You dont have javascript enabled! Please enable it!

গাগলায় অপারেশন, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম

অক্টোবর মাসের কোনো এক সময়। ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে প্রণীত হলো একটি অপারেশন পরিকল্পনা। এর নামে দেয়া হয়েছিল অপারেশন গাগলা। সে অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়েছিল ৫০ জন মুক্তিসেনার একটি শক্তিশালী গ্রুপ। তার নেতৃত্বে অর্পিত হয় কোম্পানী কমান্ডার আব্দুল হকের ওপর। মধ্যরাতের অনেক পরে গ্রুপটি রওনা করে। নাগেশ্বরী থেকে ফুলবাড়ী থানা সদরের সাথে সংযোগরক্ষাকারী সড়কের দু’পাশে অবস্থান নেয় তাঁরা গাগলা খালের অপর পাড়ে।
গাগলা খালটি গাগলা বাজারের পূর্ব পাশ দিয়ে চলে গেছে উত্তর-দক্ষিণে। এর ওপর দিয়ে চলাচলের যে ব্রিজ ছিল সেটি অনেক আগেই ডিনামাইন চার্জ করে উড়িয়ে ফেলা হয়েছে। পাকবাহিনী গাগলার পশ্চিন তীরে যেতে পারত না। খাল অতিক্রম সম্ভব হয় নি। তাদের পক্ষে গাগলা খালের পূর্ব পাড়ে পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের পদলেহনকারী এদেশীয় রাজকার, আলবদররা অকথ্য নির্যাতন চালাতো গ্রামে লুটপাট চালাতো তারপর নারী ধর্ষণ করতো। হত্যা করতো নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের, পুড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। এ ধরনের কতো যে অভিযোগ জমা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। অবশেষে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন সাবসেক্টর কমান্ডার।
হত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাটসহ সমস্ত কুকর্মে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে থাকতো রাজকার, আলবদর বাহিনী, শান্তি কমিটির লোকজন এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। এ সময় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার জন্ম দেয় পাকিস্তানীরা। জড়ো করে বিহারি যবুকদের। তারা কারাবদ্ধ অপরাধীদের মুক্ত করে নিয়ে আসে। প্রশিক্ষণ তাদের অস্ত্র চালনার। এই অপরাধী চক্রকে নিয়ে গঠন করা হয়েছিল ইপিক্যাফ বা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস। কুড়িগ্রাম জেয়ার নানা স্থানে নিয়ে আসা হলো এই ইপিক্যাফ। বেড়ে যায় অপরাধকর্ম। হত্যা এবং নারী নির্যাতনের যেন মহোৎসব চলছে পুরো এলাকাজুড়ে। তাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে কত লোক, ধর্ষিত হয়ে কত রমণী, নির্যাতিত হয়েছে কত গ্রামবাসী তার হিসাব নেই।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটী বাড়ির ঝোপ-জঙ্গলে অবস্থান নেয় বাংলার সূর্য সন্তানরা। মূল রাস্তার দিকে নজর রেখে দু’পাশের গাছগাছালি, বাঁশবন ইত্যাদির আড়ালে, অন্ধকারে নিজেদের আড়াল করে থাকে তারা। আপন ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে গাগলা খান অতিক্রম করে নির্দিষ্ট স্থান পৌঁছে অবস্থান নিতে প্রায় রাত শেষ পর্যায়ে। কারো কারো মতে, তিনটার মধ্যেই তারা পৌঁছেছিল গাগলায়। তারপর থেকে শুধু অপেক্ষার পালা, এ পথে পাকিস্তানী হায়েনাগুলো কখন আসবে। কেটে গেল রাত। আকাশ ফর্সা হয়ে ওঠে। এক সময় মসজিদ থেকে ধ্বনিত হলো আজানের ধ্বনি। ৬তা, ৭টা, ৮টা, ৯টা। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে তার আপন গতিতে।
