রায় সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর যারা জীবিত ছিল এলোমেলো হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ছুটাছুটি করতে থাকে। এই আক্রমণে পাকবারহিনীর প্রায় ৮৫ জন নিহত হয়। আক্রমণের ১৫ মিনিটের মধ্যেই সুবেদার আব্দুল আওয়াল তাঁর কোম্পানির সঙ্গে মিলিত হন। তিনি তাঁর লোকদেরকে বলেন যে, তোমরা সবাই প্রস্তুত থাক; আমাদের উপর প্রতিআক্রমণ বা কাউন্টার অ্যাটাক আস্তে পারে। মূহূর্ত মধ্যেই লেশিয়ারা থেকে একটি আর্টিলারী গলা এবং উজানিসার ব্রিজের দিক থগেকে আরেকটা গোলা এসে মুক্তিবাহিনীর পেছনের দিকে পড়ে। সুবেদার আব্দুল আওয়াল তাঁর লোকদেরকে বলেন যে, তোমরা ভয় পেয়ো না। এটাই প্রতিআক্রমণের পূর্ব লক্ষণ। তবে আর্টিলারির গোলা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারন আমরা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বা সেফটি মারজিন-এ পড়েছি। কিছুক্ষণ পর খবর আসে যে, টি. আলীর বাড়ি থেকে এক কোম্পানি পাকসেনা ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামে পৌঁছেছে। এই কথা শুনে সুবেদার আব্দুল আওয়াল রেল লাইনের পশ্চিম পাশে পজিশন গ্রহণ করে। যে পাকসেনারা রেল লাইনের পশ্চিম পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে না আস্তে পারে এবং সেই সাথে ব্রিজ পার হতে না পারে। বেলা ১১ টার দিকে খবর আসে যে, সৈয়াদাবারের মোড় থেকে এক কোম্পানি পাকসেনা নেমতাবাদের দিকে যাচ্ছে। পাশে দেবীপুর ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর মর্টার প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার শামসুল হক এই সংবাদ শুনতে পান। তখন তিনি সুবেদার আওয়ালকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন এবং মর্টার প্লাটুন নিয়ে লাতুয়ামুড়ায় পৌঁছেন। তখন তিনি দুরবিন দিয়ে দেখতে পান যে, দক্ষিণ নেমতাবাদের ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে ফায়ার করতে করতে রেল লাইনের দিকে এগিয়ে আসছে পাকসেনার দল। তিনি ছয়টি ৩ ইঞ্চি মর্টার গান দিয়ে ফায়ার করেন। কিন্ত পাকসেনারা তখন পাল্টা গুলি ছুঁড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী টিকতে না পেরে পেছনের দিকে সরে বিজনা নদীর পাড়ে অবস্থান নেয় এবং ফায়ার করতের থাকে। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ২৫ জন মারা যায় এবং ৩৫ জন আহত হয়। শামসুল হক সেখানে প্রায় ১ ঘন্টা ছিলেন। এরপরই তিনি পাকবাহিনীর আর্টিলারির টার্গেট পড়েন। তখন তিনি দেবীপুর চলে যান। দুপুর ১২ টার দিকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণগাঁও থেকে নদী পার হয়ে রেল লাইনের পশ্চিম পাশ দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে/ কিন্তু সুবেদার আব্দুল আওয়ালের এল. এম. জির ফায়ারের কারণে সামনের দিকে এগুতে পারে নি। বিকাল চারটার দিকে উত্তরে গঙ্গাসাগর ও দক্ষিণে কসবা থেকে মুক্তিবাহিনীকে পাকবাহিনী আক্রমণ করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। সুবেদার আব্দুল আওয়াল অবস্থা বেগতিক দেখে তাঁর লোকদেরকে নিয়ে পজিশন তুলে বাড়াই গ্রাম দিয়ে গোপীনাথপুর চলে যান। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর শতাধিক সেনা মারা যায় এবং আহত হয় প্রায় আশিজনের মত। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের মতে ২০০ জন পাল সেনার মধ্যে ১০/১২ জন মাত্র জীবিত ছিল। এই যুদ্ধে ২০০ জন পাকসেনার সঙ্গে মাত্র ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা লড়াই করে জয়ী হয় এবং কোন যোদ্ধাকেই হারতে হয় নি। বিশেষ করে এই যুদ্ধ ছিল ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম যুদ্ধ, যা আগরতলা থেকে পরিচালনা করা হয় এবং এই যুদ্ধের বীরত্বের প্রতীকস্বরূপ সুবেদার আব্দুল আওয়ালকে “বীর প্রতীক” খেতাবে ভূষিত করা হয়।
মোঃ আবু মুসা
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত