গাজীপুরের যুদ্ধ-২, চাঁদপুর
[অংশগ্রহণকারী বিবিরণ]
১৫-০৯-৭১ তারিখ। রাত ১০ টার সময় হঠাৎ কোথা থেকে পাঠান সাহেব এসে অর্ডার করেন, “সবাই যার যার হাতিয়ার নিয়ে নৌকায় উঠ’। আমরা নৌকায় উঠে ভোরে কড়ইতলী এসে পৌঁছলাম। আমাদের ২নং প্লাটুনকে দেওয়া হল গাজীপুর। অন্যান্য প্লাটুনমুন্সির হাট ও রামগঞ্জের কাছে। হাবিলদার আব্দুর রশিদ আমাদের ২নং সেকশানকে নিয়ে গাজীপুরে চলে আসেন। খবর আসল গাজীপুর এক লঞ্চ পাকফৌজ ও রাজাকার আসছে। আমরা গাজীপুরে পৌছার পূর্বেই পাকবাহিনী বাজারে উঠে গেছে। তারা বাজারে উঠে ২/১ রাউন্ড ফাঁকা আওয়াজ করছে। অস্তাদের সাথে থাকার জন্য তিনি আমাকে ইশারা করলেন। আমাদের সেকশানের গানার অলিউল্লাহ পাটোয়ারী (বাটিরগাও), আব্দুর রহমান ও সিপাহি রহমত ভূঁইয়া (বালিথুবা) কে হাবিলদার রশিদ ডান পাশে পাঠান বাড়িতে পজিশন নিতে বলেন। তাদের সাথে দিলেন একটি এলএমজি। দুইজনকে হুতার (সুত্রধর) বাড়ির ডান পাশে রাস্তার অপর রাখলেন। আমি এবং রশিদ ওস্তাদ ঢুকে গেলাম হুতার বাড়ির ভিতরে বাম পাশে (গাজীপুর বাজারের পূর্ব পাশের বাড়িতে)। আমি ১০/১২ মিনিট পর দেখতে পেলাম আমাদের ডান পাশের দুজন নেই। তারা প্লাটুন কমান্ডার রশিদ ওস্তাদের অর্ডারের আগেই স্থান পরিবর্তন করে পিছনে পাঠান বাড়ির পশ্চিম উত্তর কোনায় পজিশন নেয়। আমি রশিদ ওস্তাদকে বললাম, ওস্তাদ, আমার মনে হয় এই বাড়িতে এতো সম্মুখে পজিশান নেয়ে ঠিক হবে না, দুশমন মাত্র ৩০ গজের মাথায়। তাছাড়া এখান থেকে পিছনে ব্যাক করেও পজিশন নেওয়া মুশকিল হবে। কিছুক্ষণ ভেবে ওস্তাদ বললেন, ডানের ওদেরকে পিছনে চলে আস্তে বল। আমি বললাম ওস্তাদ ওরাতো অনেক আগেই ডান পাশে পাঠান বাড়িতে চলে গেছে। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, হেতনরা বুঝি বাগি যাওয়ার বুদ্ধি আগেই ঠিক কইচ্ছে। এগুনে কিল্লাই আর লগে আইল, আর হেতনগরে কীভাবে কমান্ডে রাখি? কোন বিপদ অইলে উপায় কি হইবে? পরে আমি এবং রশিদ ওস্তাদ পিছনে মুসলিম সওদাগর বাড়ির মসজিদের যে ছোট্ট মিম্বারের (যেখানে আল্লার ওয়াস্তে পয়সা দেয়ার জন্য ইট সিমেন্টের দ্বারা তৈরি পাকা বাক্স আড়ালে পজিশান নিলাম। প্রায় আধা ঘন্টা হবে আমরা পিছনে চলে এসেছি। সক্লা ৯টা বাজে আজকের সকালে এক গ্লাস পানিও পান করি নাই। হঠাৎ গাজীপুরের দিকে কুন্ডুলি পাকিয়ে প্রজ্জলিত অগ্নি ও ধোঁয়া উঠতে লাগল। বুঝতে পারল পাকবাহিনী গাজীপুর বাজারে আগুন লাগিয়েছে। ওরা থেমে থেমে মাঝে মাঝে গুলিও করেছে আবার মাঝে মাঝে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা বর্সিত হচ্ছে। তবে কোথায় কাকে মারছে জানিনা, কিন্তু আমাদের আশে পাশে পড়ছে না। কিছুক্ষণ পরে দেখি পাকবাহিনী হুতার বাড়ির সামনে রাস্তায় বাঁকে পজিশনে আছে। আমি ওস্তাদকে বললাম, ওস্তাদ খাইছে ওরা আমাদের কাছে এসে গেছে। ওস্তাদ বললেন, তাইৎ দেখতেছি কিন্তু কথাতো ছিল পাঠান বাড়ির গ্রুপ প্রথম ফায়ার ওপেন করবে। হেতনগো সামনে দিকে পাঞ্জাবিরা চলি আইতেছে। হেতন্রা করে কি? বই বই ঘুমাইতেছে আর হবন দেখছে। (পরে জানা গেল আমাদের ডানপাশে যারা পাঠান বাড়িতে তারা পাকবাহিনীর সামনে অগ্রসর হওয়া দেখে একবুক পানি দিয়ে পাঠান বাড়ির উত্তর পাশে মানিকরাজেহর দিকে চলে গেছে। তাদের ধারণা ছিল আমি এবং ওস্তাদ পিছনে চলে আসার কারণ এত কম লোক নিয়ে আমারা যুদ্ধ করব না। তারা যখন পজিশন ছেড়ে যাচ্ছিত পাক বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে মর্টারের শেলিং করে।) আমি এবং ওস্তাদ পজিশান আছি, কিছুক্ষণ পরে দেখি পাকবাহিনী হেলে দুলে এদিকে আসছে। কেউ কেউ মাঝে মাঝে বসে পড়ছে। ভয়ে আমার বুক ধুক ধুক করছে। আমি রশিদ ওস্তাদকে বললাম, ওস্তাদ পাকবাহিনী আসছে। তিনি আমাকে বললেন, বাবা আল্লাহ আল্লাহ কর। আমি এবং রশিদ ওস্তাদ দুশমন বরাবর পজিশন নিয়ে বসে আছি। পাকবাহিনীর প্রায় ৩০ গজ সীমানার মধ্যে এসে পড়েছে। তিনি আমাকে বললেন, “রেডি থাক” হেতনগরে আরো আইতে দেও, আমি ফায়ার বলার সাথে সাথে গুলি করবা। পাইক্কারা কেউ এগুচ্ছে আবার কেউ কেউ বসে বসে সামনে ডান বাঁয়ে দেখছে এভাবে খুব সতর্কতার সাথে এগুচ্ছে। মাঝে মাঝে আশে পাশে সিঙ্গেল ফায়ারও করছে। আজ পাকফৌজ এত সম্মুখে তার পরেল কেন জানি না, ভয় তেমন পাচ্ছি না। এখন মনে সাহস পাচ্ছি যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ঠিক মত গুলি করতে পারবো জয়কে ততক্ষণ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখত পারবো। পাকবাহিনী টার্গেট মত আসার সাথে সাথে ওস্তাদ ফায়ার বলে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করলেন। আমিও ওনার সাথে সাথে ওস্তাদ ফায়ার বলে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করলেন। আমিও ওনার সাথে সাথে একত্রে গুলি করে যাচ্ছি। আমাদের গুলির সাথে সাথে পাকবাহিনী চিৎকার দিয়ে রাস্তার পাশে ধানক্ষেত পড়ে গেল। আমরা একটানা ৫/৭ মিনিট গুলি করে যাচ্ছি। এবার ওস্তাদ বলেন, বাবা আমি ফায়ার করি, তুমি পিছনের দিকে সওদাগর বাড়ির পুকুরে পজিসন নিয়ে ফায়ার কর, যাতে আমি পিছনে আসতে পারি। তুমি নিরাপদে পৌছলে আমি তোমার কাছে চলে আসব কারণ এখানে থাকা নিরাপদ নয়। ওস্তাদ তাদের উপর অনবরত ফায়ার করে যাচ্ছে। আমি বুলেটের বাক্স দুইটি এবং এলএমজির স্পেয়ার ব্যারেল নি অতি কষ্টে পিছনে পুকুরের ভিতর দিয়ে সওদাগর বাড়ির বাগানের ভিতর দিয়ে এসে পুকুরে পজিশন নিলাম। আমি যখন গুলি শুরু করলাম ওস্তাদ একলাফে পিছনে পড়ে চোখের প্লকে আমার কাছে এসে পজিশন নিলেন। ১০/১২ মিনিট পর হুতার বাড়ি এবং পাঠান বাড়ি হতে শুরু হল আমাদের উপর বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ। মাঝে মাঝে আমাদের আশেপাশে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা পড়ছে। আমরা সওদাগর বাড়ির পুকুর থেকে কয়েক ম্যাগজিন এল এমজি ব্রাশ ফায়ার করার পর নিরাপদ নয় ভেবে পিছনে ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে ২০/২৫ মিনিটে তিনার বাড়ির দক্ষিণ পাশে নারিকেল গাছের গোড়ায় এসে পজিশন নিলাম। আমরা প্রায় ৫ মিনিট হবে পজিশনে আছি। পাকবাহিনী অনবরত গুলি করেই যাচ্ছে। আমরা আমাদের পজিশন থেকে তাদের দেখতে পাইনা বলে আর গুলি করছিনা। আমি ডান পাশে তাকিয়ে দেখি তিনার বাড়ির ছেলে মেয়ে ছোট বড় ১০/১২ জন গর্তের ভিতরে পড়ে আছে। প্রিয় পাঠক, এই দৃশে যে করুণ হৃদয় বিদারক ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এতো আমাদের চোখের সামনে। রাস্তার আশে পাশে যাদের বাড়ি ঘর তাদের উপায়? তারা এই অবস্থায় গরু, ছাগল নিয়ে কোথায় যাবে? কীভাবে জীবন বাঁচাবে? প্রায় ১০/১২ মিনিট পর দেখি পাকবাহিনী আস্তে আস্তে সামনে আসছে। তবে কেউ হাঁটছে কেউ বসে পজিশনে আছে। ওস্তাদ বললেন, আরো সামনে আসতে দাও এবং সামনের গুলাইনের টার্গেট কর। এদিকে পাকবাহিনীর একটু গ্রুপ সওদাগর বাড়ি হতে একটানা গুলি করে যাচ্ছে। পাকবাহিনী তিনার বাড়ি ও মাঝি বাড়ির মাঝামাঝি এসে গেছে। রশিদ ওস্তাদ বললেন, রেডি ফায়ার। অমনি আমরা গুলির মাধ্যমে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের গুলির সাথে সাথে পাকিবাহিনি ৪/৫ হাতে লাফিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে গেল। এবারও স্পষ্ট তাদের কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। একটানা ১০/১২ মিনিট গুলি করার পর ওস্তাদ আমাকে বললেন, তোমার হাতিয়ার রাখ, একটা একটা করি ম্যাগজিন লোড করি আরে দাও। আমি পাইক্কাগো দেহি চাইড়য়ম। আমি দেখলাম ওস্তাদ এবার এলএমজি গাছের মাঝ খানে একটু উচি স্থানে বসিয়ে একের পর এক ম্যাগজিন শেষ করে যাচ্ছে। এবার আমাদের উপর চতুর্দিক হতে বৃষ্টির মত গুলি আসছে। মাঝে মাঝে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গুলিও পড়ছে। হঠাৎ ফায়ার করতে করতে এলএমজির স্পেয়ার ব্যারেল জাম হয়ে গেল। ওস্তাদ দ্রুত এলএমজি ব্যারেল পালটিয়ে পুনরায় গুলি শুরু করলেন। এবার আমাদের উপর যেমন হচ্ছে গুলি বর্ষ্ণ তেমনি হচ্ছে মর্টারের শেল বর্ষণ। সামনে পিছনে অনবরত পড়ছে। কোন কোনটি বিকট আওয়াজে ফাটছে, আবার কোন কোনটি নরম মাটিতে ঢুকে আর বিস্ফোরিত হচ্ছে না। আমি গর্তের লোকদের বললাম, আপনারা যত তাড়াতাড়ি পারেন ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান। আমরা বেশীক্ষণ ওখানে থাকতে পারলাম না। ওস্তাদ বললেন, বাবা তুমি গুলি কর আমি পিছনে গিয়ে পজিশন নেই। আমরা তিনার বাড়ি আড়াল করে পালাক্রমে গুলি করতে করতে পেছনে বহুদূর চলে আসলাম। পাকাবাহিনী রাস্তার উপর থেকে তিনার বাড়ি ও মাঝি বাড়ির দিকে অনবররত গুলি করে যাচ্ছে। আমরা পুনরায় পিছনে মাঝি বাড়ির কাঠের পুলের (বর্তমানে পাকা কালভাট)কাছে রাস্তার উপর পজিশন নিলাম। বর্ষার দিন তখন রাস্তার পাশে ছিল বড় বড় কচুগাছ ও বাইট গাছ (অনেকে বাইট গাছকে প্রেমকাটা বলে) তার ভিতর মাথা নত করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। আমরা এবার একটি গুলিও করছিনা। পাকবাহিনী থেমে থেমে গুলি করছে। আমরা প্রায় ৩০ মিনিট পজিশনে আছি হঠাৎ দেখি পাকবাহিনী তিনার বাড়ি ও মাঝি বাড়ির মাঝখানে একজনের থেকে আর একজনের বেশ দূরত্ব রেখে একটু হাটে আবার বসে পড়ে, আবার হাটে আবার বসে পড়ে, মাঝে মাঝে পজিশন নিয়ে চতুর্দিকে তাকিয়ে আমাদের দিকে আসছে। এবার কিছু পাকবাহিনী তিনার বাড়িতে ঢুকে পজিশন নিয়ে আমাদের দিকে গুলি করছে। তাদের গুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে শাই শাই করে চলে যাচ্ছে। আমরা যে রাস্তার উপর পজিশনে আছি তা পাকবাহিনী জানে না। আমি বললাম, ওস্তাদ আমার মনে হয় আমাদের এবারের পজিশন অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। আমরা এখান থেকে কিছুতেই পিছনে ব্যাক করতে পারব না। তারা যে ভাবে এগিয়ে আসছে তারা আমাদের অবস্থান টের পেলে আমাদের কিছুতেই ছাড়বেনা। পাকবাহিনী গুলি করবে ক্রলিং করে হলেও আমাদের কাছে চলে আসবে। আমার কথা শুনে রশিদ ওস্তাদ কি যেন ভাবলেন এবং বললেন, বাবা আল্লাহ ভরসা এবার ঝুকি বেশী তবে ফায়দা অনেক। আমরা যদি প্রথম থেকে ঠিকমত ফাইট দিতে পারি তবে আমাদের প্রথম আক্রমনেই পাকবাহিনী। বেশীর ভাগ মেসাকার হয়ে যাবে। তিনি একটু থেমে বললেন, খোদা বা করুক, আর যদি কিছু ঐ যায়গিন, পইক্কাগো গুলিতে মরি যাই, বাবা আমার লাশটা যেমন করেই হউক ধান ক্ষেতের ভিতরদি টানি পিছনে লই যাইবা আর আল্লাহ না করুক তোমার যদি কোন ক্ষতি হই যায়, তোমাকে রাখি আমি এখান থেকে যাইতাম না। তবে বাবা যতক্ষণ তোমার কাছে গুলি আছে এবং তুমি ঠিক জায়গায় পজিশনে আছ, তোমার কোন ভয় নেই। আমি তার কোথায় মনে সাহস পেলাম এবং অতি আগ্রহে এই বীর বাঙ্গালী জদ্ধার দিকে তাকালাম। কি কঠিন এবং দৃঢ় মনোবল, কী গভীর দেশপ্রেম। কেউ জানে না নীরব দেশের জন্য, জনগণের জন্য, স্বাধীনতার জন্য লরে যাচ্ছে। নেই কোন উচ্চ আকাঙ্ক্ষা বা উচ্চ বিলাস, নেই কোন অহঙ্কার। সত্যি এতক্ষনে ভয়ে আমার অন্তকরণ শুকিয়ে আসছিল। তার ক্তহায় পুনরায় লরার সাহস পেলাম। আমি ভাবছি হয়ত ওস্তাদ এতো ঝুকিপূর্ণ পজিশন থেকে যুদ্ধ না করে বিলের ভিতর দিয়ে পাশের পালতালুকের দিকে চলে যাবে। পাকফৌজ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ওস্তাদ আমাকে বলল, আমরা এবার ৪০/৫০ গজের মাথায় গুলি চালব আমরা প্রস্তুত পাকবাহিনী প্রায় ৪০ গজের সীমনায় চলে এসেছে। ওস্তাদ বললে আর আল্লায় যা করুক এবারও আমরা দুজন। ইপিআরের বীর যোদ্ধা হাবিলদার রশিদের আদেশের সাথে সাথে আমরা দুজন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এবার যেহেতু সোজা রাস্তা আমরাও তাদের উপর ডাইরেক্ট গুলি করে যাচ্ছি। সে জন্য যতদূর পর্যন্ত গুলিরে রেঞ্জ থাকার কথা কতটুকুই কাজে লাগছে। ১০/১৫ মিনিটের ভিতর যারা রাস্তার উপরে ছিল তারা মাদের সামনে দাঁড়াতে পারলোনা। যারা তিনার বাড়ি ও মাঝি বাড়িতে ছিল তারা আমদের উপর গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা পাকবাহিনীর কান্না শুনতে পাচ্ছি। বহুদূর থেকে পাকবাহিনী কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। ওস্তাদ বললেন, এখন কাইনতাছ কেন সোনার চানেরা। মা বাবার কোলছাড়ি আইছ বাংলা মল্লুকে মরার লাই মর। এবার তাদের তরফ থেকে শুরু হল পাল্টা আক্রমণ। ওস্তাদ বললেন, তুমি হাতিয়ার রাখি আরে এলএমজির ম্যাগজিন লোড করি দেও, আমি শালাদের দেহাই দেই ইপিআর কি চিজ। ওরা জানেনা ইপিআর বর্ডারে কখনও ঘুমাইত না। ওরা আঙ্গরে বাঙালি কই বহু টিককারী কইত্য। কিন্তু হেতনরা অহনও বুঝতে পারে না বাংলার মাইর দুনিয়ার বাইর। হাবিলদার রশিদ ওস্তাদ একের পর এক গুলি করে যাচ্ছে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে এস্কল প্রলাপ বকছেন। এখন পাকবাহিনী আমাদের উপর বৃষ্টির মত গুলি করে যাচ্ছে। আমরা মাঝে মাঝে ২/১ মিনিট বিরতি দিচ্ছি। ওস্তাদ বললেন, বাবা আমাদের গুলি করন ছাড়া উপায় নাই। কিছুতেই দূর্বলতা দেহান যাবে না। আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পারলে রেহাই নেই। এখন আমরা সামনেও যেতে পারবনা পিছনেও যেতে পারব না, বাঁচার উপায় একটা, সাহসের সাথে লড়াই করে যাওয়া। আমাদের শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “গুলি আর কি পরিমাণ আছে”। আমি বললাম দেড় বাক্স আছে। হাতগ্রেনেড আছে ৪টি । তিনি আমাকে বললেন যথেষ্ট। আমাদের যে বিষয়টি এখানে সবচেয়ে বেশী কাছ করছে তা হল, সোজা রাস্তায় ফায়ার করা। সোজা রাস্তা হওয়াতে পাক ফৌজ ঠিকমত পজিশন নিতে পারছেনা। আর আমাদের গুলিতে সামনের সারির বেশীর ভাগই মারা গেছে। পাকবাহিনী বহু দূর থেকে অনবরত গুলি করে যাচ্ছে। উভয় পক্ষ থেকে থেমে থেমে আমরা প্রায় ১ ঘন্টা এই পজিশন থেকে লড়াই করে যাচ্ছি। হঠাৎ বহু উপর দিয়ে গুলি আসছে সাথে সাথে ৩ ইঞ্চি মর্টারের ফায়ার। ওস্তাদ পজিশনে থেকেই বলে উঠলেন, বাবা ইনশাল্লাহ আমরা জিতি গেছি। পাকবাহিনী এতক্ষণ ধরি লাশ সরাইছে, বলি আমাদের উপর গুলি করি রোখাই রাখছে। তারা এখন পিছনে ভাগনের চেষ্টা কইত্তাছে। এবার হঠাৎ ২/৩ হেভি মেশিনগানের গুলি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এবার ওস্তাদ রাস্তার ওপর বসে এলএমজি কাঁধে নিয়ে গুলি শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর বহুদূর অর্থাৎ সওদাগর বাড়ি ও হুতার বাড়ি থেকে গুলি আসছে। ওস্তাদ বললেন, ওরা এখন পিছনে চলি গেছে বসি থাকি আর লাভ কী? আমি তাকি দেখি শত শত জনতা বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিতে দিতে আমাদের দিকে আসছে, কেউ কেউ গাজীপুরের দিকে যাচ্ছে। আমরা আমাদের রাউন্ডের বাক্স এবং হাতিয়ার কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে পিছনে কড়ইতলীর দিকে যাচ্ছি, এমন সময় জনতার তরফ থেকে কয়েকজন এসে আমাদের জানালো গাজীপুর থেকে পাকবাহিনী তিন নৌকা রিজার্ভ করে রাজাকার ফরিদগঞ্জ পাঠায় এবং পাকবাহিনী লাশ এবং আহতদের নিয়ে দ্রুত চাঁদপুরের দিকে চলে গেছে। রাস্তার ওপর এবং গাজীপুর ঘাটে অনেক রক্তের চিহ্ন পড়ে আছে। খুব সম্ভব চিকিৎসার জন্য এবং নিহতদের সরিয়ে ফেলার জন্য তারা রাজাকারদের আলাদা ভাবে ফরিদগঞ্জ পাঠায়। তবু জনগণের চোখকে ফাঁকি দিতে পাকবাহিনী পারে নাই। পাকবাহিনী ও আমাদের ফায়ারের মাঝিবাড়ির, সওদাগর বাড়ির এবং তিনার বাড়ির অধিকাংশ নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ, কলাগাছ ঝাঝরা হয়ে ভেঙে গেছে। মানি ঝড়ের তান্ডবলীলায় সব ভেঙ্গেচুরে মেসাকার করে গেছে। আমরা খুব ধীর স্থিরভাবে হেঁটে যাচ্ছি, জনগণও আমাদের দেখে শ্লোগান দিচ্ছে। কেউ কেউ আমাদের পিছনে পিছনে হাঁটছে। জনগণ যেই আমাদের দেখছে অমনি দাঁড়িয়ে আমাদের সালাম দিচ্ছে। আমি খুব গম্ভীরভাবে সালামের জবাব নিচ্ছি। আমি প্রায়ই লক্ষ্য করছি রশিদ ওস্তাদ যুদ্ধের শেষে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন লুঙ্গিকে পরিধান করেছেন। আমরা একজন ৫৫ বৎসর বয়সের আর একজন ১৮ বৎসরের দুই বন্ধু যুদ্ধের শেষে জনগণের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আমাদের পাশ দিয়ে যারাই রাস্তা অতিক্রম করছে তারাই অতি আগ্রহে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে। তাদের ২/১ জন আমাদের সম্বন্ধে মন্তব্য করছে, “আরে এতক্ষণ ধরি যুদ্ধ কইল্ল এই দুইজনই”। বাকি মুক্তিরা মানিকরাজ, পালতালুক, উপাধিক হই কড়ইতলীর দিকে চলি আইছে। এই বুড়োই মুক্তিগো কমান্ডার, ওনি আর দেলু ভাই এই দুইজনে এতক্ষ্ণে ধরি যুদ্ধ করি পাইঞ্জাবীগো হোতাই হালাইছে। প্রিয় পাঠক, জনগণের মন্তব্য শুনে পর্বে, খুশিতে বিজয়ের গরিমায় আমার বুক ৩ ইঞ্চি ফুলে উঠল। আমি ওস্তাদের পিছে পিছে বুক ফুলিয়ে ধীরে ধীরে রাইফেল কাঁধে হাঁটছি। ওস্তাদও দৃঢ় চিত্তে এলএমজি কাঁধে করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কড়ইতলী স্কুলের কাছে আসতেই জনগণ আমাদের বলল, আপনাদের সব লোক সুলতান দারোগাগো বাড়ির কাছে চৌরাস্তায় বই ডাব খান আর জিরাইতেছে। তাদের কথা শুনার সাথে সাথে ওস্তাদ উর্দু বাংলায় মিলিয়ে গাল দিতে দিতে হাঁটছেন। আমরা তাদের কাছে আসতেই আমাদের বন্ধুরা ওস্তাদকে বুঝাতে চাইল, আমরা ভেবেছি আপনি এত কম লোক নিয়ে যুদ্ধ করবেন না, তাই আমরা পিছনে এসে এখানে পজিশন নিয়েছি। তাদের অদ্ভুত যুক্তি শুনে হাবিলদার রশিদ ওস্তাদ আরো রেগে গেলেন। তিনি বললেন, তোমাদের লজ্জা করে না বিনা যুদ্ধে জনগণের সম্পদ খাইতে। পাবলিক তোমাদের বান্দে না কিল্লাই। হারাম খোরেরা কোম্পানির ইজ্জত মাইরল। তারা আইছে বাগনের লাই। তিনি বললেন, আমরা দুইটা লোক সামনে লড়্গাই করছি, আর হেতন রা এখানে ডাব খাই যুদ্ধ কইত্তেছে। আমরা দুইজন কি মরি আছি, বা বাচি আছি, সেই খবর নেওনের নামগন্ধ নাই। আবার এখানে বেসরম হগল জনগণের সম্পদ হজম কইত্তাছ। আজ আমার সাথে যদি এই দেলু না থাক কী উপায় হইত? আমরা জনগণের সামনে মুখ দেখাইতাম কি করি? আমি ওস্তাদের কথা শুনে নীরবে আল্লার কাছে শুকুর করলাম। আমরা পাঠান সাহবের গ্রুপের দুইজন হই আর সবাই হই এলাকাতো রক্ষা করতে পেরেছি। আমরা সাহসের সাথে লড়াই করে পাকবাহিনীর বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছি। আমরা রশিদ ওস্তাদের কথা শুনছি। হঠাৎ ঝড়ের বেগে কোথায় থেকে পাঠান সাহেব ও কলিম উল্লা ভূঁইয়া চলে এলেন। তিনি এসেই সবাইকে আষ্ট্রা স্কুলের দিকে মুভ করতে অর্ডার করলেন। আমরা দুপুর ৩টায় সময় সেখানে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেলাম। প্রিয় পাঠক, এখানে মন্তব্য করতে হয়। আমাদের প্রতি কতটুকু ভালোবাসা থাকলে প্রায় ১০ মাইল পথ দৌড়ে এসে পাঠান সাহেব এবং কলিম উল্লা ভূঁইয়া যুদ্ধের খবর নিএলন এবং আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে নিজের লোকদের এগিয়ে নিতে চলে আসলেন। এতক্ষণ ওস্তাদ রাগ করলেও পাঠান সাহেবের কাছে ঠিক সবার প্রশংসা করলেন। আমরা পরে জানতে প্রেছি গাজীপুরের যুদ্ধে প্রায় ৩০/৩৫ জন রাজাকার পাকবাহিনী মারা গেছে এবং বহু আহত হয়েছে। গাজীপুরের যুদ্ধে কয়েকজন নিরীহ দেশবাসীও নিহত হয়েছে। তাদের মধযেঃ-১) ক্কারী মোঃ সোলেমান (গাজীপুর পাঠানবাড়ী), ২)শ্রী দেবেন্দ্র সূত্রধর (গাজীপুর হুতার বাড়ি) ৩) চান কা (কড়ইতলী মসজিদের পাশের বাড়ি), ৪) আনার খা (নেড়িবাড়ী গাজীপুর)। পাকবাহিনী পরের দিন হঠাৎ এসে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়ে যায়। তারা পাঠান, হুতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের মর্টারের শেলের আঘাতে একজন দিনমজুর (উপাদিক রাঢ়ি বাড়ি) মারা যায়। সেদিন তারা রাত্রে কড়ইতলী হাসপাতালে অবস্থান নেয়। আমরা তখন সূচিপাড়া ও অফিস চিতসিতে। তারা কড়ইতলী থেকে পরের দিন চাঁদপুর চলে যায়।
[৫০] ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত