You dont have javascript enabled! Please enable it! গাজীপুরের যুদ্ধ-৪, চাঁদপুর - সংগ্রামের নোটবুক

গাজীপুরের যুদ্ধ-৪, চাঁদপুর
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

সাব-সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে গাজীপুর ও ফরিদগঞ্জকে টার্গেট করে আমাদের একটি প্লাটুনের তিনটি সেকশান তিন জায়গায় ভাগ হয়ে পজিশনে আছে। একটি সেকশান ফরিদগঞ্জের কাছে রূপসা রাস্তার ওপর, একটি সেকশান কেরবাচর, একটি সেকশান গাজীপুরে আছে। এখানে কমান্ডার হিসাবে আছেন সুবেদার আবদুল হক, সুবেদার রব। ফরিদগঞ্জের দক্ষিণে আছে বিএলএফ। পশ্চিম দিকে আছে এফএফ বাহিনি। আজ ৪/৫ দিন হবে ফরিদগঞ্জে খাবার, ঔষধ পত্র সাপ্লাই বন্ধ। মুক্তিবাহিনী সব দিক দিয়ে পথ বন্ধ করে রেখেছে। এই অবস্থায় পাকবাহিনীও তাদের বন্ধুদের কাছে রসদ, ঔষধপত্র, ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাঠানোর জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা ফরিদগঞ্জের চতুর্দিকে যে প্রতিরোধের দূর্গ তৈরি করি তা ভেদ করে ভিতরের এরাও বাহিরে আসতে পারছে না। আজ একটি খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদি নিয়ে একটি লঞ্চ চাঁদপুর থেকে রওয়ানা হয়ে ফরিদগঞ্জ আসছে। এই খবর আমাদের কাছে সাইকেলে ম্যাসেঞ্জার সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে ক্যাম্পে পৌঁছায়। লঞ্চ চান্দ্রা বাজার ও টুবগি হয়ে আসছে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরে ডিফেন্স বসায়। এই খবর দ্রুত অন্যান্য অবস্থানের মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্কতার জন্য জানিয়ে দেওয়া হয়। খবর পাওয়ার সাথে সাথে সুবেদার আবদুল হকের কমান্ডে একটি গ্রুপ গাজীপুর শহীদ মেম্বারদের বাড়ি হতে গাজীপুর বাজারের বামপাশে পর্যন্ত রাখেন। এদিকে গাজীপুরের ঈদগাহ থেকে শেখের ডোন পর্যন্ত ডিফেন্স করেন, ফরিদগঞ্জ থানা এফএফ প্লাটুন কমান্ডার জনাব মাহবুবুর রহমান (বর্তমান জেলা প্রশাসক, পাবনা) ও প্লাটুন কমান্ডার খাজা আহম্মদ ও তার গ্রুপ। এফ এফ দলের কমান্ডে আছেন মাহবুব আই। আজ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আছে ৭টি এলএমজি, প্রচুর এস এল আর ও ২ ইঞ্চি মর্টার ও রাইফেল। পূর্বেই নির্দেশ ছিল লঞ্চ এখন গাজীপুরের সোজা আসবে প্রথম ফায়ার ওপেন হবে মাঝখান থেকে সুবেদার হকের কমান্ডে। পরে তিন দিক থেকে একযোগে আক্রমণ হবে। কমান্ডারের নির্দেশ ছাড়া কেউ পিছনে বা সামনে অগ্রসর হতে পারবে না। যেমন কথা তেমন কাজ। দুশমন পাকবেনিয়াদের নির্মূলে বাঘা বাঙালী বীর যোদ্ধারা প্রস্তুত। লঞ্চটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাজাপুর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। লঞ্চের মাথায় বেঈমানদের পতাকা দেখা যাচ্ছে। সবাই সতর্কতার সাথে তাদের আগমনের অপেক্ষায় আছে। লঞ্চটি যে শহীদ মেম্বারদের বাড়ির মোড়ে আসলো অমনি গতি কমিয়ে ডানে মোড় নিয়ে আবার গতি বাড়িয়ে এগিয়ে চলছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে শুরু হবে বাছাধনদের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের কেছকা মাইর সে খেয়াল তাদের থেকেও যেন নেই। এত মাইন, কিল ঘুষি, লাথির