You dont have javascript enabled! Please enable it!

গোড়ান সাটিয়াচরার যুদ্ধ, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে বাশাইল থানা অবস্থিত। বাশাইল থানার দক্ষিণে মির্জাপুর থানা। ঢাকা থেকে সড়ক পথ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি টাঙ্গাইল শহর হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গিয়েছে। অপরটি ভালুকা হয়ে ময়মনসিংহ পৌঁছেছে। দ্বিতীয় সড়কটি যুদ্ধকালীন সময়ে ছিল না। জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টাঙ্গাইলের পথে প্রায় মাঝামাঝি স্থানে মির্জাপুর থানা। এখান থেকে ৫/৬ কি.মি (টাঙ্গাইলের দিকে) ধল্লা। আরো ২ কি.মি. দূরে রাস্তার দু ধারের দুই গ্রাম; গোড়ান, সাটিয়াচরা। তারপর সড়কটি পাকুল্লা, জামুর্কি গ্রাম দুইধারে রেখে নাটিয়াপাড়ার ভেতর দিয়ে টাঙ্গাইল পৌছছে।
সড়ক পথে ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক পথ। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক বাসাইল থানার নাটিয়াপড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছে। এ সড়ক সংযুক্ত ছিল ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী রেলপথের সাথে। এই রেলপথেই জগন্নাথগঞ্জ ও বাহাদুরবাদ ঘাটে ফেরীপথে পারাপারে মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষিত হতো।
২৫ মার্চের পর জয়দেবপুর রাজবাড়ি থেকে ২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট টাঙ্গাইল যায় ২৫ মার্চ। সেখান থেকে একই দিন টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে অবস্থিত এ কোম্পানিকে নিয়ে ব্যাটালিয়ানের উপ-অধিনাতক মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ ময়মনসিংহ পৌঁছান। সেখানে তিনি পূর্বে মোতায়েনকৃত সি কোম্পানিকে একত্রিত করেন। তিনি ময়মনসিংহ শহরের অদূরে খাকডহরে ইপিআর ২ উইং-এর বাঙালি সৈনিকদেরও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৮ মার্চের পর ঢাকা সেনানিবাসের উত্তরাঞ্চলে জয়দেবপুর এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ উত্তরে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত কোনো পাকিস্তানী সৈন্যের উপস্থিতি থাকে না। গোটা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় স্বাধীনতাকামী জনগণ এবং ২ ইষ্ট বেঙ্গল ও ইপিআর, পুলিশদের হাতে। ফলে রণকৌশল্গত কারণে আবাশ্যকতা দেখা দেয় পাকিস্তানীদের উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করাবার। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ রেলপথ মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংসাত্নক কার্যকলাপের ফলে ব্যবহারযোগ্য ও নিরাপদ ছিল না। অতএব, ঢাকা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পথ ছিল বিকল্পহীন। এটিই ছিল তাদের প্রধান যোগাযোগ (Line of Communication)।
প্রায় ৩০ জন ইপিআর সদস্য এবং স্থানীয় শতাধিক ছাত্র-যুবক ও জনসাধারণের সংগঠিত হয়। ইপিয়ারদের কাছে থাকা এলএমজি, এসএমজি, রাইফেল, ২ ইঞ্চি মর্টার এবং লিড়াত (Lirat –light intantry Rifle Anti-tank) ছিল। ছাত্র- যুবকদের নিকট জেলা ট্রেজারি থেকে স্থানিয়ভাবে সংগ্রহ করা কিছু রাইফেল এবং বন্দুক ছিল।
বৃহত্তর ময়ম্নসিংহের বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলোতে যথাশীঘ্র পস্থিত হয়ে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য। তারা একই সাথে জামালপুর হয়ে বাহাদুরবাদ ঘাটেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। এ দুই উদ্দেশ্যে পাকিস্তানীরা ঢাকা-টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ সড়কে অগ্রাভিযানের পরিকল্পনা করে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে অগ্রসরমান পাকিস্তানীদের প্রতিহত ও প্রতিরোধ করবার যথাযথ শিক্ষা, অশ্ত্র ও অভিজ্ঞতা কিছুই মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। আধা-সামরিক ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সদস্য হিসেবে ইপিআর সৈনিকদের সামান্য শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ছিল। এই প্রায় ৫০ জন ইপিআর সৈনিক এবং কয়েক শত ছাত্র-জনতা ও আনসার দিয়ে শত্রুকে প্রতিহত করতে তিন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী নাটিয়াপাড়ায় ইপিআর ও ছাত্র-জনতার সংমিশ্রনে একটি কোম্পানি প্রতিরক্ষা অবস্থান, প্রায় দেড় কিলোমিটার আগে গোড়ান-সাটিয়াচরায় ইপিআর ও ছাত্র-জনতা সংমিশ্রনে আর একটি কোম্পানি প্রতিরক্ষা অবস্থান এবং আরো ২ কিলোমিটার সামনে কেবলমাত্র ছাত্র ও আন্সারদের সম্ন্ব্যে ধল্লায় ২ প্লাটুনের একটি অগ্রবর্তী অবস্থান।
ছাত্র-জনতা এবং আনসারদের সমন্বয়ে ধল্লা অগ্রবর্তী অবস্থান ছিল স্বভাবতই দুর্বল। ৩ এপ্রিল ভোর ৫.৩০ মিনিটে পাকিস্তানীরা শতাধিক গাড়িতে ধল্লা অতিক্রম করে। ধল্লায় যোদ্ধারা শত্রুর বিশাল আকার দেখে ঘাবড়িয়ে যায়। তারা কোনো গুলি না করে পিছিয়ে আসে। পাকিস্তানীরা বিনা বাধায় ও নির্বিঘ্নে গোড়ান- সাটিয়াচাড়ায় এসে যায়। গোড়ান-সাটিয়াচারায় যোদ্ধারা প্রস্তুত থাকলেও প্রথমে শত্রুর বিশাল গাড়ির বহর দেখে হতবিহব্বল হয়ে যায়। মূহূর্তেই তারা নিজেদের সাম্লিয়ে নেয়। তারা শত্রুকে আরো কাছে আসার সুযোগ দেবার জন্য নির্দেশিত গুলি করা থেকে বিরত থাকে। শত্রু প্রায় ১০০-১৫০ মিটারের মধ্যে এসে গেলে নায়েব সুবেদার আদুল আজিজ প্রথম তাঁর এলএমজি থেকে ফায়ার শুরু করেন। সাথে সাথেই গর্জে ওঠে গোটা প্রতিরক্ষার সমস্ত অশ্ত্র। ৬টি এলএমজি, ৩টি রকেট লঞ্চার, ৩টি ২ ইঞ্চি মর্টার বিরামহীনভাবে গর্জন করতে থাকে।
অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে হানাদাররা প্রথম অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায়। তারা ভাবতেই পারেনি এমনভাবে আক্রান্ত হবে। আর আক্রান্ত হয়েই তারা মনে করে বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাধা দিয়েছে। মাত্র ৭০/৮০ গজ দূরে থেকে আক্রান্ত হলে সবার যা হয় এ হানাদারদেরও তাই হলো। মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলে কোনো একক যুদ্ধ একসঙ্গে এতো সৈন্য আর কোথাও হানাদারদের খোয়াতে হয়নি। পাল্টা আঘাত হানতে প্রায় তিন-চার মিনিট লেগে যায়। এর মধ্যে তাদের সৈন্য বোঝাই ১০/১২টি গাড়ি হুমড়ি খেয়ে রাস্তার নিচে উল্টে যায়। গাড়ি থেকে লাফিয়ে-পড়া সৈন্যরা রাস্তার দুইপাশে পজিশন নিতে গেলে তাদের উপর মুক্তিবাহিনী ও ইপিআররা পাখি শিকারের মতো তাক করে গুলি করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী রাস্তার দুই পাশেই পজিশন নিয়েছে। তাই হানাদারদের পক্ষে আড়াল করে যুদ্ধ করার কোনো সুযোগ ছিল না। হানাদারদের যে গোটা-পচিশটি গাড়ি মুক্তিবাহিনীর মাঝে এসে পড়েছিল, তাদের এক শতাংশ অক্ষত ছিল না।
গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় ইপিআররা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর দ্বিতীয় কোনো নজির আছে কিনা জানা নেই। ইপিআররা জানে পরোয়া করেননি, তারা মাতৃভূমির জন্য জীবন দিতেই যেন এসেছেন। এক পর্যায়ে গোড়ানের দিকের হাবিলদার আব্দুল খালেকের এলএমজি নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরু করে ফজলুর রহমান ফারুক হাবিলদার খালেকের পিছনে গিয়ে বসলেন। এলএমজি নষ্ট হয়ে গেলে হাবিলদার খালেক ফারুক সাহেবকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। ভীত-সন্ত্রস্ত ফারুক সাহেব বলেন, ‘আমরা চলে গেল আপ্নারা যাবেন কীভাবে?’ হাবিলদার খালেক একজন খাটি দেশপ্রেমিকের মতো উত্তর দেন, ‘আপনি চলে যান, আপনি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আপনার জিবনের মূল্য অনেক।
আর আপনার ট্রেনিং নেই। আপ্নারা যান, আমরা এক ব্যবস্থা করতে পারবই।।’ ফারুক সাহেব হাবিলদার খালেকের কাছ থেকে একশ গজও পিছিয়ে যেতে পারলেন না, হানাদারদের এক ঝাক্ল মেশিনগানের গুলি হাবিলদারের বুক ঝাঁঝরা করে দিল।তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ অচল এলএমজির উপর লুটিয়ে পড়ল। বাংলা-মাকে ভালোবেসে নিজের রক্ত দিয়ে তিনি স্বাধীনতাকর্মীদের প্রতি অনুপ্রেরণার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে গেলেন। শত শহীদের সাথে হাবিলদার নিজের রক্ত দিয়ে তিনি স্বাধীনতাকর্মীদের প্রতি অনুপ্রেরণায় এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে গেলেন। শত শহীদের সাথে হাবিলদার আব্দুল খালেকের নামও ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে রইল।
আক্রান্ত শত্রু আস্তে আস্তে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ সামলে নেয়। তারা রিকয়েললেস রাইফেল, মর্টার স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য চায়। সম্ভবত পাকবাহিনী অনুমান করে এ প্রতিরক্ষা ২ ইষ্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের নেয়া। হেলিকপ্টার অপর থেকে কার্যকারীভাবে মেশিনগানের অবিরাম ফায়ার করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কারগুলো একে একে গুঁড়িয়ে যেতে থাকে। হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না। নাটীয়াপাড়া থেকে টেলিফোন লাইন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। নাটিয়াপাড়ার প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে শত্রু পাকুল্লা- জামুর্কি পার হয়ে এগোতে থাকে। পেছন থেকে মর্টার অবিরাম কভারিং ফায়ার দিতে থাকে। শত্রু প্রস্তুত ও সর্তকাবস্থায় গুলির ঝড় বইয়ে এগোতে থাকে। নাটিয়াপাড়া প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভবিষ্যত ও কার্যকারিত্র সম্ভাবনা ক্ষাণ হয়ে আসে। কোনো গুলি না করেই নাটিয়াপাড়া প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করা হয় সকাল ১০ টার দিকে।
গোড়ান-সাটিয়াচরার যুদ্ধে ২৩/২৪ জন ইপিআরসহ ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শাদাত বরণ করেন। এঁদের মধ্যে ইপিআর সদস্য গফুর, হাবিলদার আব্দুল খালেক অন্যতম। এছাড়া গোড়ান, সাটিয়াচরা, পাকুল্লা, গুন্টিয়া, আছিমতলা এলাকার আরো যে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ জুমারত আলী দেওয়ান, এস এম জিল্লুর রহমান (টেপু মিয়া), সৈয়দ নুরুল রহমান (জাহাঙ্গীর), পান্না সিকদার, মোঃ নুরুদ্দিন, আবুল কাশেম (হাঁসি), মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (মানিক), আলহাজ্জ মোঃ খঃ আঃ হাকিম, মোঃ দুদু মিয়া, মোঃ লেবু মিয়া। ভিকু চৌধুরী, মোঃ আ হক মিয়া, মোঃ শাহ্‌ আলম, নঈম বক্স, দুলাল মিয়া, আবু রায়হান, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, মোঃ ইব্রাহিম মিয়া, এস এম তোফাজ্জেল হোসেন, এস এম আফজাল হোসেন, মোঃ আজমত আলী, মোঃ শরীফউদ্দিন, মোঃ নূরুল ইসলাম (লেবু), গাজী শামসুল আলম, মোঃ মজিবুর রহমান, মোঃ নাজমুল আলম, মোঃ আবুল হোসেন, মোঃ কাজিম উদ্দিন, মোঃ মান্নান, দারোগা আলী, জিয়াউর রহমান।
এছাড়া পাকিস্তানীরা গ্রামে ঢুকে সৈয়দা মেহেরুন নেছা (খুকী), মিলি চৌধুরী, নূরজাহান বেগম, করিমন নেছা, কহিনূর আক্তার, আমেনা খাতুন, মজরিন নেছা, নছরিন বেওয়া, জয়গন বেগম, লাল বানু, সুফিয়া বেগম, এসএম মোস্তাফিজুল হক (শহিন) সহ আরো প্রায় ২৫/৩০ জন নানা বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুকে বেয়োনেট খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে। এই যুদ্ধে আহতদের মধ্যে ছিল মোঃ মোশারফ হোসেন, এসএম বদরুল আলম ফারুক, এসএম জিয়াউল হুদা, নূরুল ইসলাম, দুলাল, আবুল বাসার, মোঃ জামালউদ্দিন, রমিজউদ্দিন, মোঃ ইস্তাজ আলী, গানু শিকদার, মোঃ আক্কাছ মিয়া, মোঃ লতিফ, হালিমন নেছা, ফুলমতি বেগম, মাহ্মুদা খাতুন।
পাকিস্তানীদের আনুমানিক ২০/২৫টি গাড়ি মুক্তিবাহিনীর মাঝে এসে পড়েছিল, তাদের অধিকাংশের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখানে শত্রুর প্রায় ৩০০ নিহত ও ১৫০ জন আহত হয়। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ গোলাগুলি ও অশ্ত্রশশ্ত্র ধ্বংস হয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!