একটা সময় ঘড়িতে ১০টা বাজার সঙ্কেত পাওয়া গেল। মুক্তিসেনারা তখনো আছে ওঁৎ পেতে। জঙ্গলে নিজেদের আড়াল করে ৫০ জন ঝোপে, বনে-বাদয়াড়ে লুকিয়ে আছে কয়েকটি বাড়ির আশপাশে। অথচ সাত ঘন্টার ব্যবধানেও কেউ টের পায় নি। বুঝতে পারে নি তাদের অস্তিত্ব। পাকসেনারা তো অনুমানও করতে পারে নি। তাই রুটিনমাফিক ১০টার দিকে আসে তাদের এক গ্রুপ। এই গ্রুপে পাকিস্তানী নিয়মিত সেনাবাহিনী সদস্য। সাথে রয়েছে একটি ই.পি ক্যাফ বাহিনী। তাদের আগমন সংবাদে গ্রাম ছেড়ে পেছন দিকে পালিয়ে গেছে মহিলারা। যুবকরাও গাগলা অতিক্রম করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে। অন্যরাও যার যার মতো পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। কিন্তু পাক হায়েনাগুলোর চোখ খোঁজে ফিরছে গ্রামের মেয়েদের উদ্দেশ্যে তাদের আরো আছে, সেটি হলো মূল্যবান দ্রব্যাদি লুটে নেয়া। মুক্তিসেনাদের অবস্থান অতিক্রম করে আরো একটু এগিয়ে গেছে। তাদের সামনে পাগলা খাল। পেছনে ডানে-বাঁয়ে দু’দিকেই মুক্তিসেনা। এমন একটি অবস্থানেই পাকসেনাদের পৌঁছার অপেক্ষায় ছিল মুক্তিবাহিনী। দু’দিক থেকে একই সাথে চালানো হলো সাঁড়াশি আক্রমণ। পাকিস্তানীরাও তখন পাল্টা গুলি ছোড়ে কিন্তু তা তেমন কার্যকর হচ্ছিল না। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতি মুহূর্তেই তীব্রতর হচ্ছিল। লুটিয়ে পড়েছে তাদের অধিকাংশ সৈন্য। লাশের ওপর লাশ। তার ওপর লাশ। আনন্দে উল্লাসিত হয়ে আরো সামনে চলে আসছে মুক্তিসেনারা। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে বিপর্যয়
খানসেনাদের পক্ষ থেকে গুলি আসছে না একটিও। হয়তো আর কোনো পাকিস্তানী সৈন্য সেখানে জীবিত নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে দেখা যাচ্ছে এখানে-ওখানে উর্দি পরা লাশ আর লাশ। ঠিক এ সময়েই নাগেশ্বরী থেকে অগ্রসর হয় দ্বিতীয় পাকসেনারা গ্রুপ। পেছন থেকে আক্রমণ করে মুক্তিসেনাদের। অস্ত্র ঘুরাতে হলো বাঙালি ব্যাঘ্রদের। সিংহ নিনাদের গর্জে ওঠে তারা। কিন্তু অধিকক্ষণ যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে তো আসে নি তারা। গোলাবারুদ নিঃশেষিত হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে। কমান্ডারের নির্দেশ গুলি করে করে পেছনে ফিরতে হবে। সে নির্দেশ কার্যকর করল সবাই, অতিক্রম করল গাগলার খাল। কিন্তু কমান্ডার আবদুল হক এবং অপর তিন সহযোদ্ধা থাকলেন পেছনে। তারা খাল পার হবে সবার শেষে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী গুলিরে রেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে ওরা। কিন্তু তাৎক্ষণিক লাফ দিয়ে পড়ে যান তারা খালে। তারপর কচুরিপানা মাথায় দিয়ে জলে ভেসে ভেসে এক সময় চলে যান অন্য তীরে। নিরাপদ হয়ে গেলেন সবাই। সেদিন পাকিস্তানী হায়েনাদের ২০ থেকে ২৫ জন প্রাণ হারিয়েছে বলে আখতারুজ্জামান উল্লেখ করেছেন।
[৪৭] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!