You dont have javascript enabled! Please enable it!

গেরিলা যুদ্ধের রীতি ও কৌশল

১। শত্রুকে চমকে দেওয়া ও প্রতারণা করা।– গেরিলার জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র কৌশল-শত্রুকে হঠাৎ চমকে দেওয়া। শত্রু অধিকৃত এলাকায় স্বল্পসংখ্যক লোকবল ও অস্ত্রবল নিয়ে কাজ করতে হয়, সুতরাং শত্রুকে আচমকা আঘাত না হানলে শত্রু প্রস্তুতি নিয়ে উল্টো আঘাত হেনে অবাঞ্ছিত পরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে পারে। অতএব এ ধরনের চমকে দেয়ার জন্য গেরিলারা নিম্নলিখিত উপায়ে কাজ করবেঃ
ক. শত্রু যেখানে তোমার আঘাতের আশঙ্কা করে না সেখানে আঘাত করো।
খ. একই স্থানে বারবার কাজ করবে না, এতে শত্রু সাবধান হয়ে আটঘাট বেঁধে আঘাত প্রতিহত করবে।
গ. রাত্রের অন্ধকারে কাজ করবে
ঘ. তোমার কাজের কোনো নিয়মিত পদ্ধিতি হবে না, এ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করবে।
ঙ. কঠিন সাবধানতা অবলম্বন করবে,
২। সাবধানতা- বেঁচে থাকা গেরিলার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এমন কোনো করবে না যাতে শত্রু তোমাকে আচমকা আঘাত না করতে পারে।
৩। গতিশীলতা- নিয়মিত যুদ্ধে সৈনিকদের যে সব যানবাহনের সুযোগ থাকে, গেরিলাদের তা থাকে না। এই জন্য গেরিলা তৎপরতা এমন সব স্থানে করতে হবে যেখানে নিয়মিত সৈনিকের আধুনিক যানবাহন পৌঁছানো সম্বব নয়।
গেরিলা গতিশীলতার প্রয়োজনঃ
ক. ধাঁধার জন্য।
খ. চমকে দেয়ার জন্য
গতিশীলতার জন্য গেরিলাঃ
গ. শারীরিকভাবে হালকা হবে।
ঘ. বাহ্যিক ও মানসিক দিক থেকে দৃঢ় হবে।
ঙ. চিন্তাশীল ও ভালো পরিকল্পনাবিদ হবে।
৪। আক্রমণ-গেরিলাই সর্বদা আক্রমণ উদ্যোগী হবে। যদি কোথাও শত্রু আক্রমণ করে তবে যথাসম্ভব সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে যেতে হবে।
৫। চেতনা- গেরিলার চেতনা ও উদ্যম সর্বোচ্চ স্তরের হওয়া চাই। তাদের মনোভাব এমন হবে যে, তারা সবাই একই পরিবারের লোক, একই আদর্শ বা কারণের জন্য যুদ্ধে রত। সাথীকে বিপদে ফেলে গেরিলা কখনো পালায় না।
৬। নিয়মানুবর্তিতা- গেরিলার শৃঙ্খলা সর্বোচ্চ স্তরের হবে। নিজের জীবন বিপন্ন করেও গেরিলা তার দলপতির নির্দেশ মানে।
মুক্তিবাহিনী কি করবে বা কি করবে না।
১। কি করবেঃ
ক. সর্বদা শত্রুর খবরাখবর সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।
খ. শত্রুর চর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তাদের সম্বন্ধে সজাগ থাকতে হবে
গ. সাস্ত্রী, পর্যবেক্ষন পোষ্ট, পেট্রল, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রয়োজনমতো ঘাঁটিকে রক্ষা করতে হবে।
ঘ. শত্রু যেখানে দুর্বল সেখানে সকল শক্তি একত্রিত করে আঘাত হানতে হবে।
শত্রু অধিক শক্তিশালী হলে সরে আসতে হবে।
ঙ. গেরিলাকে সর্বদা চলমান থাকতে হবে- কোনো অপারেশন শেষে তৎক্ষণাৎ সরে আসতে হবে।
চ. গেরিলা তৎপরতা জবাব হিসাবে শত্রুর যে কোনো ধ্বংসাত্মক আক্রমণ থেকে গ্রামকে বাঁচাতে হবে।
ছ. নারীদের প্রতি গেরিলারা সম্মান প্রদর্শন করবে এবং শিশুদের স্নেহ করবে।
বিপদে উভয়কে বাঁচাবে।
জ. মুক্তিবাহিনীর সততা, ন্যায়বিচার এবং একনিষ্ঠতার উদাহরণ জনগণের সামনে প্রদান করতে হবে।
২। কি করবে নাঃ
ক. বাছ-বিচার ছাড়া বেসামরিক হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হবে না।
খ. গৃহবিবাদে লিপ্ত হবে না অতীতের গৃহবিবাদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করবে না
গ. মুক্তিবাহিনী লুঠতরাজ, হত্যাকাণদ, ধর্ষণ বা অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি অন্যায় কার্যে কখনই লিপ্ত হবে না- এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
ঘ. কোনো অপারেশনের লুটের মাল ছোঁবে না। কোনো সরকারি গুদাম ইত্যাদি দখল করা হলে স্থানীয় লোকদের মধ্যে গুদামজাত মাল যাতে বিতরণ হয় তাই দেখবে-নিজেরা জড়িয়ে পড়বে না। কোনো শত্রুর চর নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীরা তার সম্পত্তির মালিকানা পাবে।
ঙ. অপারেশনের পরিকল্পনা সম্বন্ধে শুধু যার জানা প্রয়োজন সে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা করবে না।
চ. একই জায়গায় স্থিতিশীল হবে না- সর্বদা চলমান না থাকলে সেটা আত্মঘাতি হবে।
মুক্তিবাহিনী দলপতি হিসাব নিন্মলিখিত কর্তব্যগুলো অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে।
১. পুলিশ বিভাগসহ পাকিস্তান সরকারে সকল প্রশাসন বিকল করা।
২. পাকসেনা, রাজকার ও পুলিশ বাহিনীর অত্যাচার থেকে বেসামরিক জনসাধারণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
৩. দুর্ভিক্ষ-কালীন সময় বেসামরিক জনগণকে খাদ্য সরবরাহ।
৪. যথাসাধ্য আর্তের চিকিৎসা ব্যবস্থা।
৫. শিশুদের বিদ্যালয়য়ের শিক্ষাগ্রহণসহ সকল স্তরের মানুষকে তার নিজের পেশাগত কার্যে ব্যস্ত রাখতে হবে-যেমন কর্মকার, ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও চাষি প্রত্যেকেই তার নিজের কাজ ব্যস্ত থাকবে।
৬. মুক্তিবাহিনী সদস্যদের মধ্যে একটা, শৃঙ্খলা ও আমাদের মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি অটুট বিশ্বাস অবিচল তার খেয়াল রাখা।
শপথনামা
আমি এতদ্বারা আল্লাহ/ভগবানকে সাক্ষী রাখিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করিতে আমি প্রস্তুত। আমি আরও অঙ্গীকার করিতেছি যেঃ
ক. সর্বদা বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আইনগতঃ সরকারের প্রতি ও মুক্তিবাহিনী প্রতি অনুগত থাকিব।
খ. নিজের জীবন বিপন্ন করিয়াও সকলভাবে বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করিব।
গ. আমাদের প্রধান শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধ্বংস সাধনে সর্বদা লিপ্ত থাকিব।
ঘ. কোনো লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ বা অন্য কোনো অসামাজিক কাজে লিপ্ত হইব না কোনো লুটের মাল ছোঁব না।
ঙ. নারী ও শিশুদের প্রতি কোন অশোভন আচরণ করিব না।
চ. মুক্তবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করলে কোনো বাঙ্গালিকে হত্যা করিব না ও হত্যা করিতে কাহাকেও সাহায্য করিব না।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!