পরও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মরতে এরা কেন এত ভালবাসে? বাংলার প্রতি ইঞ্চি মাটিতে আজ মুক্তির গান শুনা যাচ্ছে। বাঙালীদের প্রতিরোধের অনলে ওরা দাউ দাউ করে জ্বলে মরেও বেহায়ার মত বাঁচার সাধ নিয়ে এগিয়ে আসছে। এই গাজীপুরে তারা একে একে ৪ বার প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে বহু মৃত লাশ ও বহু আহত বন্ধুদের কাঁধে পিঠে করে আস্তান্য ফিরেছে। হায়নাদের বেহায়াপনার সীমা ছেড়ে আজও মরতে এসেছে। লঞ্চটি গাজীপুর নদীর পাড়ে ঐতিহাসিক বটগাছের সোজা এসে গেছে। এই গাছের নিচে আছে পাশাপাশি দু’টি এলএমজি ও ২টি ২ ইঞ্চি মর্টার, সুবেদার হক কমান্ড করলেন, ফায়ার। বলার সাথে সাথে শুরু হল সামনে পিছনের থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ। প্রথম আক্রমণেই লঞ্চটি স্তব্ধ হয়ে ঘূর্ণিপাকে পড়ে গেল। লঞ্চে কোন রাজাকার ছিল না। ১০/১২ জন পাকসেনা ছিল। তাদের অনেকেই চালকসহ লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ে গেল। কেউ নিহত না হলেও প্রথম আক্রমণে অনেকেই আহত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর তরফ থেকেও শুরু হল আক্রমণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে ৩ ইঞ্চি মর্টার হামলা করে মর্টারের শেলের আঘাতে মাহবুব ভাইয়ের পা মারাত্মকভাবে যখম হয়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার প্রচণ্ড হামলার কাছে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী সাতরিয়ে নদীর অপ পাড়ে গিয়ে উঠে। তারা ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে, বুক সমান পানি ভেঙে ধানুয়ার রাস্তায় গিয়ে উঠে। পরে আমরা জেনেছি আহতদের রিক্সায় করে ফরিদগঞ্জ নিয়ে যায়। লঞ্চটি ছিল একটি কার্গো ধরনের। এদিকে লঞ্চটি চালকবাহিনী ঘুরতে ঘুরতে শেখের ডোন অবস্থানে গেলে প্রচণ্ড আক্রমণে লঞ্চটি ছিদ্র হয়ে একসময় নদীতে তলিয়ে যায়। এখানে জনাব মাহবুব ভাই ও খাজা আহমেদ অত্যন্ত সাহসের সাথে লড়াই করেন। পাকবাহিনী লঞ্চটি নিমজ্জিত হওয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ কে দেখে। এদিকে ফরিদগঞ্জে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে জিম্মি। আজ প্রচণ্ড লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একটি কার্গোলঞ্চ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়। সেই খবরে চতুর্দিকে হতে শত শত জনতা শ্লোগান দিতে দিতে গাজীপুরে জড়ো হয়। জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা টেনে লঞ্চটি পাড়ে তুলে ফেলে। লঞ্চে যে সকল মালামাল ছিল জনতা সব নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে, যে যেভাবে পেরেছে আনন্দ করে নিয়ে যায়। এই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা জনতার উল্লাসে আর মালামাল নিয়ে যাওয়ার কর্মকান্ডে ইচ্ছে করেই বাঁধা দেয়নি। আময়াদের শাহাজাহান ভাই-১ (উভারামপুরের) সুবেদার হককে বলে লঞ্চের উপরে যে বড় একটি ত্রিফল ছিল ভাগে নেন। পাকবাহিনী লঞ্চ গাজীপুরের আটক হওয়াতে ফরিদপগঞ্জের পাকসেনা ও রাজাকারদের অবস্থা আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
[৫০] ডাঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত