You dont have javascript enabled! Please enable it!

গেরিলা ম্যানুয়েল

বাংলার মুক্তিযুদ্ধ
(গেরিলা বাহিনীর নির্দেশাবলী)
“এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
-বঙ্গবন্ধু
প্রণীত-
সেনানায়ক
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল
বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী।
একটি সংগ্রামী ফরিয়াদ
ভায়রা,
আজ আমরা আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে যে নৃশংসমভাবে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করছে, আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করছে ও আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে সম্পদ লুটে আমাদেরকে গৃহহারা করছে তার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি। আমাদের যুদ্ধ ততদিন চলবে যতদিন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী সমূলে নিপাত না হবে এবং বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হবে। শত্রু নিপাত করার জন্য শত্রুকে জানা দরকার ও তার রণকৌশল সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা নিতান্ত প্রয়োজন।
আমাদের শত্রু সুসজ্জিত ও সংখ্যাধিক। তার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের সময় এখনও হয়নি। আমরা এখনও গেরিলা রণকৌশল ব্যবহার করছি। অতর্কিত শত্রুর উপর হামলা করে তারা সর্বাধিক ক্ষতিসাধন করতে হবে। দেখতে হবে শত্রু যেন তার দৈনিক সরবরাহ না পায় ও কোথাও নিরাপদ অনুভব না করে।
আমি বিশ্বাস করি যে, মুক্তিযুদ্ধের যে নির্দেশাবলী এই লিপিকায় দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরিভাবে পালন করলে আমরা সফলকাম হবো।
খোদা মোদের সহায়-জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা
এম.এ.মঞ্জুর, মেজর জেনারেল
আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী*
আমাদের কাম্যঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা
আমাদের শত্রুঃ বিবেকহীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ও বর্বর হানাদার সেনারা,
যারা-
*শিশু, নারী বৃদ্ধ নির্বিচারে বাঙালীদেরকে হত্যা করছে।
*ঘৃণ্যতম উপায়ে আমাদের মা-বোনদের হত্যা করেছে।
*আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
*আমাদের সম্পদ লুট করে লক্ষ লক্ষ নিরাপধ নরনারীকে দেশছাড়া করছে।
*বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবার জন্য আমাদের মাঝে ভাঙন ধরাবার চেষ্টা করছে।
আমাদের পণঃ খোদার উপর বিশ্বাস রেখে মরণপণ সংগ্রাম অক্ষুণ্ণ রাখব, যতক্ষণ না আমাদের শেষ শত্রুটিকে দেশছাড়া করব এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখব।
মুক্তিবাহিনীর নির্দেশাবলীঃ
গেরিলা যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ঃ
১। প্রথম পর্যায়ঃ ঘাঁটি স্থাপন (১০-১৫ দিন মোটামুটি সময়)
ক. ঘাঁটি ও লুকাইবার বিভিন্ন স্থান নির্বাচন
খ. অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য রসদ রাখার গুপস্থান নির্বাচন।
গ. কর্মরত গণবাহিনী লোকদের সহিত যোগাযোগ স্থাপন।
ঘ. সাধিনতাকামী স্থানীয় দলের সহিত যোগাযোগ
ঙ. স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহিত যোগাযোগ স্থাপন এবং তাহাদের মন জয়।
চ. শত্রু ও স্থানীয় বিরুদ্ধকারী দলগুলোর সম্বন্ধে খবরাখবর সংগ্রহ।
ছ. গোপন তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা (Intelligence Network) স্থাপন ও খবরাদি আদান-প্রদান ব্যবস্থা।
[এই কাজ সব পর্যায়ে চলবে]
২।। দ্বিতীয় পর্যায়ঃ অসামরিক জনগণের সমর্থন আদায়-
[এ কাজে কোনো নির্দিষ্ট সময়য় নেই, তৃতীয় পর্যায় অবধি চলবে]
ক. জনগণের মনে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে জনগণের মন জয় করতে হবে। সমাজকল্যাণ কাজের মধ্যে রয়েছে-আর্তের চিকিৎসা, ত্রাণকার্য ও চুরি-ডাকাতি বন্ধ।
খ. রাজাকার, মুজাহিদ ও অন্যান্য যারা বিভিন্ন কারণে শত্রুর সহযোগিতা করছে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে হবে এবং নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিয়ে হবে।
গ. ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড এই সমস্ত ঘৃণ্য অসামাজিক কাজকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে।
ঘ. গ্রামের বা অঞ্চলের আঞ্চলিক রক্ষীবাহিনী গঠন।
৩। তৃতীয় পর্যায়ঃ সম্পূর্ণভাবে জয়লাভ না হওয়া পর্যন্ত শত্রুর ধ্বংস সাধন করা।
ক. রেলপথ, সড়ক এবং নদীপথে শত্রুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং ক্রমাগত অতর্কিত হামলা ও এ্যামবুশের মাধ্যমে শত্রুর ধ্বংস সাধন।।
খ. সকল বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট করা ও শত্রুর ব্যবহারের অনুপোযোগী করা।
গ. বিদ্যুৎ সরবরাহ নষ্ট করে দেওয়া।
ঘ. শত্রুর সরকারী অফিস আদালতকে অকেজো করে দেওয়া
ঙ. শত্রু দ্বারা নির্বাচিত অনুষ্ঠানকে বিফল করা।
চ. সকল জ্বালানি তেলের গুদাম বিনষ্ঠ করা।
ছ. মুক্তিযুদ্ধে বাধাদানকারী যে কোনো শক্তির উচ্ছেদ।
জ. আঞ্চলিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন। এ কাজে সকল সৎ কর্তব্যপরায়ণ মোড়ল মাতাব্বরদের যোগ্য স্থান দিবে এবং প্রয়োজনবোধে নতুন লোককে নিয়োগ করবে।
ঝ. পাট রপ্তানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। সরকারি গুদাম ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের [ইস্পাহানি ও আদমজী] গুদাম, যেখান থেকে পাট বিদেশে রপ্তানি করা হয় সেগুলো সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করতে হবে। দেশবাসীকে পাট না বুনে ধান বোনার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
*মেজর এম এ মঞ্জুর গেরিলা বাহিনীর জন্য ১৯৭১ সালে এ পুস্তিকাটি রচনা করে প্রচার করেছিলেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!