গুমাই বিলে অপারেশন, রাঙ্গুনিয়া
[অংশগ্রহণকারীরা বিবরণ]
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ হতে আসা ৩৩০০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করা ছিল আরেকটি অপারেশন। খোদা বখস চৌধুরী (তখনও প্রশিক্ষনে ভারতে যায় নাই) খবর দিল যে বিদ্যুতের খাম্বাগুলিতে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে বিদ্যুতায়নের পক্রিয়া চলছে। যাতে জেউ এগুলি ক্ষতি করতে না পারে। তিনি ও মুরাদিঘোনের হাজী বাড়ি সিরাজ বেশ কয়টি বৈদ্যুতিক খাম্বা পরীক্ষা করে দেখেছেন। আমরা পরিকল্পনা করলাম সবগুলি বিদ্যুৎতায়িত হবার আগেই কয়েকটি খাম্বা ধ্বংস করতে হবে। এ বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করতে পারলে অনেক মিল কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। মিলিটারি/রাজাকার ক্যাম্প অন্ধকার হয়ে যাবে। ফলে পাকিস্তানী সরকারের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। অন্ধকারে পাক হানাদার বাহিনীর চলাচল বিঘ্নিত হবে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলে সৃষ্টি হবে সুযোগ। রাঙ্গুনিয়ার পূর্ব ও পশ্চিমে শুকনো জায়গায় প্রায় সবগুলো বৈদ্যুতিক খাম্বার গোড়ায় বিদ্যুতের তার জড়ানো হয়েছে। তাই আমরা স্থান নির্বাচন করলাম গুমাই বিলের (১০ হাজার একরের) প্রায় মধ্যখানে তাল পুকুরের পশ্চিমের খাম্বা। সকাল বেলা জেলের বেশে রেকি করার জন্য প্রেরণ করা হলো। তাঁরা রেকি করলো খাম্বার গোড়ার চারদিকে দূরত্ব কতটুক করডেক্স (প্লাস্টিক বিস্ফোরক শক্ত এক প্রকার রশি) লাগবে। প্রতিটি খাম্বার স্টিলের পুরত্ব মেপে আনলো। এ পুরুত্ব বা থিকনেস এর ওপর নির্ভর করবে কটুতুক প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ প্রয়োগ করতে হবে। রেকির রিপোর্ট প্রাপ্তির পর আমাদের বিস্ফোরকের স্বল্পতার কারণে শুধুমাত্র ৩টি খাম্বা ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। প্রতি খাম্বার জন্য দুজন করে (আমিসহ) মোট ৬ জন সহযোদ্ধাকে বাছাই করা হলো। আমি ভারতে বিস্ফোরকের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তাই আমি ওপর ৫ জনকে বিস্ফোরক স্থাপন সম্পর্কে অনুশীলন দিই। উল্লেখ্য ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমাদের দলের সকল মুক্তিযোদ্ধাই কম বেশি প্লাস্টিক বিস্ফোরকের ব্যবহার সম্বন্ধে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। প্রতি খাম্বার ৪টি করে খুঁটির প্রতিটিতে যতটুক বিস্ফোরক দরকার তা ভাগ করে পৃথক থলে ভর্তি করা হলো। রাত নয়টার পর গজারিয়া ক্যাম্প হতে আমরা যাত্রা করলাম। বৃষ্টি ভেজা পথে প্রায় রাত বারটার সময় আমরা রেকিকৃত খাম্বার গোড়ায় পৌছালাম। খাম্বায় বিস্ফোরক স্থাপন করা হলো। আমি ও আলম পাইলঙ্গুলো চেক করলাম। সিদ্ধান্ত হলো আলম নিরাপদ দূরত্ব হতে আলোকে সঙ্কেত দেখাবে ও আমরা একসাথে সেফটি ফিউজে আগুন দেব। আলোর শিখা লক্ষ করে আমি সেফটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম। বিকট আওয়াজে আমার পাইলনটি ধ্বংস হয়ে পড়ল। তখনও অন্য দুটি খাম্বার সেফটি ফিউজে আগুন দেয়া হয়নি। আওয়াজ শুনে তাঁরা ভয়ার্ত চাপা চিৎকার দিল। তাঁরা ভাবল বিদ্যুৎ খাম্বা তারসহ তাঁদের গায়ে পড়েছে। আমার বক্তব্য হলো আলো দেখেই আমি সেফটি ফিউজে আগুন দিয়েছি। সহযোদ্ধাদের অভিমত হলো আলো দেখে ফিউজে আগুন দিয়েছিলাম সেটি সম্ভবত জোনাকীর আলো ছিল। অতপর অন্য দুটি খাম্বায়ও সেফটি ফিউজে আগুন দিয়েছিলাম। তবে, আমি যে আলো দেখে ফিউজে আগুন দিয়েছিলাম সেটি সম্ভবত জনাকীর আলো ছিল। অতপর অন্য দুটি খামায় সেফটি ফিউজে আগুন দেয়া হলো এবং সাকসেসফুলভাবে ৩টি খাম্বাই ধ্বংস হলো। আমারা কাজ শেষে গজারিয়া ক্যাম্পে ফিরে এলাম। আমাদের এ অপারেশনের শব্দ ও সংবাদ কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড় পর্যন্ত পৌঁছে। পরদিন পাক আর্মি ইছাখালী সদরে রাঙ্গুনিয়ার সকলকে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিল। অনেকে হাজির হলো নিজের প্রাণ কবুল করে। আমরা একবার পরিকল্পনা করলাম সমাবেশের দূর হতে গুলি ছুঁড়ে সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে দেবে। জনগণের জান্মালের ক্ষতি হতে পারে ভেবে পরিকল্পনা পরিত্যাগ করলাম। কিন্ত জানা গেল টি আলীর দল কর্ণফুলি নদীর পাড়ে এসে অনেক দূর হতে সতর্কমূলক ৩টি গুলির আওয়াজ করে। পাক আর্মিই সকলকে সতর্ক করে দিয়ে এবং বৈদ্যুতিক খাম্বাসমূহ পাহারা দেয়ার আদেশ দিয়ে তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ করে দেয়।
[৮৭] মো. ছালেহ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত